কাস্ট ম্যাটার্স
সুরজ ইয়েংডে
৫৯৯.০০
পেঙ্গুয়িন
‘কাস্ট’ জিনিসটা রক্তবীজের মতো। জাতপাত বললে পুরোটা হয় না। খানিকটা ওই যে রকম ‘নেশন’ কথাটা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ইংরেজিতে লিখেছিলেন। কখনও অস্পৃশ্যতা, কখনও চাকরি সংরক্ষণ, কখনও ভোটব্যাঙ্ক, কখনও গণতন্ত্রের প্রসার, কখনও ঔপনিবেশিক শাসকের ভাগাভাগির রাজনীতি, কখনও হিন্দুধর্মের স্ব-নির্মাণের উপকরণ। এই রকম আরও নানা রকম চেহারায় কাস্টের জনজীবনে আবির্ভাব এবং বিচরণ। সুরজ ইয়েংডে এই প্রসঙ্গে একখানা যথার্থ উপমা দিয়েছেন— ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’। সকলেই কিছু অংশ দেখতে পায়, কিন্তু কেউই গোটা জন্তুটার চেহারা দেখতে পায় না।
সুরজের আর একটা বড় তাত্ত্বিক বক্তব্য হচ্ছে যে, প্রত্যেকে কাস্ট ব্যাপারটায় নিজের মতো করে বিনিয়োগ করেছে। কেননা কাস্টের গোড়ার কথা হচ্ছে একটা পূর্বশর্ত: ধরে নেওয়া যে, কিছু মানুষ স্রেফ মনুষ্যেতর। তারা মানুষের মতো সুযোগসুবিধা না পেলে সেটা তাদের যোগ্যতার অভাব। জন্মের লটারিতে যে যা পেয়েছে, সেটাই তার নিয়তি বা যোগ্যতার মাপকাঠি।
দশ বছরের সুরজ এক বার দিদিমার সঙ্গে তাঁর কাজের জায়গায় গিয়েছিলেন। দিদিমা শৌচালয় সাফ করছেন। ছোট্ট সুরজ মূত্রত্যাগ করতে চায়। এক বার বাবুদের শৌচালয়ে ভুল করে তাকে ঢুকতে দিয়েছিলেন দিদিমা। বাবুদের বাড়ির এক গিন্নি এসে তার পর দু’জনকেই অকথ্য ভাষায় ভর্ৎসনা করবেন। একটা দশ বছরের ছেলে কী করে এই রকম একটা নির্মম অভিজ্ঞতা হজম করবে? কাস্ট ব্যাপারটা কেবল সামাজিক বৈষম্যের কাঠামোগত একটা বিশ্লেষণ নয়। সমস্ত মানুষের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে এতে বিনিয়োগ আছে।
একেই সুরজ বলছেন ‘ডমিন্যান্ট কাস্ট ন্যাশনালিজ়ম’ বা ‘অত্যাচারী জাতগুলোর জাতীয়তাবাদ’। সমস্যা হলেই এই যে বলা— রাষ্ট্রের উচিত এই কাঠামোগত বৈষম্য বন্ধ করা, এটাকেই আমাদের সকলের বিনিয়োগ বলে বিঁধেছেন সুরজ। এই যে বলা এবং ভাবা যে, আমাদের চোখের সামনে এত লক্ষ-কোটি মানুষ জানোয়ারের অধম অবস্থায় বেঁচে আছে দেখেও আমরা এটা আমার বা আমাদের দায়িত্ব নয়, বিমূর্ত রাষ্ট্রের দায়িত্ব— এই বলে নিজের কাজ করে যেতে পারি, এটাকেই আমাদের বিনিয়োগ বলছেন সুরজ। আমাদের এই আপাত নিরাপত্তা বা দূরত্বটাই আমাদের জন্মগত বা অবস্থানগত সুবিধা। একেই বেশির ভাগ মানুষ মেধা বলে গুলিয়ে ফেলেন।
এক জন শিক্ষিত বা ‘যোগ্য’ দলিতের অবস্থাটা ঠিক এর বিপ্রতীপে। তিনি যতই উন্নতি করুন না কেন, তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে চিরকাল একাকিত্ব সহ্য করে যেতে হয়। তিনি যেন সব সময়ই এক ব্যতিক্রম, কিছুতেই তাঁর উত্তরণ স্বাভাবিক নয়। ভাল হলেও সকলে বলবে যে, এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না; আর খারাপ হলে বলবে, এই-ই তো হওয়ার ছিল। সরকারি চাকরি করলেও সহকর্মীরা ধরেই নেবেন যে, দলিত কর্মচারী আদতে অকেজোই হবেন। সুরজের লেখায় স্পষ্ট হয়, এই যে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে যাঁদের কিছু হতে পারে না ধরে নিলেও কেউ কিছু বলে না, দলিত হওয়া মানে বোধ হয় সেই রকম না-মানুষের গুনতিতে জন্মানো আর বেড়ে ওঠা।
তবে সুরজের চিন্তার মৌলিকতা অন্য জায়গায়। যেমন, সাংবিধানিক নীতিবোধ দলিতদের কতখানি মুক্তি দিতে পেরেছে, সেই বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন উনি। এক দিকে কেউ সামনাসামনি সংবিধান মানি না বলে না, কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে হয়তো দলিতরা ছাড়া আর কোনও রাজনৈতিক সম্প্রদায়ই সাংবিধানিক নীতিবোধকে এতখানি প্রামাণিকতা দেয়নি। অম্বেডকর আর সংবিধান যেন একই মুদ্রার এ-পিঠ আর ও-পিঠ, এই রকম একটা লঘু সমীকরণ তৈরি করে দলিতদের এক রকম মেকি-মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখা হয়েছে, সুরজ দাবি করছেন। এই প্রসঙ্গে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু, এই দুই রাজনৈতিক-দার্শনিক ধারণার প্রসঙ্গে অম্বেডকরের বৃহত্তর অবস্থানের কথা এসেছে। সংখ্যালঘু মানে কেবল সংখ্যায় লঘু, এই রকম সীমিত অৰ্থে অম্বেডকর মোটেও ধারণাটিকে বাঁধেননি। ওঁর মতে, সংখ্যালঘু মানে প্রাতিষ্ঠানিক বঞ্চনা বা প্রান্তিকতার শিকার সমস্ত মানুষ।
আর একটা বিতর্কিত এবং স্বল্প আলোচিত বিষয়ে স্পষ্টবাদী সুরজ। প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত পেশাদার দলিতদের রাজনীতি কেমন হওয়া বাঞ্ছনীয়? এই প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি অপ্রিয় সত্য বলছেন সুরজ। এক, মধ্যবিত্ত হলেই জাতের গেরো থেকে বার হওয়া যায়, এমন ধরে নিলে চলবে না। দলিত বসের অধীনে কাজ করতে হয় বলে বিস্তর মানুষ আজও নিজেদের নিয়তিকে দোষারোপ করেন। দুই, কেবল অর্থনৈতিক মাপকাঠি না ধরে মানসিকতার মাপকাঠি ধরলে দেখা যাবে যে, অনেক মধ্যবিত্তই আসলে মধ্যবিত্ততা অর্জন করতে পারেননি বা আদৌ চান না। আমেরিকায় মধ্যবিত্তের এক রকম গণতন্ত্রীকরণ হয়েছে, কিন্তু ভারতে আজও সমাজ জাতের নিগড়ে আটক। এই পরিপ্রেক্ষিতে দলিত মধ্যবিত্তের উচ্চাকাঙ্ক্ষাও আধিপত্যবাদী জাতের উচ্চাকাঙ্ক্ষার অক্ষম অনুকরণ হয়ে সীমিত হয়ে পড়ে। দলিত মধ্যবিত্তরা এই জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দলিতের মুক্তির ভার বইতে অসমর্থ হয়ে পড়েন। তাঁরা কেবল কী ভাবে নিজেদের দলিত পরিচিতি ঘোচাবেন, সেই ফাঁদে আটকা পড়ে যান। রাষ্ট্রের বদান্যতায় উদ্ভূত দলিত মধ্যবিত্তের মুক্তির স্বপ্নগুলোও ক্রমশ অন্ধ ভাবে রাষ্ট্রবাদী হতে থাকে।
এই প্রসঙ্গে দলিত পুঁজিবাদের কথা এসেছে। আমেরিকায় বুকার টি ওয়াশিংটন ও ডব্লিউ ই বি দুবোয়া-র বিতর্কের ইতিহাস আলোচনা করে সুরজের দাবি যে, কেবল পুঁজিবাদ দলিতকে মুক্ত করতে পারে না। একই সঙ্গে তাঁদের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সাম্য চাই। তা ছাড়া দলিত পুঁজিবাদের ধারণা অতি সীমিত। দলিত কোটিপতি কোটিতে গুটিক; বৃহত্তর দলিত ক্ষেত্রে তাঁদের প্রভাব সামান্য।
তার পরে আসছে তথাকথিত উচ্চবর্ণের প্রতিবাদীদের প্রসঙ্গ। অনেক ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিবাদ করেছেন। সুরজ দেখাচ্ছেন যে, তাঁরা মূলত সংস্কারবাদী। ব্রাহ্মণ্যবাদের চূড়ান্ত নেতিবাচক কয়েকটি দিক নিয়ে তাঁরা প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু গোটা বর্ণব্যবস্থাটা তুলে দেওয়ার মতো সাহস তাঁরাও দেখাতে পারেননি। এই প্রসঙ্গে সুরজ জ্যোতিবা ফুলে এবং অম্বেডকরের ব্রাহ্মণ সঙ্গীদের দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। ব্রাহ্মণদের কেবল প্রতিবাদী হলে বা সামাজিক বৈষম্য না মানলে হবে না। গোটা সমাজব্যবস্থাটিকে সমূলে উৎপাটনের দায়িত্বও নিতে হবে। এটা সুরজের কাজের মৌলিক চ্যালেঞ্জ। কাউকেই ছেড়ে কথা বলেননি।
এই প্রসঙ্গে দুটো জরুরি কথা বলার। এক, ‘গ্রেডেড ইনইকুয়ালিটি’ বা স্তরীভূত বৈষম্য হয়তো কয়েকটি ‘আত্মঘাতী’ ব্রাহ্মণের সামাজিক স্বেচ্ছামৃত্যুতে যাওয়ার নয়। সুরজ সেই আশাও করছেন না। কেবল এইটুকু বলছেন যে জাতের সমস্যা এক দলিতের নয়। এমনকি, মূলত দলিতের নয়। যত দিন না সমাজের অধিকাংশ মানুষ মাঠে নামছে, তত দিন কাস্ট থাকবে। এইখানেই কাস্ট ম্যাটার্স। কয়েক জন মুক্তিকামী দলিত বা প্রতিবাদী উচ্চবর্ণের মানুষের উদ্যোগে কোনও দিনই সমস্যা মিটবে না। আসলে সুরজ এই নিঃশব্দ সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সঙ্গে একটা কথোপকথন চাইছেন। দুই, ঠিক এই কারণেই সুরজের অভিমান ভীষণ একা এবং নিঃসঙ্গ শোনায়। জাতবৈষম্য উৎখাত করার দায় আর কত দিন শিক্ষিত দলিত একা বইবে?
অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়