উন্নয়ন ও আধুনিকতা/ বর্তমান-সর্বস্ব এই সময়
দীপেশ চক্রবর্তী
১০০.০০, কলকাতা লেটারপ্রেস
প্রণবেশ সেন স্মারক সমিতি আয়োজিত যে যে ‘প্রণবেশ সেন স্মারক বক্তৃতা’ গ্রন্থিত হয়েছে, সেগুলির অন্যতম এই বইটি। ‘স্মারক ভাষণটির সম্পূর্ণ নতুন অনুলিখিত রূপ পরিমার্জনা করে দিয়েছেন বক্তা নিজেই।’ জানিয়েছেন ভবেশ দাশ ও সংযুক্তা সিংহ, স্মারক সমিতির পক্ষে। উন্নয়ন কি শুধু মুষ্টিমেয় মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য? এই প্রশ্ন থেকে আবহাওয়া ও জলবায়ুর পৃথিবীব্যাপী রাজনৈতিক সঙ্কটকে বক্তৃতার বিষয় করে তুলেছেন দীপেশ চক্রবর্তী, কারণ তিনি মনেই করেন যে, আবহাওয়াবিদ্যা বা জলবায়ু-রাজনীতির ইতিহাসকে উপেক্ষা করে কোনও চর্চাই এগোনো অসম্ভব। মুষ্টিমেয় মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যে আদৌ সমগ্রের গণতন্ত্র কি কোথাও অবস্থান করছে, এমন ভাবনা থেকে দীপেশের সংশয়: ‘‘আপনি যদি ভাবতেন যে, মানুষের সমস্ত অধিকার প্রাপ্য হওয়া উচিত, তাহলে তিরিশ কোটি মানুষ হলেও সেকথা ভাবতেন, একশো তিরিশ কোটি মানুষ হলেও সেকথা ভাবতেন। ফলে এই ধরনের চিন্তা যাঁরা করেন— অমর্ত্য সেন, মার্থা নুসবম... পর্যন্ত যদি আসেন, তখনই দেখবেন যে, যখনই মানুষের সংখ্যার কথা কেউ তুলছেন, এত মানুষের জন্য এই ধরনের সমাজ তৈরি করার মতো রসদ— আমরা যেভাবে আধুনিক হওয়ার কথা ভাবি— তা কি পৃথিবীটার আছে?’’ উষ্ণায়ন নিয়ে উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। চুক্তির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উন্নত দেশগুলির আর্থিক সহায়তা মিলছে না, এখানেই প্রকট কূট রাজনীতি, আর শক্তিধরের আধিপত্যকামিতা। তাপমাত্রার বর্ধিত সীমা বেঁধে রাখতে বিশ্বের মোট আয়ের যতটা অর্থ বিনিয়োগ জরুরি তা তো হচ্ছেই না, উল্টে দুনিয়ার সামরিক ব্যয় বেড়েই চলেছে।
প্রিয়বরেষু
সৈয়দ মুজতবা আলী
১৫০.০০, দীপ প্রকাশন
গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক-এর চিন্তার দুর্দশা বইটিও (৫০.০০) আর একটি ‘প্রণবেশ সেন স্মারক বক্তৃতা’, একই প্রকাশনার। চিন্তার দুর্দশাকে নিতান্তই প্রাত্যহিক বা ক্ষণিকের টুকরো অভিজ্ঞতার নিরিখে নয়, আরও অনেক বড় প্রেক্ষিতে ধরতে চেয়েছেন গায়ত্রী। অস্মিতা, আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত হয়ে কী ভাবে সামূহিকতার পথে যাত্রা করা সম্ভব, কোথায় গণতন্ত্রের সার্থকতা, কী ভাবে চিন্তার পথে তৈরি হচ্ছে অবরোধ, তারই ব্যাপ্ত আলোচনা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের বক্তৃতায়। বলেছেন ‘‘পুরুষাঙ্গ প্রাধান্য— জগতের সর্বত্র প্রাসঙ্গিক। ওপর-নীচে, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সব মাপের লোকেদের মধ্যেই। অধিকাংশ মেয়েরাও পুরুষকেন্দ্রিক চেতনা অথবা অচেতনা নিজেদের মধ্যে জাগিয়ে রেখেছেন।’’
নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান ও অন্যান্য কাহিনি
অমর মিত্র
১৩০.০০, গুরুচণ্ডা৯
শুধু যে ‘সচিত্র মাসিক বসুমতী’র সম্পাদক ছিলেন তাই নয়, স্বল্পায়ু জীবনে প্রাণতোষ ঘটক (১৯২৩-৭০) গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, এঁকেছেন ছবিও। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় অবশ্যই ব্যয় করেছেন ‘মাসিক বসুমতী’র জন্য, তাঁর সম্পাদনার কালে যে ভাবে পত্রিকাটিতে নতুন নতুন ভাবনা প্রতিফলিত হত, লেখক ও পাঠকসমাজের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করত, তা তাঁরই বিচক্ষণতার পরিচায়ক। আবার প্রতিভার স্পর্শ তাঁর ইতিহাসনির্ভর উপন্যাসাদি ‘আকাশ পাতাল’ বা ‘রাজায় রাজায়’-তে, মুনশিয়ানা গবেষণাধর্মী কাজে— ‘কলকাতার পথঘাট’, ‘সমার্থক অভিধান’। তাঁর সঙ্গে অনুপম গদ্যকার সৈয়দ মুজতবা আলী-র পত্রালাপ সংবলিত এ-বইটি বাঙালির বিদ্যাচর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করবে নিঃসন্দেহে। বইটির সঙ্কলক ও সম্পাদকদ্বয় প্রণতি মুখোপাধ্যায় ও অভীককুমার দে জানিয়েছেন, ‘‘ঠিক কোন সময় সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে প্রাণতোষ ঘটকের পরিচয়ের সূত্রপাত তা বলা না গেলেও তাঁকে লেখা মুজতবা আলীর চিঠি থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, ১৯৪৮ সালের কোনও একটি সময় বা তার কিছু আগে উভয়ের পরিচয় হয়ে থাকবে এবং সে-পরিচয় অচিরেই হৃদ্যতায় পরিণত হয়।’’ কয়েকটি পত্র সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা-র বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। কখনও কখনও ‘সদন্তঃকরণেষু’ সম্বোধন করলেও, প্রাণতোষকে প্রধানত ‘প্রিয়বরেষু’ সম্বোধনেই পত্রালাপ শুরু করতেন মুজতবা আলী।
১৯৯৩-এর ৩১ অক্টোবর ভোর রাতে, অথবা ৩০ অক্টোবর শেষ রাতে হুগলির ভিক্টোরিয়া চটকলের শ্রমিক ভিখারি পাসোয়ানকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। ফাঁড়িতে পুলিশের অত্যাচারে ভিখারির মৃত্যু হয়, এমন সম্ভাবনার খবর অনেক পরে, অমর মিত্রের উপন্যাস প্রকাশেরও (একুশ শতকের শুরুতে) প্রায় দেড় দশক পরে পত্রপত্রিকায় পাওয়া যায়, যদিও সে মামলার আজও নিষ্পত্তি হয়নি। ভিখারি পাসোয়ান হারিয়ে যাওয়ার পরে আরও কত নিরুদ্দেশ-কাহিনি সংবাদ শিরোনামে এসেছে, গিয়েছে। তাঁদের স্পর্শও যেন-বা আছে অমরের ‘নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান’-এ। আরও চারটি গল্প আছে এ-বইয়ে— গাছ ও মানুষ, ঊনচল্লিশের পরের জন, প্রাণবায়ু, রূপকথায় প্রবেশ। উপন্যাসের সঙ্গে গল্পগুলি মিলিয়ে পড়লে মনে হয় যেন অমর মিত্র পাঠককে সে ভাবেই তাঁর আখ্যান পাঠের জন্যে প্রস্তুত করেছেন, যাতে তাঁদের চেতনা ব্যেপে এই বোধটিই সঞ্চারিত হতে থাকে— এমনই এক দেশ-কাল-দুনিয়ায় আমাদের বসবাস, এমনই এক সংসার-সমাজ-রাষ্ট্রের ঘেরাটোপে, যেখানে নিরুদ্দেশ না-হওয়াটাই আশ্চর্যের, যেখানে হারিয়ে যাওয়াটাই সঙ্গত, বিপন্নতার বাড়তি কোনও হেতু যেখানে নিষ্প্রয়োজন, বিপদ-মুক্তির দিশা যেখানে লোপাট। সরব-নীরব, প্রতিবাদী-ভীরু, সকলের জীবনেরই এক অনিশ্চিত যাপন। এই প্রচ্ছন্ন সন্ত্রাসের কাহিনি কী অনায়াস নিচু স্বরের কথনে বলে যান অমর: ‘‘সহচরী শ্বাস নিচ্ছিল। নাকে আসছে নিমফুলের গন্ধ। কতদিন বাদে! ছেলেটিকে সে বুকে আঁকড়ে ধরল। তার ভয় করছিল। গন্ধটা চিনেছে ছেলে, একে কি ঘরে রাখতে পারবে?’’ ভূমিকায় লিখেছেন রুশতী সেন, লেখকের ‘‘আখ্যানধর্ম রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক সন্ত্রাসকে, সাধারণের অস্তিত্বের সংকট আর অনিশ্চয়কে ফিরে ফিরে নিয়ে আসে পাঠকের বোধচৈতন্যের মুখোমুখি। অথচ সে আবাহনের ভিতরে প্রচারের ভঙ্গিটি অনুপস্থিত। সম্ভবত এই অনুপস্থিতিই আখ্যানের চলনকে এতখানি মর্মস্পর্শী করে তোলে।’’