book review

Book review: লেখক আর সম্পাদক, দুইয়ে মিলে তৈরি হয় বই

কেবল আদর্শ অবস্থা নয়, অনেকটা পেশাগত সহায়কের ধরনে এ বই বাস্তব পরিস্থিতিকে বিচার করে।

Advertisement

আশিস পাঠক

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ ০৮:০৩
Share:

হোয়াট এডিটর্স ডু: দি আর্ট, ক্র্যাফ্ট, অ্যান্ড বিজ়নেস অব বুক এডিটিং
সম্পা: পিটার জিনা
২৫.০০ (আমেরিকান ডলার)
শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস

Advertisement

এ বইয়ের নামটি প্রশ্নবোধক— সম্পাদকেরা কী করেন? আপাত-সহজ প্রশ্ন, উত্তরও জানা— সম্পাদনা করেন। বইয়ের জগতে এই সহজ, জানা উত্তরটা কিন্তু আসলে ধাঁধার মতোই জটিল।

বইটি মূলত ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের সম্পাদকের পেশা নিয়ে। সাধারণ ভাবে সেই পেশার দায়িত্ব বলতে পাণ্ডুলিপি থেকে প্রকাশযোগ্য বই তৈরির কাজটাকেই ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু এটাই একমাত্র কাজ নয়। গ্রন্থ-সম্পাদনা সম্পর্কে আমাদের সেই হস্তী-দর্শনকে ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিয়েছে এই বই।

Advertisement

প্রকাশনা জগতের প্রথম কথাটাই হল, কী বই ছাপব? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান থেকেই সম্পাদকের কাজ শুরু। এ বই জানাচ্ছে, সম্পাদনার তিনটি পর্যায়ের প্রথমটি হল ‘অ্যাকুইজ়িশন’— বই খুঁজে বার করা। অ্যাকুইজ়িশনস এডিটর (যাঁকে কমিশনিং এডিটর-ও বলা হয়) খোঁজ করেন নতুন লেখকের, নতুন বিষয়ের বা কোনও নতুন দৃষ্টিকোণের। আপাত ছাইপাঁশ প্রস্তাব থেকেও মণিমুক্তো সন্ধান করে আনাটাই তাঁর কৃতিত্ব।

এই সন্ধানের কথা এ বইয়ে লিখেছেন জোনাথন কার্প, ‘দি অ্যালকেমি অব অ্যাকুইজ়িশনস’ প্রবন্ধে। প্রায় চার দশকের বই-যাপনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশিয়ে তাঁর এই প্রবন্ধে ট্রেড এডিটরদের জন্য বারোটি নিয়ম বলেছেন কার্প। যেমন, বিষয়ের উপর প্রকৃত দখল প্রতিষ্ঠা করতে কোনও কোনও লেখকের বহু বছরও সময় লাগতে পারে। কিন্তু এই অধিকার এমনই বস্তু, যার জন্য পাঠককে বলা যায় যে, এই বইটি পড়ার জন্য আপনার মূল্যবান সময় ব্যয় করুন। স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জনই কোনও বিষয়ে অধিকারের জন্ম দেয় না। বিষয়ের গভীরে যাওয়ার ইচ্ছা আর ভালবাসার জোরে কঠোর পরিশ্রমে বিষয়ের উপর দখল এবং দাপট দুটোই গড়ে ওঠে। ট্রেড এডিটরদের পাশাপাশি আরও দু’ধরনের অ্যাকুইজ়িশন এডিটরের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে এই বইয়ে। এক দল, যাঁরা অ্যাকাডেমিক প্রকাশনার জন্য নতুন বইয়ের খোঁজ করেন। আর এক দল, যাঁরা একেবারে স্কুল ও কলেজ-পাঠ্য পাণ্ডুলিপি-সন্ধানী। এঁদের অভিজ্ঞতা পড়তে পড়তে বঙ্গীয় প্রকাশনার গড়পড়তা ছবিটা চোখের সামনে ভাসছিল। খুব সামান্য বঙ্গীয় প্রকাশকই সম্পাদক নিয়োগ করেন। তার মধ্যে আবার বিভিন্ন ধরনের সম্পাদক নিয়োগ তো স্বপ্নেরও অতীত। একমাত্র সরকারি আর কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনায় মাইনে-করা সম্পাদকের পদ আছে। নানা ধরনের সম্পাদক সেখানেও নেই।

নতুন সম্ভাব্য বইয়ের সন্ধানের পরের পর্যায়টি বেশ বিস্তৃত, প্রস্তাব থেকে বই। বইয়ের সম্পাদকের কাজটাকে আমরা এই পর্বে সীমিত করে দেখি। পাণ্ডুলিপিকে একটু ঘষেমেজে তৈরি করা, কিছু তথ্যগত ভুল ঠিক করা আর প্রুফ পড়া— গ্রন্থ-সম্পাদকের কাজ বলতে আমরা এই পর্যন্ত ভেবে উঠতে পারি। কিন্তু এই পর্বটাও যে কত বিচিত্র এবং ব্যাপক, তার পরিচয় আছে এই বইয়ে। এ পর্বের ছ’টি লেখার মধ্যে একটি, তার শিরোনামেই বেশ চমকে দেয়। স্কট নর্টনের ‘ওপেন হার্ট সার্জারি অর জাস্ট আ নিপ অ্যান্ড টাক’।

নর্টন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া প্রেসের এডিটিং, ডিজ়াইন ও প্রোডাকশনের ডিরেক্টর। তিনি ডেভলপমেন্টাল এডিটিং-এর এক জন বিশেষজ্ঞ। ডেভলপমেন্টাল এডিটিং-এর একটি সংজ্ঞাও দিয়েছেন তিনি— কোনও বইয়ের পাণ্ডুলিপিতে তাৎপর্যপূর্ণ কাঠামোগত পরিবর্তন বা পুনর্গঠনের কাজ। বাংলায় বলতে পারি বিকাশমূলক সম্পাদনা। পাণ্ডুলিপির মধ্যে একটি ভাল বই হয়ে ওঠার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা থাকলেও তাকে, দরকার হলে ঢেলে সাজিয়ে, একটি যথার্থ বই করে তোলার কাজটা বিকাশমূলক সম্পাদকেরই কাজ। কাজটা অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার নির্দেশকের মতো। ভারতে এখনও সম্পাদকের পেশাটা প্রতিষ্ঠিত নয়। তার উপরে বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের গড়পড়তা উদারতাও বেশ কম। ফলে তেমন যোগ্য বিকাশমূলক সম্পাদকের পরামর্শও তাঁদের কাছে ঔদ্ধত্য বলে মনে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনাগুলির ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা আরও গভীর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, অধ্যাপক মনে করেন যে, তিনি তাঁর বিষয়ের যে বইটি যেমন করে লিখেছেন, সেটা সে ভাবেই ছাপিয়ে দেওয়াটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনার কাজ, এবং ছাপিয়ে দিতে পারলেই জ্ঞানের প্রসার ঘটে। বিকাশমূলক সম্পাদনার প্রথম কথাটাই হল পাণ্ডুলিপির বা প্রস্তাবের মধ্যে তিলমাত্র সম্ভাবনা থাকলেও তাকে একটা সার্থক বইয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া, পাণ্ডুলিপিতে যেমনটা আছে, তেমনটা রেখে দেওয়া নয়।

এই বইয়ের প্রায় প্রতিটি নিবন্ধ সাধারণ গ্রন্থবিদ্যার ধারা থেকে আলাদা। কেবল আদর্শ অবস্থা নয়, অনেকটা পেশাগত সহায়কের ধরনে এ বই বাস্তব পরিস্থিতিকে বিচার করে। কোনও পাণ্ডুলিপির ডেভলপমেন্টাল এডিটর কতটা সময় দেবেন সেই পাণ্ডুলিপিকে, শুধু রিফু করে ছেড়ে দেবেন, না কি সেলাই খুলে নতুন করে বানাবেন পাঞ্জাবিটি, সেই সিদ্ধান্তও জড়িত বইয়ের সম্ভাব্য পাঠককুলের চরিত্রের সঙ্গে।

নিছক তাত্ত্বিক আলোচনা নয়, গভীর অন্তর্দৃষ্টি এ বইয়ের বিশেষ সম্পদ। বিশ্ব জুড়েই গ্রন্থ-সম্পাদনার পেশায় যাঁরা যুক্ত, তাঁরা জানেন যে, ওই অন্তর্দৃষ্টি একমাত্র দীর্ঘ, গভীর অভিজ্ঞতাতেই অর্জিত হতে পারে। ভারতীয় ভাষার প্রকাশনাতেও সেই সামগ্রিক অভিজ্ঞতার বিস্তার ঘটে চলেছে দু’শো বছরেরও বেশি সময় জুড়ে। এ দেশের গ্রন্থ-সম্পাদনার বিস্তার ও বৈচিত্রও বড় কম নয়। তার নির্যাসটুকু কখনও কেউ ধরার চেষ্টা করবেন এমনই কোনও সঙ্কলনে, সেই আশা এখনও আমার মরতে মরতেও মরেনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement