book review

নিজের কবিতা বিষয়ে আস্থা ও সংশয়

শ্রেষ্ঠ কবিতা পেয়ে দেখেছি কবিদের স্বনির্বাচিত কবিতার সঙ্গে যুক্ত বহুমূল্য গদ্য-ভূমিকাও। এঁদের মন জানার জন্য, বৃহত্তর পাঠকের কাছে সত্তর দশকের এই তিন জন কবির গদ্য-ভূমিকাংশ তুলে দিচ্ছি।

Advertisement

জয় গোস্বামী

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:১৯
Share:

আশ্লিষ্ট: ‘পোয়েট্রি অ্যান্ড পোয়েটস’। ফ্রান্সিসকো গোয়া-র আঁকা ছবি। উইকিমিডিয়া কমন্স

শ্রেষ্ঠ কবিতার চারটি সংগ্রহ হাতে এল। তিনটির রচয়িতা এ যুগের খ্যাতিমান ও সুপ্রতিষ্ঠিত তিন কবিব্যক্তিত্ব— অমিতাভ গুপ্ত, মৃদুল দাশগুপ্ত, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁদের তিন জনেরই দু’টি করে কবিতাসমগ্র আছে। তিন জনই পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সরকারি পুরস্কারে ভূষিত। কবিজীবনের প্রথম থেকেই এঁরা শ্রদ্ধেয় সমসাময়িকদের সম্ভ্রমপ্রাপ্ত ও শেষোক্ত দু’জন পরবর্তী নবীনদের কাছে গুরুস্থানীয় হিসেবে দীপ্তিমান।

Advertisement

শ্রেষ্ঠ কবিতা পেয়ে দেখেছি কবিদের স্বনির্বাচিত কবিতার সঙ্গে যুক্ত বহুমূল্য গদ্য-ভূমিকাও। এঁদের মন জানার জন্য, বৃহত্তর পাঠকের কাছে সত্তর দশকের এই তিন জন কবির গদ্য-ভূমিকাংশ তুলে দিচ্ছি। জ্যেষ্ঠতম অমিতাভ গুপ্ত ভূমিকায় বলেছেন: “উত্তরচেতনার নান্দনিক তত্ত্ববিশ্বে পাঠসংহতির সন্ধান লাভ করা গিয়েছে। অনুরূপ একটি সংহতিসূত্রে কিছু কবিতা প্রয়াসকে একাঙ্গ করা হল, পড়ে রইল বাইরে অন্তর্মুখী উচ্চারণগুলি।... আদ্যন্ত বাদ দেওয়া হল কয়েকটি পুঁথিকে।”

কী বলছেন প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়? “আমার তিনটে বই যথা ‘গুপ্ত দাম্পত্যকথা’, ‘রাধাতপা চতুর্দশী’ এবং ‘টুরিস্ট কাহিনি’-র মধ্যে থেকে কোনো লেখা এই শ্রেষ্ঠ কবিতায় রাখিনি।... ওদের বাদ রেখেই এই ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র সংকলন করলাম। বাকিটা পাঠককে একটু কষ্ট করে খুঁজে পেতে নিতে হবে... এ ছাড়া আমি আমার প্রথম এ-ধরনের গ্রন্থ ‘বঙ্গীয় চতুর্দশপদী’ থেকেও কোনো কবিতা এখানে রাখিনি।... যাই হোক সব মিলিয়ে তবু দাঁড়াল একটা কিছু। এই-ই আমার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’!”

Advertisement

শ্রেষ্ঠ কবিতা

অমিতাভ গুপ্ত

১৫০.০০

মৃদুল দাশগুপ্ত

২৫০.০০

প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়

২০০.০০

অভীক মজুমদার

২৫০.০০

দে’জ

‘বাকিটা পাঠককে একটু কষ্ট করে খুঁজে পেতে নিতে হবে’— এটিই কবির নির্দেশ। কাজটা একটু সহজ করে দিই। ‘রাবণ’ প্রকাশিত প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বাধুনিক কবিতাসমগ্র কলেজ স্ট্রিটে পাওয়া যাচ্ছে এখন।

এই সব ভূমিকাংশ কবিদের মনোভূমির তারকাদ্যুতি দেখাতে পারে পাঠককে। নিজের রচনা বিষয়ে মৃদুল দাশগুপ্ত বলেছেন: “কবিতা আকাশ থেকে নামে। আমার ভূমিকা অবতরণক্ষেত্রের। আমার মন ও মস্তিষ্ক সে-অবতরণে আলোকসম্পাত ও দিকনির্দেশ করে।” পল ভালেরির এই সর্বজ্ঞাত উক্তি নিশ্চয়ই সকলেরই মনে পড়ছে: “প্রথম লাইনটি আসে স্বর্গ থেকে, বাকিটা তুমি তৈরি করে নাও।”

মৃদুল দাশগুপ্ত তাঁর ভূমিকা সমাপ্ত করছেন কী বলে? “প্রায় একই সময়ে ভিন্ন একটি প্রকাশনী থেকে আমার নতুন একটি কাব্যগ্রন্থ ‘আগুনের অবাক ফোয়ারা’ প্রকাশিত হতে চলেছে। সেই কাব্যগ্রন্থের কবিতা ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় অন্তর্ভুক্ত হয়নি।” উল্লিখিত বইটি বেরিয়েছে বোধশব্দ প্রকাশনা থেকে।

তা হলে দেখলাম, এই তিন কবি তাঁদের এক বা একাধিক কবিতাগ্রন্থ শ্রেষ্ঠসংগ্রহ থেকে বর্জন করেছেন। অমিতাভের কবিদৃষ্টি নিবদ্ধ উন্নততর সমাজস্বপ্নের দিকে। এঁদের তিন জনেরই কাব্যের মধ্যে অন্যায়ের প্রতিবাদ, একান্ত প্রেমার্তি, বক্র-ব্যঙ্গোক্তি, মানবিক ভূমিসংলগ্নতা— সবই সার্থক কবিতা-রূপে উত্তীর্ণ। এঁদের কবিত্ব তর্কাতীত ভাবে শ্রেষ্ঠত্বে আসীন। প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতায় তুখোড় ঝলমলে স্মার্টনেসের পাশে মহাশক্তির প্রতি অধ্যাত্মবিশ্বাস এসে কাব্যমহিমার এক আশ্চর্য সহাবস্থান ঘটায়। অন্য দিকে, ভিড়-বাসের একটি অচেনা তরুণীর প্রতি কবিহৃদয়ের পিতৃত্ব প্রকাশ মনকে জ্যোতির্ময় করে তোলে। আর, মৃদুল দাশগুপ্তের কাব্যে, তাঁর বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেখি অপূর্ব রহস্যময় সঙ্কেতধর্মের ক্রম-উদ্ভাসন।

এই তিন জন কবিই অসামান্য ছন্দনিপুণ। অমিতাভ গুপ্ত তাঁর এই সংগ্রহের প্রথম কবিতা ‘একজন’ থেকে সর্বশেষ রচনা ‘মাটি’ পর্যন্ত সেই সক্ষমতার বহুমুখী দৃষ্টান্ত রেখেছেন। মৃদুল দাশগুপ্ত তাঁর প্রথম বই থেকেই ছন্দকুশলতায় অগ্রগণ্য সে সত্য তাঁর ‘এল্ পার্টিডো কমিউনিস্তা’, ‘গ্রাম চাঁপাডাঙা-৩০২০’, ‘বিবাহপ্রস্তাব’— এই সব বিখ্যাত রচনায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন বহু দিন আগেই। প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও তাঁর ‘বঙ্গালিনী’, ‘বজ্র শোকগাথা’ বা ‘মওলা হনুমান’ এই রকম অনেক কবিতাই তাঁর ছন্দদক্ষতার স্বাক্ষরে ভাস্বর। এই অগ্রজ তিন জন কবির গদ্যভূমিকায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তাঁদের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গস্থ এবং নিজ নিজ কবিতা বিষয়ে এক ধরনের নিশ্চিতি ও অটল আস্থা তাঁরা তিন জনই ধারণ করছেন। প্রতিষ্ঠিত কবিদের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু অভীক মজুমদারের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই আত্মবিশ্বাসের জায়গা নিয়েছে আত্মসন্দেহ। ভূমিকা বলছে: “‘শ্রেষ্ঠ’নির্বাচনের তাগিদে নিজের কবিতা পড়লে মনে হয়, অন্ধকার।” বলছে: “আতঙ্কে কলম হাতে নেওয়া।” অগ্রজ তিন জনের দুই প্রজন্ম পরের কবি অভীক। চিরদিনই নিজ রচনা বিষয়ে তিনি কুণ্ঠিত। অভীকের কবিতার মধ্যে প্রেম পদার্পণ করেছে। এসেছে সময় ও রাজনীতি। কিন্তু উচ্চ কোনও ঘোষণাস্বর নেই তাঁর। অভীকের কবিতা প্রধানত ছন্দাশ্রিত। অন্ত্যমিল প্রয়োগ করেন তিনি প্রায় প্রত্যেক লেখায়। তবে প্রথম পাঠে তাঁর অন্ত্যমিল ধরা দেয় না। এক লুক্কায়িত কাঠামোর মধ্যে দূরে দূরে অবস্থান করে সেই সব অন্ত্যমিল। এ যুগে ছন্দে-মিলে অনেক কবি সিদ্ধহস্ত। চমকপ্রদ পটুত্ববাহী মিলে-ছন্দে অনেক উজ্জ্বলতা এ সময়ে দেখা যায়। কিন্তু অভীকের ব্যবহৃত ছন্দে অন্য বিশেষত্ব আছে। ছন্দ কী, এ কথা বোঝাতে এজ়রা পাউন্ড বলেছিলেন: ‘ওয়ার্ডস কাট ইনটু টাইম’। অভীক কী করেন? তিনি ছন্দের একেবারে উৎসে হাত রাখেন। ছন্দের উৎস কী? ছন্দের উৎপত্তিস্থল হল শ্বাস। শ্বাসপ্রশ্বাসের যে গতি, সেখানেই জন্ম নেয় ছন্দের ক্রিয়া। বাইরের দিক থেকে ছন্দের নিয়মকানুন জেনে রচিত নির্ভুল ছন্দপ্রয়োগ অনেকই দেখা যায়। অভীকের কবিতা পাঠকের শ্বাসপ্রশ্বাসের উপর চাপ দিয়ে পাঠককে কখনও শ্বাস আটকে রাখতে, কখনও শ্বাস ফেলতে বাধ্য করে। এর ফলে কবিতায় এক গোপন শ্রুতিসৌন্দর্য জন্ম নেয় ও কবিতাটির গতিবেগ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। বাইরের ছন্দকৌশল ও মিলজ্ঞাপনের চমৎকৃতির দিকে অভীক নিয়ে যান না তাঁর কবিতাকে।

এই শ্বাসনিয়ন্ত্রণের খেলাটি অভীক তৈরি করেন তাঁর কবিতার লাইন-সংস্থাপনের উচ্চাবচতায়। ভাঙা ভাঙা পঙ্‌ক্তিরই এখানে প্রাধান্য। পাঠক তখনও মাত্রা পূর্ণ হবে ভেবে অপেক্ষা করছেন। হঠাৎই অভীক, তাঁর লাইনকে ভেঙে নীচে নিয়ে এলেন— শ্বাস পূর্ণ হল না পাঠকের। পরবর্তী লাইনের শেষে পৌঁছে তবেই পাঠক তাঁর শ্বাস ছাড়তে পারলেন।

ছন্দ কোথা থেকে আসে? বিষয়বস্তুর জরায়ু থেকে। প্রত্যেকটি ভাঙা লাইনের শেষে অভীক এক সাসপেন্স রেখে দেন— বিষয়-নির্ভর সাসপেন্স— যা পাঠককে পরবর্তী লাইনের জন্য উদ্‌গ্রীব করে তোলে। পাঠকের সঙ্গে চলে ছন্দের দম নেওয়ার খেলা। গায়ক যেমন এক দিকে দম-কে তাঁর শিল্পের অন্যতম প্রধান পদ্ধতি হিসেবে আয়ত্ত করেন, তেমনই তালবাদ্যের সঙ্গে সময়মতো ‘সম’-এ পৌঁছনোর পরীক্ষাও দিয়ে চলতে হয় তাঁকে, গাইবার সময়ে। বিলম্বিত্‌ একতালে খেয়াল চলেছে। রাগবিস্তারের মধ্যে ডুবেও গায়ক কিন্তু সচেতন, প্রথম তেরে-কেটে চলে গেছে, দ্বিতীয় তেরে-কেটে চলে গেল— আসছে ‘সম’। এইখানেই সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় তালের ক্ষেত্রে। পাউন্ডের উক্তি যথার্থ: ‘ওয়ার্ডস কাট ইনটু টাইম’। গায়ককে যেমন শ্বাস ও সময়ের ভারসাম্য জানতে হয়, অভীকের কবিতা পড়ার সময় আমাদের তেমনই শ্বাস-সময়ের সঙ্কোচন-প্রসারণকে পেতে হয় পাঠ-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। বাংলা ছন্দের তিনটি বিভাগেই এই সূক্ষ্ম পরীক্ষা দ্বারা নতুন এক পাঠরীতির উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন অভীক, যা প্রথানুগ বহুবিধ ‘মিলকাঠামো’ ও স্তবকবিন্যাসে পারদর্শী কবিদের চেয়ে ভিন্ন ছন্দ-স্বর যোজনা করেছে সাম্প্রতিক কবিতাধারায়। ফলে কেবল বাইরের দিক থেকে ছন্দের আইন-জানা কবিদের কাছে তিনি পেয়েছেন বিমুখতা। তেমন কোনও স্বীকৃতি পাননি, পুরস্কার তো নয়-ই।

যাঁরা ইতিমধ্যেই সুপ্রতিষ্ঠিত, পুরস্কারজয়ী, সর্বজনমান্য কবি— তাঁদের চর্চার বাইরেও যে গূঢ় কাব্যশিল্পের সাধনা চলেছে কোথাও, সে কথা জানানোর দায়িত্ব বোধ করেই অভীক মজুমদার বিষয়ে বললাম উপরোক্ত কথাগুলি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement