বলা যায়
অমর্ত্য সেন
৪০০.০০
আনন্দ পাবলিশার্স
‘‘আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, আমি এতকাল ধরে একই কথা বারবার বলি কেন। আমার উত্তর হল, সমস্যাটা এতকাল ধরে এক থেকে গেলে আমার কথাটাই বা পাল্টায় কী করে!’’ বক্তার নাম অমর্ত্য সেন। যে ‘একই কথা’ তিনি ‘বারবার’ বলে চলেন, সেগুলোর সূত্র স্বভাবতই তাঁর অ্যাকাডেমিক গবেষণায় নিহিত। কিন্তু, অন্য বহু বিদ্যাজীবীর সঙ্গে তাঁর ফারাক, নিজের মেধাচর্চাকে তিনি গজদন্তমিনারে আটকে রাখেননি— সর্বজনবোধ্য বই লিখেছেন অজস্র, এবং তার চেয়েও সহজে যা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়, সংবাদপত্রে তেমন সাক্ষাৎকার দিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। ‘বলা যায়’ বইটিতে তেমনই অনেকগুলি সাক্ষাৎকার, দু’টি বক্তৃতার লিখিত রূপ, এবং উল্লেখযোগ্য ভাবে, সমকালের পাঁচ নাগরিকের প্রশ্নের উত্তর সঙ্কলিত হয়েছে।
অমর্ত্য সেন যে কথাগুলি বিভিন্ন প্রসঙ্গে, বিভিন্ন পরিসরে বলে এসেছেন অক্লান্ত ভাবে, তার মধ্যে সবচেয়ে জরুরি কথাটা সম্ভবত মানুষের ‘স্বক্ষমতা’ নির্মাণের। ইংরেজি ‘ফ্রিডম’ শব্দটিকে তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন ‘স্বক্ষমতা’— অর্থাৎ, জীবনের সম্ভাবনাগুলিকে সম্পূর্ণ ভাবে ব্যবহার করতে পারার মতো সক্ষম হয়ে ওঠা। কী ভাবে সেই ‘স্বক্ষমতা’-য় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নাগরিককে, তা নিয়ে এই বইয়েও অনেক আলোচনা আছে। একটা উদাহরণ দিলে বোঝা সম্ভব, তাঁর মন কোন পথে চলে: ‘ভারতে প্রায় অর্ধেক লোকের জন্য শৌচাগার নেই। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, সামর্থ্য নেই। কিন্তু এর সঙ্গে যোগ করতে হবে পরিকল্পনার ত্রুটি... বড় বড় শহরে, যেমন দিল্লি বা গুড়গাঁওয়ে, বহু বাড়ি তৈরি হচ্ছে যেখানে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার্স আছে, কিন্তু গৃহকর্মীদের শৌচাগারের অত্যন্ত অভাব।’ দুরূহ তত্ত্বের আলোচনার পাশাপাশি যে এই আপাত-তুচ্ছ জিনিসকেও দেখতে ভোলেন না অধ্যাপক সেন, এখানেই তাঁর বৈশিষ্ট্য।
আর একটা বিশ্বাসের কথা প্রায়শ বলেন অমর্ত্য— গণতন্ত্র, গ্রহণশীলতা, বহুত্বের আবশ্যকতার কথা। নিজের রাজনৈতিক অবস্থান প্রকাশ করতে নির্দ্বিধ তিনি। হিন্দুত্ববাদীদের অন্যায় আক্রমণও তাঁকে থামাতে পারে না। বাংলা ভাষায় ‘জয় শ্রীরাম’ শব্দবন্ধ যোগ করা প্রসঙ্গে এই বইয়ে সঙ্কলিত একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘প্রশ্নটা হচ্ছে এই যে, কী কারণে এবং কী উদ্দেশ্য নিয়ে এই পরিবর্তনটা করা হচ্ছে, এবং সেই পরিবর্তনের ফলে লোকে যদি মার খায়, আহত হয়, মারা যায়, তা হলে আমাদের আপত্তি করার কারণ আছে কি না। আমার ধারণা, খুবই আছে।’ এই আপত্তি করার জন্য যদি একই কথা বার বার বলতে হয়, সেটা বলাই বিধেয়, তাই না?
বারোমাস নির্বাচিত সংকলন ১
সম্পাদক: পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও রুশতী সেন
৬৫০.০০
দে’জ পাবলিশিং
বারোমাস পত্রিকার (১৯৭৮-২০১৫) মাসিক পর্ব (১৯৭৮-’৮৩) এবং ষাণ্মাসিক পর্ব (১৯৮৪-’৯৮) থেকে নির্বাচিত সমাজ-রাজনীতি-ইতিহাস সংক্রান্ত প্রবন্ধাদি নিয়েই সঙ্কলনের প্রথম খণ্ডটি। এই বাছাইয়ের মধ্যে ‘সাময়িক প্রসঙ্গ’ ও ‘গ্রামগঞ্জ’ শিরোনামে যে বিভাগগুলি মাসিক পর্বে ছিল তা থেকেও রচনা রাখা হয়েছে। যেমন ‘সাময়িক প্রসঙ্গ’ বিভাগে ১৯৭৯-তে শঙ্খ ঘোষ রচিত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রয়াণলেখ: ‘‘আর্জেন্টিনার এই লেখিকার সঙ্গে আমাদের জানাশোনা কেবল রাবীন্দ্রিক সূত্রে। রবীন্দ্রনাথ একদিন তাঁর আরোগ্যের আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন এই নারীর কাছে... হয়তো ভিক্টোরিয়ার কাছেও তাঁর বিশেষ এই পরিচয়টির বড়ো একটা তাৎপর্য ছিল... শেষ মুহূর্তে যে উইল তৈরি করলেন তিনি, সেখানেও রবীন্দ্রনাথেরই এক নিভৃত আসন।’’ ওই বিভাগেই ১৯৭৮-এ একটি রচনায় ‘গ্রাম, শহর ও মহানগর’-এর অর্থনীতি নিয়ে মন্তব্য করলেন ভবতোষ দত্ত: ‘‘গ্রামের উন্নতি আর শহরের উন্নতি একসঙ্গে পরীক্ষা করে পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে না। গ্রাম না বাঁচলে যে শহর বাঁচবে না...’’। যে দু’টি দশক প্রেক্ষিত হিসেবে উঠে এল এ-সঙ্কলনে, তাতে দুনিয়া জুড়ে সমাজ-রাজনীতির কত-না ওলটপালট... কংগ্রেসের দীর্ঘকালীন শাসনের অবসানে বামপন্থীদের পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাদখল, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট রাশিয়ার পতন, ভারতে উদার অর্থনীতির প্রসার... প্রচ্ছন্ন হলেও ক্রমাগত বদলে যাওয়া সময়ের চিহ্ন প্রবন্ধগুলিতে। পড়তে-পড়তে সমাজ-রাজনীতির এক অনুপুঙ্খ ইতিহাসের আভাস যেন আদল পেতে থাকে পাঠকের মনে। মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা, অসম পরিস্থিতি, কলকাতা-হলদিয়া বন্দর ও ফরাক্কা প্রকল্প, আদিবাসী শ্রমিক নির্যাতন, চটকলের স্মৃতি, মরিচঝাঁপি, আফগানিস্তান, নারীমুক্তির ধারা, জোসেফ স্ট্যালিনের শতবার্ষিকী, পুঁজি ও রাষ্ট্র, পঞ্চাশের মন্বন্তর— এমন বিবিধ বিষয় তথ্যে-তত্ত্বে-সমীক্ষায় এক বৈচিত্রের অভিনিবেশ গড়ে তুলেছে সঙ্কলনটিতে। আছে সরোজকুমার চক্রবর্তীর ‘রাইটার্স’, যেখানে সঙ্কলিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বের নানা অপ্রকাশিত কাহিনি ও চিঠিপত্র। আর আছে রাজনৈতিক ব্যঙ্গ সংবলিত ‘সম্পাদকীয় (ছড়া)’। কপিল ভট্টাচার্য সুশোভন সরকার বরুণ দে মণিকুন্তলা সেন শিপ্রা সরকার হিতেশরঞ্জন সান্যাল নিরঞ্জন সেনগুপ্ত সুবীর রায়চৌধুরী গৌতম ভদ্র তনিকা সরকার সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় রণবীর সমাদ্দার কল্যাণ সান্যাল দীপেশ চক্রবর্তী প্রমুখের সঙ্গে আছে প্রয়াত সম্পাদক অশোক সেনের লেখাও। ছাপা হয়েছে বিভিন্ন সংখ্যায় রামকিঙ্কর সোমনাথ হোর পরিতোষ সেন গণেশ পাইন ও সত্যজিৎ রায়-কৃত প্রচ্ছদ। সম্পাদক থেকে লেখক কেউই যে হেতু সমমতাবলম্বী ছিলেন না, তাই ‘বিতর্ক আস্বাদনের সুযোগ করে দেওয়া’ এ-গ্রন্থের অন্যতম অভিপ্রায়।
সাময়িকপত্রে বঙ্গদেশচর্চা/ জেলাভিত্তিক রচনাপঞ্জি
অশোক উপাধ্যায়
৬৫০.০০
সাহিত্যলোক
৪৫ বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের রচনাপঞ্জি সঙ্কলন করছেন অশোক উপাধ্যায়। আলোচ্য বইটির পরিশিষ্টে তাঁর সঙ্কলিত রচনাপঞ্জির তালিকা দেখলেই বোঝা যায়, কী বিপুল পরিশ্রমসাধ্য এই কাজ। বর্তমান সঙ্কলনে রয়েছে অবিভক্ত বঙ্গদেশের ২৭টি জেলার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাদে ২৬টি, এবং স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গে সংযুক্ত কোচবিহার ও পুরুলিয়া (মানভূম)— এবং তৎকালীন অসমের শ্রীহট্ট জেলা। পরিশিষ্টে সংযোজিত হয়েছে ত্রিপুরা প্রসঙ্গ। বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চায় পেশাদার ইতিহাসবিদদের পাশাপাশি অপেশাদারদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বঙ্কিমচন্দ্রের আহ্বানে জেলায় জেলায় ইতিহাস রচনার যে পরম্পরা তৈরি হয়, তার প্রায় পুরোটাই এই অপেশাদার ইতিহাসবিদদের দান। যে বিপুল তথ্যভাণ্ডার তাঁরা সঙ্কলন করে দিয়েছেন, তার পুরোপুরি ব্যবহার পেশাদার ইতিহাসবিদেরা আজও করে উঠতে পারেননি। জেলার ইতিহাসের বইগুলি তবু অনেক পুনর্মুদ্রিত হয়েছে, গ্রন্থাগারেও তাদের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা জেলার ইতিহাস ভূগোল প্রত্নতত্ত্ব লোকসংস্কৃতি আচার অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠান বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে রচনাসম্ভার কোথায় মিলবে? জেলা ধরে ধরে এই বইয়ে রয়েছে সেই সব লেখার হদিস। অবিভক্ত বঙ্গদেশের ইতিহাস অনুসন্ধিৎসুর কাছে এই বই অমূল্য আকর বললে অত্যুক্তি হয় না।
যোগাযোগ/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সম্পাদক: বিশ্বজিৎ রায়
৭০০.০০
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ
‘শেকসপিয়রের নানা রচনার নানাবিধ ছাত্রপাঠ্য সংস্করণ চোখে পড়ে, রবীন্দ্র-রচনার ক্ষেত্রে তেমন সংস্করণ চোখে পড়ে না’ বলে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ উপন্যাসের সুমুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশ পেয়েছে। ভূমিকা ও টীকা রচনার দায়িত্ব বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের শিক্ষক বিশ্বজিৎ রায়ের। সু-সম্পাদিত এ গ্রন্থের প্রচ্ছদে ১৯৩৫-৩৬-এ আঁকা রবীন্দ্রনাথের বিষাদপ্রতিমা এক নারীমূর্তির ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। পৃষ্ঠ-প্রচ্ছদে রয়েছে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় প্রকাশিত সৌরেন সেনের আঁকা ‘তৃপ্তি’ (বৈশাখ ১৩৪৩) ছবিটি। যোগাযোগ উপন্যাসে সন্তান-সম্ভবা কুমুকে সন্তানের কথা ভেবেই স্বামীগৃহে ফিরতে হয়েছিল। তবে এমন কিছু আছে যা ছেলের জন্যেও খোয়ানো যায় না এই বোধ জেগে উঠেছিল তার মনে। ভবিষ্যতে সে মধুসূদনের ঘর থেকে ফিরে আসবে এ তারই ইশারা। রবীন্দ্রনাথের ‘মিলনের সৃষ্টি’ সূচক লেখা হিসেবে বিচিত্রার ১৩৩৫ চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত। ওই সংখ্যাতেই ‘যোগাযোগ’ শেষ হচ্ছে। ‘সূচনা কথা : কুমুদিনীর গান’ নামের দীর্ঘ নিবন্ধটিতে বিশ্বজিৎ খেয়াল করেছেন ‘মিলনের সৃষ্টি’ লেখাটিতে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ না-করে জানিয়েছেন কেন মধুসূদন-কুমুর দাম্পত্য সন্তান উৎপাদনের পরেও ব্যর্থ। ‘‘সেই সত্য মিলন যেখানেই হয় সেখানে অঙ্কশাস্ত্রের যোগ বা গুণের ফল ফলে না... সেখানে একটি অনির্বচনীয়তার উদ্ভব হয়, সৃজন-রহস্য দেখা দেয়।’’ এই অনির্বচনীয়তা মধুসূদন-কুমুর দাম্পত্যে দেখা দেয়নি— তা সন্তান উৎপাদনের কলে রূপান্তরিত। অন্য দিকে সৌরেন সেনের আঁকা কিন্তু রাবীন্দ্রিক সৃজন-রহস্যের চিত্ররূপ। বিশ্বজিৎ উপন্যাসের শেষে নির্বাচিত শব্দের ‘ধরতাই টীকা’ যোগ করেছেন। তা অযথা গুগুলবৎ নয়, সাহিত্যরসিকের মনোগ্রাহী। যেমন ‘দিঙ্নাগের স্থূলহস্তাবলেপ’-এর টীকা দিতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন এই দিঙ্নাগের মধ্যে আছে কালিদাস-প্রতিপক্ষ দিঙ্নাগাচার্যের ইশারা। কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ পড়ে কুমু জেনেছিল স্ত্রী স্বামীর সখা-সচিব হতে পারেন কিন্তু দাসী নন। অথচ কালিদাস-অবোধ মধুসূদন তো কুমুকে দাসীই ভাবে— দিঙ্নাগের মতোই কালিদাসের প্রতিপক্ষ সে। উপন্যাস ছাড়াও এই সংস্করণের পরিশিষ্টে রয়েছে নাটক ‘যোগাযোগ’। সঙ্কলিত হয়েছে বিচিত্রা-র পৃষ্ঠায় ‘নারী’ ও ‘সাহিত্যে-বাস্তবতা’ বিষয়ক ছ’টি রচনা। বিবাহ-বিচ্ছেদ বিষয়ক তৎকালীন বিতর্কের প্রায় সব ক’টি বয়ান স-তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। এ দিক থেকে সংস্করণটি রবীন্দ্র-রচনাকে সমকালের প্রেক্ষিতে বুঝতে সাহায্য করবে। এ বই রবীন্দ্র-রসিকদের নিঃসন্দেহে সংগ্রহযোগ্য।