প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রেশ কাটার আগেই পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সেই ঘটনাবলি এমন ভাবেই দুনিয়া কাঁপিয়েছিল, যে তখনকার সবচেয়ে ধনী ও শিক্ষিত দেশ ব্রিটেনও তার অভিঘাত এড়াতে পারেনি। বরং রাশিয়ার বাইরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিজ়ম প্রচারের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ১৯২০ সালের ৩১ জুলাই নানা ধরনের সোশ্যালিস্টরা মিলেমিশে গিয়ে তৈরি করেন কমিউনিস্ট পার্টি অব গ্রেট ব্রিটেন। এই যুবকেরা কী বলেছিলেন? যুদ্ধকে কাজে লাগিয়ে যারা ফুলে-ফেঁপে উঠছে, তাদের হাতে আর দেশ শাসনের ভার দেওয়া যাবে না। চাই ব্যবস্থার অবসান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয় ধরে ঐতিহ্যে, আদর্শে, কর্মধারায়, বিশ্বাসে। ১৯৯১ সালের অগস্টে ভেঙে যায় কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য সোভিয়েট ইউনিয়ন। সে বছরের ২৩ নভেম্বর দু’দলে ভেঙে যান ব্রিটিশ কমিউনিস্টরাও। উত্থান-পতনের গোটা সময়টা দু’মলাটে ধরেছেন ইতিহাসবিদ ও সাংবাদিক ফ্রান্সিস বেকেট (ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান ও পতন, কমলিনী, ৩৫০.০০)। গল্পের মতো করে সেই ইতিহাস উপস্থাপন করেছেন। ‘পুরনো ভাবনার পরিবর্তন’ এবং ‘নব্য বাম’ অধ্যায়ে লেখক তুলে ধরেছেন বামপন্থার অভিযাত্রা। শতাব্দীর শেষে তাদের নিয়ে মানুষের মনে দানা বেঁধেছে অবিশ্বাস। বেদনাহত সময়েও অবশ্য আশা নিয়েই শেষ হয় এই বই। ‘‘মানুষ চলে যায়, লক্ষ্যে পৌঁছাতে বার বার ব্যর্থ হয়, তবু সমষ্টির স্বপ্ন মরে না, সে চিরকাল জেগে থাকে!’’ কোথাও কোথাও ভাষার আড়ষ্টতা বাদ দিলে শ্যামল সেনগুপ্তের বাংলা অনুবাদ প্রাঞ্জল ও সুখপাঠ্য।
আমাদের জনজাতীয় গোষ্ঠীগুলির মধ্যে খাড়িয়া, শবর, লোধা শব্দবন্ধ বহু ক্ষেত্রেই একে অন্যের পরিবর্ত হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এ ক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত জনগোষ্ঠীর ঠিক তথ্য-পরিসংখ্যানে, উন্নয়নমূলক প্রয়াস ও চর্চার দিক নির্দেশে নানা ব্যাঘাত ঘটে। সার্বিক অনুন্নয়ন, দারিদ্র নিত্যসঙ্গী হয়েও তাঁদের নিজস্ব সমাজ-সংস্কৃতি নানা বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। এখানেই জনজাতির জীবনের অন্যতম নিজস্বতা। পাহাড়ি খাড়িয়া (শ্রীলিপি, ২৫০.০০)-য় পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও বর্তমান ঝাড়গ্রাম জেলার ভৌগোলিক অবস্থানে সুনির্দিষ্ট ভাবে পাহাড়ি খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর বাসস্থান, পোশাক-পরিচ্ছদ, পরিবার, সামাজিক সংগঠন, অর্থনৈতিক অবস্থা, আচার-বিশ্বাস-সংস্কার, পুজো-পার্বণ-উৎসব ইত্যাদি নানা প্রেক্ষাপটে গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন লেখিকা ছন্দা ঘোষাল। এ রাজ্যের জেলা ও গ্রামভিত্তিক জনসংখ্যার তথ্য আছে। বৃহৎ পরিসরে বিস্তারিত বর্ণনা না হলেও, কাজটিতে সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ যেমন আছে, তেমনই অনুন্নয়নের নানা কার্যকারণের ইঙ্গিত দিয়েছেন লেখিকা। এই মূল্যায়ন সমাজবোধেরও পরিচয়। তবে গবেষণার মোড়কে এই কাজের সংক্ষিপ্ত খতিয়ানে খুব বেশি ইংরেজি উদ্ধৃতি— যা নিয়ন্ত্রণ করলে বর্ণনা আরও আকর্ষণীয় হতে পারত। তবে ভারতীয় নৃবিজ্ঞান সর্বেক্ষণের প্রকাশনার ‘দ্য সিডিউলড ট্রাইবস’-এর প্রায় ৫০০টি জনজাতীয় জনগোষ্ঠীর বর্ণনাতে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর আলোচনার তথ্য উল্লেখ জরুরি ছিল।
সীমান্ত বাংলার ভৌগোলিক চৌহদ্দি দেশ বা প্রাদেশিক জনজীবনের সাংস্কৃতিক সংযোগ-সম্পর্কের নানা বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ। সুবর্ণরেখা নদী সংলগ্ন ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এলাকা সহ ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডের বৃহত্তর চৌহদ্দি সম্পৃক্ত। এই আঞ্চলিক জনজীবন ও সংস্কৃতিতে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও রীতির উপাদান প্রাচীনত্বের নিরিখে বিকাশ লাভ করেছে। দাঁতন অঞ্চলে মোগলমারি প্রত্নক্ষেত্রের ইতিহাস এই অঞ্চলের বহমান সংস্কৃতিরই ঐতিহ্যরূপ। সুবর্ণরেখা অববাহিকায় লোকায়ত সংস্কৃতি (পুস্তক বিপণি, ২৫০.০০)-র লেখক বঙ্কিমচন্দ্র মাইতি সুদীর্ঘ কাল যাবৎ এই পুরাবৃত্ত অন্বেষী আঞ্চলিক ইতিহাস সংস্কৃতিকে ক্ষেত্রসমীক্ষালব্ধ অনুশীলন করেছেন। তাই নদীকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে বিস্তারী লোকজীবন ও সমাজের দৈনন্দিনতায় লোকাচার, পার্বণ, লোকদেবতা, লোকশিল্প, মন্ত্রতন্ত্র, লোকচিকিৎসা, ছড়া ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন লেখায় প্রকাশ করেছেন। ধানের সঙ্গে পরব মিশে আছে, লোকাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত কত গাছপালা। কৃষিসংস্কৃতির আবহমানের রূপবৈশিষ্ট্যে এই আঞ্চলিক তথ্যসূত্র বাংলার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অন্যতম দিক। নদী অববাহিকার এই সার্বিক পটভূমি যে সীমান্ত অঞ্চলের মিশ্র সংস্কৃতির প্রতিফলন, সে প্রসঙ্গ উল্লেখে প্রাককথনে সূর্য নন্দী সঙ্কলিত লেখাগুলির গুরুত্ব প্রকাশ করেছেন। জনজাতীয় গোষ্ঠীর নিজস্বতার সঙ্গে সুবর্ণরেখা নদীর উচ্চ অববাহিকা, মধ্য অববাহিকা ও নিম্ন অববাহিকার সাংস্কৃতিক রীতি-উপাদানের তারতম্য নির্দেশে চর্চার স্বকীয়তা প্রকাশিত।
গান যাঁরা বাঁধেন বা সুর দেন, সেই বাঙালি গীতিকার-সুরকারদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন উভয় ক্ষেত্রে সমান দক্ষ, সেই স্বাধীনতা-পূর্ব সময় প্রায় গত শতকের শেষ দশক পর্যন্ত। তবু ঘরে ফেরা ঝড়ের পাখি (দে’জ, ২৫০.০০) বইয়ের লেখক প্রিয়দর্শী চক্রবর্তী সলিল চৌধুরীকেই (১৯২২-’৯৫) তাঁর বিষয় হিসেবে যে বেছে নিয়েছেন, তার কারণ একাধিক। প্রথমত তাঁর গানের কথা ও সুর আঙ্গিকের দিক থেকে সময়ের ঘেরাটোপকে পেরিয়ে গিয়েছে। অনস্বীকার্য যে তাঁর সঙ্গীতসৃষ্টির উৎসমুখ নিহিত ছিল নির্দিষ্ট একটি সময়পর্বে, তবু তাঁর সে সৃজন পৌঁছে গিয়েছে প্রজন্মান্তরে, নতুন শতকেও। সত্যিই সলিল এমনই এক শিল্পপ্রতিভা— ‘‘রবীন্দ্রোত্তর যুগে তেমন দৃষ্টান্ত খুব বেশি মেলে না।’’ শুরুতেই মন্তব্য করেছেন প্রিয়দর্শী। দ্বিতীয়ত বহুশ্রুত বা তথ্যাশ্রিত ঐতিহাসিক ঘটনাদিকে এমন অভিনব মেলোডি আর আশ্চর্য লিরিকস-এর মেলবন্ধনে শ্রোতার কানে তুলে দিতে পারতেন সলিল যা তাঁর শুধু সমকালেই নয় পরবর্তী কালেও বিরল। তৃতীয়ত সমাজের একেবারে নিচুতলা থেকে উঁচুতলার বিভিন্ন স্তর বা শ্রেণির মানুষের অব্যক্ত বেদনা আর আর্তি ভাষা ও সুর পেয়েছে তাঁর গানে। সলিলের শিল্পীজীবনকে কেন্দ্রে রেখে ১৯৪০-৯০ অবধি এক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বিবর্তনজনিত রূপরেখা ইতিহাসনিষ্ঠ ভঙ্গিতে পাঠকের মননে বুনে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক। গণনাট্যের গান, বম্বের হিন্দি ফিল্মের গান, বাংলা ছবির গান, এবং বাংলা আধুনিক গান— কোনও পর্বই বাদ পড়েনি। প্রাক্কথনে অবশ্য প্রিয়দর্শী ব্যক্তিগত অভিঘাতের কথা জানাতে ভোলেননি: ‘‘সলিল চৌধুরী, যাঁর গান আমার বেড়ে ওঠার ছন্দে মিলেমিশে একাকার গত চার দশক জুড়ে।’’
২৮৪ পাতার সাক্ষাৎকার সংগ্রহ/ সুবোধ সরকার প্রকাশ করেছে কলিকাতা লেটারপ্রেস (৪০০.০০)। এটি এদের এই সিরিজের দ্বিতীয় গ্রন্থ। ‘দেশ’ পত্রিকা, ‘বইয়ের দেশ’-সহ গোটা ১৫-১৬টি জায়গায় দেওয়া সুবোধ সরকারের সাক্ষাৎকারের সংগ্রহ। এ বইয়ের কথামুখ লিখেছেন বিশিষ্ট গদ্যকার-অধ্যাপক চিন্ময় গুহ। প্রথমেই তিনি বইটির ‘নাড়া’ বেঁধে দিয়েছেন, লিখছেন ‘‘কবির সঙ্গে সংলাপের মতো সুন্দর আর কিছু হতে পারে কি? আমি অনেক সময় মনে মনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলি, অথবা জীবনানন্দ, পল এল্যুয়ার বা মিরোস্লাভ হোলুবের সঙ্গে।’’ এ গ্রন্থের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নিকানোর পাররা যেমন আছেন, তেমনই আছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী-ও। ১৯৯ পৃষ্ঠায় সুবোধ জানাচ্ছেন, ‘‘কবিতা সত্যবদ্ধ কিনা সেটা ঠিক করার দায়িত্ব কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিকে দেওয়া হয়নি। কবিতায় যদি সত্য না থাকে তা হলে আমাদের জীবনে কোনো সত্য নেই।’’ এর পরের প্রশ্নের উত্তরেই বলছেন ‘‘সুনীলদাকে আমার নাস্তিক রামকৃষ্ণ মনে হত। আমি সেই রামকৃষ্ণের শিষ্য ছিলাম।’’ ২২৩ পৃষ্ঠায় সুবোধ নস্টালজিক। আমাদের জানাচ্ছেন, ‘‘আমি যখন কৃষ্ণনগরের রাস্তায় সাইকেল চালাতাম, আবার রিকশো চড়ে জলঙ্গীর দিকে যেতাম, আমার সঙ্গে থাকতেন একজন ধুতিপরা মানুষ, তাঁর নাম সুধীর চক্রবর্তী... ।’’ সুবোধ তাঁর দিকে ধেয়ে আসা যাবতীয় ফার্স্ট-স্পিনের উত্তরে পাঠককে জানান, এখন যদি কেউ অয়দিপাউস লিখতে চান তবে তাঁর হাতে টমাস মান বা অলবের কামু-র মতো লিখন-ক্ষমতা দরকার, যা কিনা বহু প্রাচীন পৃথিবীতে সফোক্লিসের ছিল। এ বইয়ের একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টে যেতে যেতে অকস্মাৎই ‘নায়ক’ সিনেমায় ট্রেনের প্যানট্রিকারে মুখোমুখি উত্তম-শর্মিলার কথোপকথন মনে পড়ে। সাক্ষাৎকারের সময় বিশেষ করে একজন কবি অকপট থাকবেন— এটাই কাম্য। বাকিটা পাঠক আত্মস্থ করবেন। এ গ্রন্থ সুমুদ্রিত ও প্রায় ভুল বানান-বিহীন। কিংশুক মণ্ডলের সম্পাদনা চমৎকার।