‘যমকুলি’ শব্দটি আগে কখনও শুনিনি। শব্দটি আমার শোনা হল জয়দেব দত্তের কল্যাণে। বাঁকুড়ার আঞ্চলিক শব্দ এটি। যমকুলহি, বা যমকুলি, অর্থ ছায়াপথ বা নীহারিকা। আকাশের যে তারার পথটি, সেখান দিয়েই যম আসা-যাওয়া করেন, বা যমের দূতেরা, অর্থাৎ যমকুলি দেখা গেলেই গ্রামে মড়ক আসবে বা অন্য কোনও বিপদ— গ্রামীণ বিশ্বাস এটি।
এই বইটির ১৭টি গল্পে ছড়িয়ে আছে জয়দেব দত্তের ভুবন। তির্যক, আশ্চর্য, অদেখা ভুবন এক। গ্রামীণ তো বটেই, কিন্তু ‘গ্রাম’ শব্দটি তো কারও কারও কাছে খুব বিমূর্ত। আমাদের আশৈশবের আঁকার খাতা বা পড়ার পাঠে ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রাম। গ্রাম আবার অনেকের কাছে ‘অন্ধকার’-এর দ্যোতনা বহন করে। সন্ধ্যায় সেথা জ্বলে না প্রদীপ, প্রভাতে পড়ে না ঝাঁট। সেই ইস্কুলে পড়া ‘হাট’ কবিতার ছবি মাথার ভিতরে ভেসে ওঠে আমাদের, যাঁরা শহুরে এবং যে কোনও লেখালিখিকেই সেই শহুরে ছাঁচের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যাঁদের অভ্যাস।
জয়দেব দত্ত— লেখক-পরিচিতি সূত্রে জানা গেল, বাঁকুড়ায় থাকেন, সোনামুখীর নিকটে এক প্রত্যন্ত গ্রামেই থাকেন। তিনি যে হেতু গ্রামের মানুষ, লেখেন সোনামুখী, পাত্রসায়র, রথতলা, মিছরিবাঁধ, করকডাঙা, আমতলা এই সব অঞ্চলের কাহিনি। সেই গ্রাম কোনও বিমূর্ত ধারণা নয়, কোনও সময়ফাঁদে আটকে থাকা গ্রাম নয়। সেখানে কোনও বুকভরা মধু বঙ্গের বধূ তো নেই-ই, নেই সেই চেনা চেনা ক্লিশে নানা চিহ্ন, যা গ্রাম বিষয়ে লেখার লক্ষণ বলে আমরা ধরে নিই। আছে এক জীবন্ত সমাজ। করুণা ছুড়ে দেওয়া দারিদ্রের ছবি নয়, বেঁচে থাকার ভিতর দিয়ে দেখা তীক্ষ্ণ জীবনচর্যা।
যমকুলি বইটি সে কারণেই এত অনন্য, এবং ইতিমধ্যেই একটি পুরস্কারে ভূষিত। ভাষা ব্যবহারে জয়দেব একেবারেই মান্য ভাষার দাস নন। তিনি তাঁর নিজের ব্যবহৃত মুখের ভাষা, আঞ্চলিক ব্যবহারকেই প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার দেন। তাই ‘হটাং হটাং’, ‘ঝড়াং ঝড়াং’ ইত্যাদি শব্দে ক্রিয়াবিশেষণ তিনি অনায়াসে ব্যবহার করেন। তথাকথিত মান্য ভাষার পাঠকের কাছে অচেনা একাধিক শব্দকে তিনি রাখেন উদ্ধৃতি চিহ্নের ভিতরেই, যাতে তার অর্থ বুঝে নেওয়া যায় আশপাশের শব্দগুলি থেকে। যথা খোদাবিকুলে, মাথা সিথেন, খালমু, হেলেপাড়া, ঢেঁশ, ভুঁসো। লণ্ঠনটা ‘দম চিমকে’ টিমটিম জ্বলছে— এই ব্যবহার জয়দেবের। “ধোঁয়াটা ঘরের ভিতর ‘গুরুলছে’। মানে, পাক খাচ্ছে।... অবসরি ধোঁয়াতে হাপুচুপু খাচ্ছে।” (মহিলা প্রতিনিধি) এই ‘মহিলা প্রতিনিধি’ গল্পে অবসরির চারটি মেয়ে— বিটিছেলে। বড়টা ‘খালখাবুলে’, মেজোটা ‘ছ্যাত-কাঁদুনে’, সেজোটা ‘লড়েভোলা’। কোলেরটা নেহাত শিশু।
ফপরা বাঁশের খ্যাংড়া ঠ্যাঙা— এ রকম ব্যবহারে কোনও আড়ষ্টতা নেই জয়দেবের। পাঠককেও তিনি এই পথে দিব্যি অনেক দূর অবধি নিতে সক্ষম। এ ছাড়া, কথোপকথনে ‘যাব নাই’ বা ‘এয়েছিস কেনে’-র ব্যবহারে বাঁকুড়ার আঞ্চলিকতাকে তিনি তো অক্ষুণ্ণ রাখেনই।
তাঁর গল্পে অনায়াসে আসা-যাওয়া করে কল্পিত জগতের জিনিসপত্রও। পুষ্টি দেয় বাস্তবকে। চিঁড়েমুড়কি গাছের উপর থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে আসা সাধু যে রকম। আমাদের পড়ুয়া মন তাকে মার্কেজ়-কথিত ‘ম্যাজিক রিয়ালিজ়ম’ আখ্যা দিতেই পারে। বাস্তব যখন পরতে পরতে জাদু হয়ে ওঠে, বাস্তব কাহিনির বয়নের মধ্যে যখন ঢুকে পড়ে অলৌকিক, সে অলৌকিকের মেজাজও যখন গ্রাম্য, আঞ্চলিক ইচ্ছাপূরণের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে মাটির গন্ধে মেশা না পাওয়ার আর্তিতে মিশ খেয়ে যায়, হয়তো সেটাই প্রকৃত জাদুবাস্তবতার গল্প।
এই লেখকের অভিজ্ঞতা তাঁর লেখনকে যে পুষ্টিটা দেয়, তা কেবল শরীর ধারণের পুষ্টি। কিন্তু সেই উপাদান যত চমকপ্রদ, চেনা বাংলা লেখালিখি থেকে যত ‘আলাদা’, তা কেবল উপাদানে। উপাদান দিয়ে যা গড়ে তোলা হচ্ছে, তাতে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো পোরা আছে এই লেখকের মেজাজ, যা আদ্যন্ত এক হাসি-ঠাট্টার মেজাজ। জীবিতের, যাপিতের রসবোধ।
এই রসবোধই আমাদের উপরি প্রাপ্তি। ভাষা সচেতনতার সঙ্গে আবার এই বোধ ওতপ্রোত। এই রসবোধই শিল্পে উত্তীর্ণ করে প্রতিটি প্রান্তিক, অন্ত্যজ অভিজ্ঞতাকে। এই রসবোধটিও কিন্তু তাঁর আজন্মের, নিজস্ব এবং আঞ্চলিক— যে অর্থে গোপাল ভাঁড় বা রূপকথা-উপকথায় এক ধরনের নিষ্ঠুর, কাঁচা অথচ প্রাজ্ঞ হাসি আমরা খুঁজে পাই। যা আঘাত করে, আবার নিজের বেদনাকেই উন্মুক্ত করে। সে রকমই এক ঈষৎ কষায় ঈষৎ তিক্ত হাসি মাখামাখি হয়ে থাকে জয়দেব দত্তের প্রায় প্রতি লেখায়। যার ফলে লেখাগুলি দারিদ্র, হতাশা, বেদনার কথা বলতে বলতেই শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে এক-এক খণ্ড মণির মতোই চমকদার।
কাহিনি বর্ণনেও জয়দেবের নিজস্ব একটা ঢং আছে। একটি চরিত্রকে ভিতর দিক থেকে তিনি বর্ণনা করেন, এবং তার যাবতীয় উত্থান-পতন, অদ্ভুত পরিস্থিতির ভিতরের সঙ্কটকাল, সবটাই একেবারে ঝলমল করে ওঠে চোখের সামনে। টাকার ব্যাগ কুড়িয়ে পাওয়া শ্রীধর, হারমোনিয়ামে প্যাঁ বাজানো নারানদা, অথবা অসুখেবিসুখে, দেশে মড়ক লাগলে আঙুল বেঁকিয়ে ‘ব’ লিখে দিয়ে সুস্থ করে তোলার আশ্চর্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব বাড়ুই— প্রতি চরিত্রের ভিতর দিয়ে এক অনিশ্চিত, নড়বড়ে প্রান্তিক অস্তিত্বের গল্পই বলছেন জয়দেব।
আগেই বলেছিলাম, এই লেখকের কলম সমসাময়িক। বাংলার সমসময়ের গ্রামের যে দলিল এখানে তৈরি হচ্ছে, সেখানে গ্রামের বৌ ঘরে ঢুকে মোবাইলের আলো জ্বেলে জিনিস খুঁজে বার করে। অনায়াসে এই বাস্তব ছবিটি আঁকা হয়ে যায় জয়দেবের কলমে। অথবা, “তখন গরমে হাবলের গায়ে মাদুরটা চিটিয়ে গেছে। পিঠে মাদুর দিয়ে বাবাকে দেখতে এসে হাবল ভোঁ!”
এই খুঁটিনাটি এক দিকে। অন্য দিকে, ভাদুগানের-টুসুগানের কথন উদ্ধৃতি। জীবন দর্শন। “তাহলে এতদিন ওর শরীরে ধক যায়নি কি? না কি বিপিএল তালিকায় পাওয়া নার্সিং হোমের খরচপাতির মতো, ওর শরীরেও ধকলের ব্যাপারটাও সরকারি খাতায় জমা হয়ে ওর শরীর থেকেই ভ্যানিশ হয়ে গেছে? তা ত নয়।” (যমকুলি)
কী ভাবে নিজের পাঠ, বাঙালির পাঠ্য, সুঠাম ও অতিমান্য রবীন্দ্রনাথকেও জয়দেব সচেতনে কিন্তু খেলোয়াড়ের অবলীলায় নিজের লেখনে আত্মসাৎ করতে পারেন, তার এক উদাহরণ দিতেই হয়।
বৃষ্টির অমোঘ বর্ণনা, যেখানে ঘরে জল ঢুকছে, জয়দেব লিখলেন— “দেওয়ালের ধারে ধারে ইঁদুরের গর্ত। গর্ত দিয়ে ভদ ভদ করে জল ঢুকছে। জল পেয়ে ইঁদুরগুলো গর্ত থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে সারা ঘর ছোটাছুটি করেছে। কোথাও ঠাঁই পায়নি। ‘তিল ঠাঁই আর নাহি রে’। গর্তে জল ঢোকার ফলে দেওয়ালের মাটি ভিজে গেছে। ভজে সোঁদা মাটির গন্ধ বেরিয়ে আসছে। দেওয়ালগুলো হেলে গেছে। হেলে পড়ব পড়ব করছে।”
এই হলেন জয়দেব দত্ত। মান্য ভাষাকে তিনি বিনির্মাণ করতে পেরেছেন। তাঁর লেখনের দিকে আমাদের তাকিয়ে থাকা কর্তব্য।