Book Review

গানের দর্পণে দেখা বাংলার সমাজজীবনের যাত্রাপথ

গান বস্তুটি কবিতা নয়— কথা ও সুরের অবিচ্ছেদ্য মেলবন্ধনে তার জন্ম। কথাকেই প্রধান ও সুরকে গৌণ জ্ঞান করলে আলোচনার পরিসরটিকে খণ্ডিত করা হয়, বিশেষত সেই কথাকে যদি বৌদ্ধিক আবেদনসম্পন্ন হতে হয়, তবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ১০:২৩
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

প্রায় আট দশকের বাংলা গান নিয়ে প্রবন্ধের এই সঙ্কলনে কিছু লেখা পূর্বপ্রকাশিত, বাকি লেখাগুলি আনকোরা। প্রথম প্রবন্ধটিতেই বইয়ের আলোচনার তার বেঁধে দিয়েছেন লেখক— “সামগ্রিক কাঠামোয় গানের যে সুরকেন্দ্রিক অংশ শ্রোতার মননে প্রথম ঘা দেয়, তা আদপে গানের কাব্যাংশ বা লিরিকসেরই অর্থবহ অনুসারী।” অর্থাৎ, গানকে তিনি দেখছেন মূলত বাণী হিসাবে, সুর তার বাহক। এই বিশ্লেষণ-কাঠামো ব্যবহার করে লেখক আলোচনা করেছেন ‘দেশভাগপ্রসূত বেদনা’র গান থেকে নব্বইয়ের দশকে আলোড়ন তোলা কবীর সুমন, কামাল নাসের অবধি এক দীর্ঘ সাঙ্গীতিক যাত্রার। সলিল চৌধুরীর ‘প্রান্তরের গান আমার’ হয়ে উঠেছে একটি লেখার বিষয়। নকশালবাড়ি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া গান নিয়ে লেখাটিও গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণাধর্মী এই লেখাগুলিতে প্রাবন্ধিক গানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সময়কে বিনির্মাণ করতে চেয়েছেন। বাংলা গানের মূলত ভাবপ্রধান আলোচনার মধ্যে এই প্রয়াসটি ব্যতিক্রমী, তা স্বীকার করতেই হয়।

Advertisement

তবে, গান বস্তুটি কবিতা নয়— কথা ও সুরের অবিচ্ছেদ্য মেলবন্ধনে তার জন্ম। কথাকেই প্রধান ও সুরকে গৌণ জ্ঞান করলে আলোচনার পরিসরটিকে খণ্ডিত করা হয়, বিশেষত সেই কথাকে যদি বৌদ্ধিক আবেদনসম্পন্ন হতে হয়, তবে। প্রণব রায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বা পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো গীতিকার এই আলোচনায় ঠাঁই পান না, সেই সূত্রে বাদ পড়ে যান কমল দাশগুপ্ত, অনুপম ঘটক থেকে সুধীন দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষরা। তাঁদের গান দিনবদলের কথা বলেনি সে ভাবে, ঠিকই, কিন্তু বাঙালির জীবনবোধের আখ্যান কি তাঁদের বাদ দিয়ে হয়? এমনকি, সলিল চৌধুরীও আটকে থাকেন তথাকথিত দিনবদলের গানের পরিসরে— তাঁর প্রেমের, বিরহের বা অন্য কোনও স্বাদের গানেও কী ভাবে সুরের অন্তর্ঘাত ঘটে, সে ‘রাজনীতি’র আখ্যান অধরাই থাকে।

মেঘ রোদ্দুরে বাংলা গান

Advertisement

প্রিয়দর্শী চক্রবর্তী

৪৫০.০০

নবজাতক

বইটির তাৎপর্যপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে সত্তরের দশক ও তার পরবর্তী সময়ের মূলত ‘আরবান’ গান। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ তার সময়ের আগে ছুটেছিল, না কি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, এই তর্কটি ফিরিয়ে এনেছেন প্রাবন্ধিক। প্রতুল মুখোপাধ্যায় বিষয়ে লেখাটি মানুষ প্রতুলকে চিনতে সাহায্য করে। তবে, এই ক্ষেত্রেও, গানের কথাকেই অধিকতর গুরুত্ব দেওয়ার ফলে শিল্পীর সম্পূর্ণ মূল্যায়ন সম্ভব হয়নি, কারণ তাঁর অধিকাংশ গানই অন্যের কথায়। কবীর সুমনের প্রতি বিশেষ অনুরাগ এক যুগধর্মবিশেষ— গত শতকের নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গের শহর বা শহরতলি অঞ্চলে যাঁরা কিশোর থেকে যুবক হয়েছেন, তাঁদের একটি বড় অংশ তাঁর গানের প্রতি অনুগত। প্রিয়দর্শী চক্রবর্তীর এই প্রবন্ধ সঙ্কলন এক অর্থে সেই নব্বইয়ের দশকে যুবক হয়ে ওঠা বাঙালির স্মৃতিমেদুরতাও বটে।

তিনি মারদাঙ্গার ছবি করেন, সে কথা শুনে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “লোকে বসে দেখে তো? সেটাই আসল। ছবি তো আর একা বসে দেখবে না!” শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালি অবশ্য প্রভাত রায়কে মনে রেখেছে এমন দুটো ছবির জন্য, যেগুলো ‘মারদাঙ্গা’র নয় মোটেও— শ্বেতপাথরের থালা, আর লাঠি। দীর্ঘ ফিল্মজীবনে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে অনেকের সঙ্গেই। সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন ক্ল্যাপস্টিক বইটিতে। উত্তমকুমার থেকে অমিতাভ বচ্চন, অপর্ণা সেন থেকে রাখী, শক্তি সামন্ত, মিঠুন চক্রবর্তী, সঞ্জীবকুমার, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় বা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত— গত শতকের সত্তরের দশক থেকে এই শতকের প্রথম দু’টি দশক, প্রায় পঞ্চাশ বছরের যাত্রাপথে দেখা রুপোলি পর্দার রথী-মহারথীদের এমন অনেক কথাই এই বইয়ে এসেছে, আম পাঠক যে কথা আগে পড়েননি।

ক্ল্যাপস্টিক

প্রভাত রায়

৩৫০.০০

দীপ

কোনও এক ছবির শুটিংয়ের অবসরে নাসিরুদ্দিন শাহ নাকি সহ-অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে গালি দিচ্ছিলেন। কেন, জিজ্ঞাসা করায় বলেন, মিঠুনকে নন, গালি দিচ্ছেন মিঠুন-অভিনীত চরিত্রটিকে, কারণ পরবর্তী শটে সেই ঘৃণা ফুটিয়ে তুলতে হবে অভিনয়ে। অমানুষ ছবির শুটিংয়ে পুলিশের মেক-আপধারী অনিল চট্টোপাধ্যায় নাকি সত্যি পুলিশদের সঙ্গে মিশে গিয়ে শুটিং দেখতে আসা ভিড় সামলাতেন। রাহুল দেব বর্মণ খেতেন অসম্ভব ঝাল কাঁচালঙ্কা— বলতেন, একটা করে লঙ্কা খাব, আর একটা করে সুর বেরোবে! অনুসন্ধান ছবির শুটিংয়ে অমিতাভ বচ্চনের জন্য একটি রোমান্টিক সিনে পরিচালক শক্তি সামন্তের নির্দেশে খুব কাব্যিক সংলাপ লিখেছিলেন প্রভাত রায়। দেখা গেল, শট দেওয়ার সময় অমিতাভ খুবই রোমান্টিক ভঙ্গিতে সংলাপ বলছেন, এবং রাখী হেসে গড়িয়ে পড়ছেন। রেকর্ডিং শুনে দেখা গেল, অমিতাভ আওড়ে গিয়েছেন কলকাতার চায়ের দোকান বা রকের আড্ডায় উচ্চারিত সুভাষিতাবলি। অতঃপর সংলাপ বদল: সহজ ভাষায় লেখা হল, অমিতাভও দিব্য শট দিলেন।

গল্পগুলো পড়তে চমৎকার লাগে। মনে হয়, প্রভাত রায়ের মতো যে পরিচালকরা বাংলা সিনেমার দুর্বলতম মুহূর্তে দর্শকদের নাড়ির গতি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁদের প্রতি বিদ্বজ্জনরা আর একটু সদয় হতে পারতেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement