রামমোহন রায়ের সার্ধদ্বিশতবর্ষের যত আলোচনা, তার কেন্দ্রবিন্দু হয়তো এই প্রশ্ন— তিনি কি আধুনিকতা ও প্রগতির উদ্গাতা? না কি তাঁর মধ্যেও হাজারো আত্মখণ্ডন, সঙ্কীর্ণতা? এই বইয়ের প্রবন্ধগুলিও আবর্তিত হয়েছে এই বিতর্করেখা ধরেই। উনিশ শতকের প্রগতিচেতনার মধ্যে ইউরোপীয় ছাপ অভ্রান্ত, স্ববিরোধিতাও অবধারিত। এ সবই রামমোহনের চিন্তার মধ্যেও প্রতিফলিত। সৌরীন ভট্টাচার্যের মতে, রামমোহনের সমাজসংস্কারে যে নতুন ভাবনার ছোঁয়া, অর্থনৈতিক বিচারে তা নেই। তিনি ব্রিটিশ কোম্পানির অর্থনৈতিক শোষণের কথা বলেননি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। “তাঁর আইডিওলজিক্যাল প্রবণতার পক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক আধুনিকতাই যথেষ্ট ছিল।” এটা একটা সীমাবদ্ধতা। কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতাকে বুঝতে হবে তাঁর ব্যাপ্তি অর্জনের পরিপ্রেক্ষিতেই। রামমোহনের বেদান্ত ভাবনাকেও দেখতে হবে এই বৃহত্তর ছকের মধ্যে। এত স্পষ্ট স্ট্রাকচারে তাঁর যুক্তিকে সাজিয়ে দেওয়ার ফলে পাঠকের যারপরনাই উপকার হয়।
রামমোহন আর বিদ্যাসাগর: উনিশ শতকের দু-জন
সৌরীন ভট্টাচার্য
৪০০.০০
অভিযান
ভাবনার দিক দিয়ে বিদ্যাসাগর রামমোহনের উত্তরাধিকারী। সৌরীন ভট্টাচার্যও তুখোড় বিশ্লেষক। সুতরাং বিধবাবিবাহ, শাস্ত্রচিন্তা, ভাষার প্রশ্ন, সর্ব ক্ষেত্রেই বিদ্যাসাগরের চিন্তাভাবনার চেয়েও বেশি তার পরবর্তী স্তরটিতে তিনি জোর দেন— যুক্তিবিন্যাসের পারদর্শিতায়। এ এক অন্য ভাবে পড়া— আমাদের দুই পুরোধা সংস্কারককে। পাঠক হিসাবে কৃতজ্ঞ থাকতে হয়। সব শেষে, কৃতজ্ঞতা প্রসঙ্গে একটি প্রবন্ধের কথা আলাদা করে বলতে হয়: ‘শকুন্তলা ও সীতা: দুটি দুঃখ-ধোয়া জীবন’। কেবল বিদ্যাসাগরের সারা জীবনের সংগ্রাম ও চর্চার ‘সফলতম পরিণতি’ দেখি না আমরা এই লেখায়, বাঙালি বিশ্লেষক-তাত্ত্বিকের সংবেদনশীলতম মনটিকেও দেখতে পাই।
সার্ধ-দ্বিশতবর্ষে রামমোহন রায়
কোরক সঙ্কলন২০০.০০
কোরক
রামমোহন রায় বিষয়ে নানা বই প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি, তার মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটিই উল্লেখযোগ্য। এই সঙ্কলন জায়গা দাবি করে সেই তালিকায়। পুরনো নতুন বেশ কিছু ভাবনাধর্মী লেখা এখানে পড়া গেল। বিশেষ ভাবে বলা যায় যে লেখকদের কথা: রামমোহনের ধর্মমতের উপর প্রসাদরঞ্জন রায়, পত্রিকাজগৎ ও রামমোহনের সম্পর্কের উপর প্রবীরকুমার বৈদ্য, তুহফাত-উল-মুয়াহিদিন’এর উপর শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রদৃষ্টিতে রামমোহনের উপর পিনাকেশ সরকার, রামমোহনের গানের উপর সুধীর চক্রবর্তী, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে রামমোহনের যোগাযোগ বিষয়ে অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়। মলয়েন্দু দিন্দার রামমোহনের শিক্ষাভাবনা বিষয়ক লেখাটি তথ্যপূর্ণ। তবে বহু সঙ্কলনের মতোই কিছু দুর্বল লেখা পড়ি গুরুতর বিষয়েও। রামমোহনের প্রবাসকালের কথা বলার সময় ইংল্যান্ডে ইউনিটারিয়ান ধর্মগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক না বললে কি চলে? কিংবা বিরূপতা-বিরোধিতার আলোচনায় কথা না আনলে হয়? আর সম্পাদনার ক্ষেত্রে— লেখক-পরিচিতি এবং আর একটু জোরালো ভূমিকা কিন্তু এই ধরনের সঙ্কলনের মান বাড়িয়ে দিতে পারে।ব জরুরি ছিল। বাস্তবিক, এত পরিশ্রম করে যেগুলি সংগৃহীত হয়েছে, তাদের প্রকৃত মূল্য এই অনুল্লেখে কিছুটা নষ্ট হয়।
সার্ধ-দ্বিশতবর্ষে রামমোহন রায়
কোরক সঙ্কলন২০০.০০
কোরক
টুকরো টুকরো তথ্য এক জায়গায় সমাহৃত করার কাজের অবশ্যই একটা দাম আছে। তবে সেই দাম দ্রুত কমে যেতে পারে, যদি শেষ পর্যন্ত সেগুলো টুকরো হিসেবেই থেকে যায়। এই বইটি বিষয়ে তেমন আশঙ্কা ভিত্তিহীন নয়। এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের অবতারণা হয়েছে, রামমোহনের শিক্ষা সংস্কার, সমাজ সংস্কার, ধর্ম সংস্কার, ‘নারীমুক্তি আন্দোলন’ ইত্যাদি। শেষ শব্দবন্ধটি উদ্ধৃতিচিহ্নে রাখতেই হল, যে-হেতু রামমোহনের সতীদাহ নিবারণ সম্পর্কিত ভাবনা বা কার্যক্রমকে এই নামে অভিহিত করা ইতিহাসগত ভাবে রীতিমতো ‘অ্যানাক্রনিস্টিক’ বা কালানৌচিত্য দোষে দুষ্ট। বর্ণনাত্মক ভঙ্গিতে লিখিত, অবহিত পাঠকের সুপরিচিত কাহিনিগুলি আবার পড়া যায় এই বইয়ে। বর্ণনায় অসঙ্গতি নেই, তবে অসম্পূর্ণতা আছে। ইতিমধ্যে রামমোহনের ঐতিহাসিক আলোচনা অনেক এগিয়েছে, এখানে তার পীড়াদায়ক অনুল্লেখ বা অনবধান আছে। তথ্যোল্লেখের ক্ষেত্রে কেবল গোড়ায় লেখকদের নাম-তালিকা আছে, যা বর্ণনাত্মক রচনার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট নয়। এবং সেই তালিকায় এক বারও সুশোভন সরকার, সুমিত সরকার, রণজিৎ গুহর রামমোহন-বিশ্লেষণের উল্লেখ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, উনিশ শতকের গোড়ায় যে প্রেক্ষাপটে রামমোহনের কাজকর্ম, ভাবনাচিন্তা— তা বলতে গিয়ে বার বার বর্তমান ভারতের অনুষঙ্গ, একুশ শতকীয় অসহিষ্ণুতা ও নারীনিগ্রহের দৃষ্টান্তদানও নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়। নানা উপকরণে সজ্জিত হয়েও বইটি তাই পাঠককে সমৃদ্ধ করতে পারল কি না, ফিরে ভাবতে হয়।
রামমোহন রায়: হেরাল্ড অব নিউ মডার্ন এজ
সম্পা: অসিতাভ দাস, পার্থসারথি দাস
৬০০.০০
সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ
রামমোহন-চর্চার গবেষকদের পাঠ-তালিকায় মূল্যবান এক সংযোজনের কারণে ধন্যবাদার্হ হয়ে রইলেন দুই গ্রন্থাগারিক। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের প্রকাশিত শিবনাথ শাস্ত্রীর হিস্ট্রি অব ব্রাহ্ম সমাজ প্রথম খণ্ড (১৯১১) থেকে সংক্ষিপ্তাকার রামমোহন-অধ্যায়, সঙ্গে তারই উপক্রমণিকা হিসাবে প্রকাশিত অমল হোমের ‘সাপ্লিমেন্টারি নোটস’ রামমোহন-পড়ুয়াদের জন্য খুব জরুরি। তার সঙ্গে কিশোরীচাঁদ মিত্র, মহেন্দ্রলাল সরকার, কেশবচন্দ্র সেন, বিপিনচন্দ্র পাল, জগদীশচন্দ্র বসু, মৌলবী আবদুল করিম থেকে সুকুমার সেন, নিশীথরঞ্জন রায়ের মতো আরও বহু বাঙালি চিন্তকের ইংরেজি ভাষায় লেখা প্রবন্ধ এক সঙ্গে পাই এখানে। এবং সঙ্গে পাই মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, সরোজিনী নাইডু, রেভারেন্ড ড্রামন্ড, ম্যাক্সমুয়েলার ও আরও বহু উল্লেখযোগ্য অবাঙালি-ভারতীয় ও বিদেশির চিন্তালেখ। তবে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগতে পারে, রামমোহনের সমস্ত ইংরেজি ও বাংলার রচনার সটীক তালিকা, সময়ানুক্রমে সাজানো। পাশাপাশি দুই ভাষায় ক্রমাগত প্রকাশিত রচনা আবার নতুন করে উদ্ভাসিত করে আড়াইশো বছর পরের এই মনীষীকে। রামমোহন-সম্পর্কিত লেখাগুলি সাজানোর ক্ষেত্রে আর একটু মনোনিবেশ করা যেত অবশ্য। কালানুক্রমিক সূচি আকর্ষণীয় হতে পারত। প্রতিটি প্রবন্ধের সঙ্গে প্রকাশসাল বা মূল আকর গ্রন্থ/পত্রিকার উল্লেখও।