স্বতন্ত্র বয়ান অন্য আকর্ষণ তৈরি করে

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যসাহিত্যের ‘প্রথম যথার্থ শিল্পী’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:২৯
Share:

এতদিনে পাওয়া গেল রিদয়ের সুলুকসন্ধান! অবনীন্দ্রনাথের ‘বুড়ো আংলা’ গল্পে সুবচনীর খোঁড়া হাঁসের পিঠে চেপে দূরান্তে পাড়ি জমিয়েছিল যে ছেলে। তা, সুবচনীর হাঁসটি খোঁড়া কেন? এ প্রশ্নের উত্তর অনেকেরই জানা নেই। এক গরিব ব্রাহ্মণীর ছেলে পাঠশালা থেকে ফিরে আব্দার ধরলে, সে মাংস খাবে। কিন্তু সামর্থ্য কোথায়? ছেলেটি রাজার হাঁসশাল থেকে এক খোঁড়া হাঁস চুরি করে তার মাংস খেল। অতঃপর কয়েদখানা। সুবচনী রাতে রাজাকে স্বপ্নে জানালেন, খোঁড়া হাস খেয়েছে বলে যাকে বন্দি করেছ, সে আমার ব্রতদাস। ওকে মুক্তি দিয়ে কাল সকালেই তোমার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দাও। অনেকটা চণ্ডীমঙ্গলে শ্রীমন্তর কারামুক্তির মতো, না? আসলে সুবচনী তো শুভচণ্ডীর রূপান্তর। দেবীর ব্রতে তাই দু’জোড়া সুস্থ হাঁসের পাশাপাশি দু’জোড়া খোঁড়া হাঁস আঁকতে হয়। দেবাশিস ভৌমিক তাঁর প্রায় ৪৫০ পৃষ্ঠার বাংলার দেবদেবী ও পূজাপার্বণ (পুনশ্চ, ৩০০.০০) বইয়ে এ ভাবেই বুনে দিয়েছেন বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন চেনা-অচেনা কাহিনি। সিউড়ির নগরী গ্রামে এক সময় মাঘ মাসের প্রথম দিনে ব্রহ্মদৈত্যের পুজো হত। ব্রহ্মার মন্দির শুধু কি রাজস্থানের পুষ্করে? শান্তিপুরে আজও বৈশাখী পূর্ণিমায় ব্রহ্মার পুজো হয়, গরুর গাড়িতে একটা ঢেঁকিকে তুলে নারদবেশে একজন সারা শহরে ঘুরে বেড়ায়। পুরাণের বিভিন্ন কাহিনী, ব্রতপালনের লোককথা ও ক্ষেত্রসমীক্ষা নিয়ে বইটি রসিক পাঠকের আগ্রহ জাগায়।

Advertisement

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যসাহিত্যের ‘প্রথম যথার্থ শিল্পী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র-সহ সে সময়ের বিশিষ্ট গদ্যকারেরা। আর ছিল তত্ত্ববোধিনী বিবিধার্থসংগ্রহ বঙ্গদর্শন ভারতী সবুজ পত্র-এর মতো সাময়িক পত্রগুলি। এ ভাবেই কর্ষিত গদ্যসাহিত্যের ভূমি ক্রমপ্রসারিত হয়েছে। কালে-কালে প্রবন্ধ, সমালোচনা, জীবনচরিত, আত্মচরিত, রম্যরচনা, ভ্রমণবৃত্তান্ত, বা এমন নানা কিছু গদ্যসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে জন্মানো গদ্যশিল্পীদের নিয়ে ক্রমপর্যায়ে ‘এবং মুশায়েরা’-র (সম্পা: সুবল সামন্ত) দু’টি সংখ্যা আগেই প্রকাশিত হয়েছিল, সম্প্রতি প্রকাশ পেল তৃতীয় ‘গদ্যকার সংখ্যা’টি। এতে ঠাঁই পেয়েছে সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত সৈয়দ মুজতবা আলী আশুতোষ ভট্টাচার্য লোকনাথ ভট্টাচার্য প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য সুরজিৎ দাশগুপ্ত নবনীতা দেবসেন শেফালী মৈত্র পবিত্র সরকার দেবেশ রায় পার্থ চট্টোপাধ্যায় শোভনলাল দত্তগুপ্ত অভ্র ঘোষ দীপেন্দু চক্রবর্তী সুমিতা চক্রবর্তী রুশতী সেন প্রমুখ বিবিধ পরিসরের স্বভাবত-স্বতন্ত্র গদ্যলেখকদের নিয়ে মননশীল রচনা, জীবন ও গ্রন্থপঞ্জি।

‘সাহিত্য-সন্ন্যাসী’ কেদারনাথ মজুমদার ময়মনসিংহের কিংবদন্তি-প্রতিম লেখক ও সম্পাদক। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘সৌরভ’ পত্রিকা ছিল ‘ময়মনসিংহ জেলার সাহিত্যিকদের বিশ্ববিদ্যালয়’। তাঁর বিপুল পরিশ্রমের নিদর্শন ‘রামায়ণের সমাজ’ গ্রন্থটির দুটি খণ্ড। রামায়ণ-চর্চায় আধুনিক নির্মোহ মননের দৃষ্টান্ত-স্বরূপ এই আকর গ্রন্থটিতে এক শতাব্দী আগে কেদারনাথ রামায়ণ-সম্বন্ধে এমন কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন যা আজকের এই রামউন্মত্ত যুগে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। এর ভূমিকায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছিলেন: “…রামায়ণঘটিত জটিল প্রশ্নসমূহ মীমাংসা যে একজনের দ্বারা বা একপুরুষে বা একদেশে হইবে ইহা অসম্ভব।… যিনি যতটুকু আগাইয়া দিতে পারেন ততটুকুই লাভ। মজুমদার মহাশয় কতকদূর আগাইয়া দিয়াছেন।” গ্রন্থের দুটি খণ্ডে মোট উনিশটি অধ্যায়। চিন্তার স্বাধীনতা, ভাবের নিরপেক্ষতা কেদারনাথের রচনার বৈশিষ্ট্য। অবতারবাদ, স্বয়ম্বর প্রথায় বিদেশি যোগ, রামজন্মের পূর্বে রামায়ণ রচনার অলীকতা, উত্তরকাণ্ড আদৌ বাল্মীকির রচনা কিনা, লিঙ্গপূজা নিয়ে বিতর্ক— এসব আলোচনায় লেখকের অপক্ষপাত ও যুক্তিবাদী মানসিকতা বইটিকে ‘মিথ’ করে তোলে। দিলীপ মজুমদার এর আগে কেদারনাথের বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য সম্পাদনা করে পুনঃপ্রকাশ করেছিলেন। তাঁরই পরিশ্রমী সম্পাদনায় রামায়ণ বিষয়ক বইটি রামায়ণ ও তার সমাজ (এডুকেশন ফোরাম, ৪৫০.০০) নামে পুনরায় প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদক যুক্ত করেছেন কেদারনাথের জীবনী ও কর্মপরিচয়ের বিস্তারিত বিবরণ। ছোটখাট ত্রুটি থাকলেও সম্পাদক-গবেষক-সংগঠক কেদারনাথ মজুমদারকে তাঁর সার্ধশতজন্মবর্ষ সূচনার আগেই নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে এই গ্রন্থ।

Advertisement

দশটি কাব্যগ্রন্থ দু’মলাটে, মোট ১৯২ পৃষ্ঠার কবিতা সংগ্রহ (সপ্তর্ষি প্রকাশন, ২০০.০০) চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের। চৈতালী আশির দশকের কবি, তবে মূলত আবহমান বাংলা ভাষার কবি। যাঁর কবিতার মধ্যে এক জনের পাশে দু’জনে যেতে না পারা সরু আঁকাবাঁকা গলি, কোণে কোণে শ্যাওলা ও ছোট ছোট গাছ জন্মানো উঠোন, সিমেন্টের কিংবা মোটা লোহার ডিজ়াইন করা ফ্রেমের ছাদ, চৌবাচ্চায় রাখা রঙিন মাছ, ময়ূর অথবা টিয়ার খাঁচা, একটি নিশ্চিত হওয়া কল যা থেকে জোয়ার এলেই তীব্র ভাবে উঠে আসে গঙ্গা জল। আর এক জন মনস্ক নারীর কণ্ঠস্বর ফুটে ওঠে। ১৯৮৮-তে প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বিজ্ঞাপনের মেয়ে’। তার ৭ নম্বর কবিতাটি এই রকম— ‘‘আঙুল উঁচিয়ে ডাকল সেই মেয়ে, ‘তীরে আছ? আমি যে এখনও ভাসছি জলে।’ ওর হাতে-পায়ে চিকচিক করছে জলবিন্দু, বুক-পর্যন্ত ভীষণ স্রোত। এতক্ষণ ডাঙা ভেবে যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেই মৃত চর আসলে এক ফেনা মাত্র’’। এক জন কবির কণ্ঠস্বর বা লিখনভঙ্গি— যা-ই বলা যাক না কেন, তার পাশাপাশি এক জন নারীর কথনভঙ্গিও আমরা টের পাই। ৬৬ পাতায় ‘আরো একবার তোমাকে দোলন’ কবিতা— ‘কুজ্ঝটিকা বানানের চেয়েও ঘোর কুয়াশায় বসে আছে আমার মেয়ে/ বসে আছে আর অল্প চেয়ে দেখছে, নাচের ভঙ্গিমায় খুব দূর থেকে/ হাওয়া কেটে কেটে ভেসে আসছে গান’। এমনই তো যে কোনও বয়সের মা বা এমনই তো যে কোনও রকমের কবি। ১৪৫ পাতায়— ‘প্রতিটি বাড়ির ছাদ রুদ্ধশ্বাস আজ/ প্রত্যেক চায়ের কাপ গোপন প্রহরা’— ঠিক এ সময়েই মনে হয় চৈতালী যেন কবে কোন সময়ে ‘সত্যদ্রষ্টা’ হয়ে বর্তমান সময়ের জানান দিয়েছিলেন।

বাংলার ধর্মসংস্কৃতিতে মুখোশ নাচ অন্যতম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিষয়। এই সূত্রে নৃত্যছন্দের বহু রূপে বহুবর্ণী মুখোশের উদ্দীপনী ধারা দেখা যায়। আবার ছো নাচ জনমানসের চাহিদায় রূপান্তরিত হয়ে প্রায় ধর্মবিযুক্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু গম্ভীরা, গমীরা, সিংহীছাম, রাবণকাটা নাচ ইত্যাদিতে মুখোশের রীতি বৈশিষ্ট্যের ধর্মীয় বিষয়ে আজও আবহমানের স্পর্শ। মালদহ জেলাকেন্দ্রিক শিবগাজন উপলক্ষে আঞ্চলিক জনসমাজে গম্ভীরার প্রভাব দীর্ঘ কালের। পুজো, আচার-অনুষ্ঠান, মুখোশের কৃৎকৌশল সহ লোকনৃত্যের ধারাবাহী ঐতিহ্য আজও সজীব। গম্ভীরা: দ্য ট্রাডিশনাল মাস্কড ডান্স অব বেঙ্গল-এ (দাশগুপ্ত, ৩০০.০০) গবেষক প্রদ্যোত ঘোষের অভিনিবেশে মালদহের গম্ভীরা ও সংশ্লিষ্ট মুখোশ নাচের চর্চাও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তবে এই সময়ের নিরিখে পুস্তকাকারে প্রকাশিত তথ্য সংশোধনের ঘাটতিতে কিছু অসঙ্গতি থেকে গিয়েছে।

অর্ধশতাব্দী আগে বাংলাদেশের জনপদ ছেড়ে এসে লেখক নারায়ণ পাল এ পার বাংলায় বসতি করেছেন; আর, স্মৃতিমেদুরতার উপলব্ধিতে জনজীবনের ধারাকথা শুনিয়েছেন বাগেরহাটের লোকজীবন ও লোকচর্যা (উত্তরণ প্রকাশনী, ৩০০.০০)। আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার প্রেক্ষাপটেই এই বর্ণনা। বাগেরহাট বাংলাদেশের দক্ষিণ ভাগের জেলা-ভূখণ্ড। বাংলাদেশের নানা এলাকার লোকজীবন চর্চা আজ পরিচিত। এমনই এক আঞ্চলিক জনজীবনের নিত্য দিনের সমাজ-সাংস্কৃতিক দৃশ্যপটের অনুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন লেখক। যে আলোচনায় আছে প্রকৃতি থেকে পশুপাখি, খাওয়াদাওয়া, রাস্তাঘাট, পোশাক, পেশা, ব্যবসা-বাণিজ্য, আচার-অনুষ্ঠান, আমোদ-প্রমোদ ইত্যাদি খুঁটিনাটির তথ্য বিবরণ। লেখক স্মৃতি ও অভিজ্ঞতায় আবিষ্ট, তাই বর্ণনা বহু ক্ষেত্রেই নৈর্ব্যক্তিক হয়নি। মানচিত্র থাকলে ভাল হত। তবে আঞ্চলিক ইতিহাসের পেশাদার অনুসন্ধানীর বয়ানের থেকে স্বতন্ত্র এই বয়ান অন্য এক আকর্ষণ তৈরি করে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement