book review

তিন দশকের গণ-অসুখের নথি

ছোটখাটো কিছু ত্রুটি সত্ত্বেও উৎসাহী পাঠক ও গবেষকদের কাছে নির্বাচিত রিপোর্টগুলি পৌঁছে দেওয়ার সম্পাদকীয় উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।

Advertisement

অরবিন্দ সামন্ত

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৪:৫৫
Share:

রক্ষাকবচ: ১৮৯৪ সালে কলকাতায় কলেরা ঠেকাতে টিকাকরণ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স।

ড্রেডফুল ডিজ়িজ়েস ইন কলোনিয়াল বেঙ্গল: কলেরা, ম্যালেরিয়া অ্যান্ড স্মলপক্স: আ ডকুমেন্টেশন
সম্পা: সুরঞ্জন দাস, অচিন্ত্য কুমার দত্ত
১২৫০.০০
প্রাইমাস বুকস

Advertisement

গ্রন্থটি মনোযোগী পাঠক এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষকদের কাছে মূল্যবান। বিশ শতকের প্রথমার্ধে ঔপনিবেশিক বাংলার ‘ভয়াবহ’ তিনটি রোগ কলেরা, বসন্ত ও ম্যালেরিয়া, এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারি রিপোর্টের নির্বাচিত সঙ্কলন এটি। জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে সঙ্কলিত রিপোর্টের মধ্যে আছে বিশ শতকের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দশকের ডা. সি এ বেন্টলি, ডা. আর বি খামবাটা, ডা. এস এন সুর, লেফটন্যান্ট কর্নেল এ সি চট্টোপাধ্যায় ও ডা. বি মুখোপাধ্যায়ের এক বা একাধিক— মোট আটটি রিপোর্ট। ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত চারটি রিপোর্টের মধ্যে মেজর এ বি ফ্রাই, সি এ বেন্টলি ও মেজর জি কোভেলের একটি করে, এবং গ্রামবাংলায় ম্যালেরিয়া নিবারণে কুইনিনের কার্যকারিতার বিবরণ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট আছে।

বাংলার জনস্বাস্থ্য বিষয়ে নথিগুলি থেকে আমরা তিনটি রোগের কারণ, প্রাদুর্ভাবের সময়কাল, আঞ্চলিক বৈচিত্র এবং মৃত্যুহার সংক্রান্ত নানা তথ্য জানতে পারি। জানতে পারি এই সব রোগ প্রশমনে সরকার কী ভূমিকা পালন করেছিল। রোগগুলি সম্পর্কে সরকারি আমলাদের মনোভাব, এবং তাদের প্রতিরোধে সরকারি উদ্যোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কী ধারণা ছিল, তা-ও জানা যায় এখানে। ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত চারটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় ম্যালেরিয়ার ব্যাপ্তি, তার গতিপ্রকৃতি, ম্যালেরিয়া নিবারণে সরকারি ব্যবস্থাপনার খামতি, জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে পুরসভার উদ্যোগ এবং ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে কুইনিনের কার্যকারিতা।

Advertisement

পরিবেশনা, প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও মুদ্রণসৌকর্যের পারিপাট্যে গ্রন্থটি অনিন্দ্যসুন্দর। তবে কয়েকটি ব্যাপারে কিছু প্রত্যাশা এবং অস্বস্তি রয়ে গেল। যে তিনটি রোগ নিয়ে এ গ্রন্থের পরিকল্পনা, বাংলায় মহামারি হিসেবে তাদের প্রথম প্রাদুর্ভাব ১৮১৮ সাল নাগাদ। এর প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছরের মধ্যেই এগুলি নিয়ে অজস্র সরকারি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। ওই সব রিপোর্টে মহামারির কারণ, প্রকৃতি ও অভিঘাত বিষয়ে সরকারি আমলাদের পারস্পরিক তর্ক-বিতর্ক, মহামারি প্রতিরোধে সরকারের নিস্পৃহ উদাসীনতা অথবা দ্বিধান্বিত মানসিকতা প্রতিফলিত হয়েছিল। বিশেষত, ম্যালেরিয়া নিয়ে ডাক্তার জে এলিয়ট বা বি এন মুখোপাধ্যায়ের রিপোর্ট, কলেরা নিয়ে ডা. এফ এ করবিন কিংবা ডা. জে এম কানিংহ্যামের রিপোর্ট, এবং বসন্তরোগ নিয়ে ডা. ডানকান স্টুয়ার্ট বা ডা. এস পি জেমস প্রমুখের রিপোর্ট গবেষকদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। স্ট্রাকচারালিস্টরা ঔপনিবেশিক স্বাস্থ্যনীতির বিবর্তনের বিভিন্ন স্তর এখানে লক্ষ করবেন। পোস্ট-মডার্নিস্টরা ঔপনিবেশিক সরকারের ক্ষমতা প্রদর্শনের বিভিন্ন তল ও তাপমাত্রার গতিপ্রকৃতি উপলব্ধি করতে পারবেন। ওই সময়কার রিপোর্টগুলির বদলে অবশ্য এই বইয়ে সম্পাদকরা মহামারির সূচনাকালের শতাধিক বছরেরও পরের রোগ ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারি প্রতিবেদন বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন। উনিশ শতকের শেষ বা বিশ শতকের শুরু থেকেই কলেরা, ম্যালেরিয়া বা বসন্তরোগ তাদের এপিডেমিক চরিত্র ত্যাগ করে বাংলার গ্রাম ও শহরে ‘এনডেমিক’ হয়ে পড়েছিল। গ্রন্থের ভূমিকায় এই তিনটি রোগের এপিডেমিক চরিত্র নিয়ে সুন্দর আলোচনা থাকলেও নথি নির্বাচনের সময় এনডেমিক কালপর্বই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছে। সম্পাদকেরা পছন্দ করার স্বাধীনতা নিতেই পারেন। কিন্তু ইতিহাসের ডকুমেন্টেশনে বা ডকুমেন্টেশনের ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত ‘জন্‌র’ এ ব্যাপারে সায় দেয় কি না, আমার জানা নেই।

গ্রন্থের ভূমিকায় কয়েকটি বক্তব্য থেকে ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হতে পারে। যেমন, ম্যালেরিয়া কোনও সময়ই গ্রামবাসীদের দলে দলে (‘হোলসেল’) গ্রাম ছেড়ে পালানোর (পৃ ২) মতো ঘটনা ঘটায়নি। সমকালীন অধিকাংশ রিপোর্ট সে কথাই বলে। আসলে, মহামারির সময়ে পালানোর মতো কোনও নিরাপদ গ্রামই অবশিষ্ট ছিল না। দরিদ্র কৃষকেরা সাধারণত বাসস্থান ছেড়ে পালানোর কথা ভাবতেনও না, কেননা তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, তাঁদের ভদ্রাসনবাটি পরলোকগত পূর্বপুরুষেরা গভীর মমতা দিয়ে রক্ষা করছেন। ভিটেমাটি ত্যাগ করা তাই পরিবারের কাছে অশুভ। তবুও যাঁরা পালিয়েছিলেন শহরে, তাঁরা ছিলেন গ্রামের বর্ধিষ্ণু জমিদার বা সম্পন্ন কৃষক ও মহাজন। এঁদের এই চলে যাওয়ায় কৃষির যত না ক্ষতি হয়েছিল, তার চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতি হয়েছিল অসংখ্য দরিদ্র কৃষকের মৃত্যুর ফলে। বর্ধমান ও হুগলি জেলার বহু গ্রামে চাষবাস করার মতো মানুষজনই অবশিষ্ট ছিল না। জনমানবশূন্য জঙ্গলাকীর্ণ কোনও কোনও গ্রাম ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। আর এই রকম পরিবেশ গড়ে তুলেছিল দেবযান-এর মতো উপন্যাসের পটভূমি।

মহামারির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নানা গুজব। কই ও মাগুর মাছ বসন্তরোগের জীবাণু বহন করে, এমনতর প্রচলিত গুজবের কথা আমরা ভূমিকা থেকে জানতে পারি। কিন্তু মহামারি নিয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক গুজবের কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে। বসন্তরোগের পশ্চিমি টিকার বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের ফরাজি মুসলমানদের সবচেয়ে বড় আপত্তি ছিল রাজনৈতিক। এর পিছনে কাজ করেছিল একটি গুজব। ফরাজিরা গুজব রটিয়েছিল, ইংরেজ শাসন থেকে মুসলমানদের উদ্ধার করতে তাদের মধ্যে এক ইমামের আবির্ভাব হয়েছে, যাঁর ধমনীতে প্রবাহিত রক্তের রং সাদা। ইংরেজরা এ কথা জানতে পেরেছে, এবং ইমামকে শনাক্ত করতে তারা টিকাকরণের অজুহাতে যাবতীয় মুসলমানের শরীর বিদ্ধ করে রক্তের রং দেখে তাঁকে বন্দি করতে চাইছে। ফলত, এই গুজব বসন্তরোগ ও টিকাকরণকে একটি রাজনৈতিক চরিত্র দেয়। গুজবের সামাজিক চরিত্রও সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গুজব রটেছিল, নারীদের বাহুতে নয়, স্তনে টিকা দেওয়া হবে। এই গুজবের সামাজিক প্রতিক্রিয়া সহজেই অনুমেয়।

পরিশেষে, ভূমিকার ফুটনোটে কয়েকটি ত্রুটি চোখে পড়ল। এক নম্বর ফুটনোটে কবিতা রায়ের বহুপঠিত বইটির নাম ভুল আছে; স্বাস্থ্য পত্রিকার (পৃ ১৪) ইংরেজি বানান ঠিক নেই, ধ্রুব কুমার সিংহের (পৃ ১৬) প্রবন্ধের শিরোনামে ‘causality’ শব্দটি ‘ছাপার ভুলে মূল অর্থে অনর্থ ঘটিয়েছে। ৬৬ নং ফুটনোটে (পৃ ১৭) ‘ফিভার’ শব্দটির যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। ঔপনিবেশিক বাংলার সেনসাস রিপোর্টে, মৃত্যুহার প্রতিবেদনে, ‘ফিভার’ শিরোনামটি বড় গোলমেলে। অধিকাংশ রোগেরই সুস্পষ্ট চারিত্রলক্ষণ হল জ্বর। সে জ্বর ম্যালেরিয়া, কলেরা বা বসন্তরোগের কারণেও হতে পারে। গ্রামের যে চৌকিদার গ্রামবাসীর রোগ, শোক ও মৃত্যুর খবর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দিত, তাঁর পক্ষে কী কারণে ‘জ্বর’, তা নির্ণয় করা সহজ ছিল না। সে সব রকমের মৃত্যুর পিছনেই ‘জ্বর’-এর কারসাজি দেখত। ‘জ্বর’ শিরোনামের মধ্যেই তাই লুকিয়ে আছে ম্যালেরিয়া, কলেরা বা বসন্তরোগীর খবর। সুতরাং, বাংলায় ‘ফিভার’-এর ঘটনা প্রায়ই ঘটত। সেগুলি এপিডেমিক শ্রেণিতে পড়ে না, কথাটির (পৃ ১৭) অর্থ স্পষ্ট হচ্ছে না।

এমন ছোটখাটো কিছু ত্রুটি সত্ত্বেও উৎসাহী পাঠক ও গবেষকদের কাছে নির্বাচিত রিপোর্টগুলি পৌঁছে দেওয়ার সম্পাদকীয় উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়, বিশেষ করে এই সময়ে। প্রকাশক গোষ্ঠীকেও আলাদা করে ধন্যবাদ, এই দুর্মূল্যের বাজারে তারা এ ধরনের নথি নিবদ্ধীকরণে উৎসাহ দেখিয়েছেন।

অরবিন্দ সামন্ত

গ্রন্থটি মনোযোগী পাঠক এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষকদের কাছে মূল্যবান। বিশ শতকের প্রথমার্ধে ঔপনিবেশিক বাংলার ‘ভয়াবহ’ তিনটি রোগ কলেরা, বসন্ত ও ম্যালেরিয়া, এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারি রিপোর্টের নির্বাচিত সঙ্কলন এটি। জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে সঙ্কলিত রিপোর্টের মধ্যে আছে বিশ শতকের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দশকের ডা. সি এ বেন্টলি, ডা. আর বি খামবাটা, ডা. এস এন সুর, লেফটন্যান্ট কর্নেল এ সি চট্টোপাধ্যায় ও ডা. বি মুখোপাধ্যায়ের এক বা একাধিক— মোট আটটি রিপোর্ট। ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত চারটি রিপোর্টের মধ্যে মেজর এ বি ফ্রাই, সি এ বেন্টলি ও মেজর জি কোভেলের একটি করে, এবং গ্রামবাংলায় ম্যালেরিয়া নিবারণে কুইনিনের কার্যকারিতার বিবরণ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট আছে।

বাংলার জনস্বাস্থ্য বিষয়ে নথিগুলি থেকে আমরা তিনটি রোগের কারণ, প্রাদুর্ভাবের সময়কাল, আঞ্চলিক বৈচিত্র এবং মৃত্যুহার সংক্রান্ত নানা তথ্য জানতে পারি। জানতে পারি এই সব রোগ প্রশমনে সরকার কী ভূমিকা পালন করেছিল। রোগগুলি সম্পর্কে সরকারি আমলাদের মনোভাব, এবং তাদের প্রতিরোধে সরকারি উদ্যোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কী ধারণা ছিল, তা-ও জানা যায় এখানে। ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত চারটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় ম্যালেরিয়ার ব্যাপ্তি, তার গতিপ্রকৃতি, ম্যালেরিয়া নিবারণে সরকারি ব্যবস্থাপনার খামতি, জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে পুরসভার উদ্যোগ এবং ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে কুইনিনের কার্যকারিতা।

পরিবেশনা, প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও মুদ্রণসৌকর্যের পারিপাট্যে গ্রন্থটি অনিন্দ্যসুন্দর। তবে কয়েকটি ব্যাপারে কিছু প্রত্যাশা এবং অস্বস্তি রয়ে গেল। যে তিনটি রোগ নিয়ে এ গ্রন্থের পরিকল্পনা, বাংলায় মহামারি হিসেবে তাদের প্রথম প্রাদুর্ভাব ১৮১৮ সাল নাগাদ। এর প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছরের মধ্যেই এগুলি নিয়ে অজস্র সরকারি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। ওই সব রিপোর্টে মহামারির কারণ, প্রকৃতি ও অভিঘাত বিষয়ে সরকারি আমলাদের পারস্পরিক তর্ক-বিতর্ক, মহামারি প্রতিরোধে সরকারের নিস্পৃহ উদাসীনতা অথবা দ্বিধান্বিত মানসিকতা প্রতিফলিত হয়েছিল। বিশেষত, ম্যালেরিয়া নিয়ে ডাক্তার জে এলিয়ট বা বি এন মুখোপাধ্যায়ের রিপোর্ট, কলেরা নিয়ে ডা. এফ এ করবিন কিংবা ডা. জে এম কানিংহ্যামের রিপোর্ট, এবং বসন্তরোগ নিয়ে ডা. ডানকান স্টুয়ার্ট বা ডা. এস পি জেমস প্রমুখের রিপোর্ট গবেষকদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। স্ট্রাকচারালিস্টরা ঔপনিবেশিক স্বাস্থ্যনীতির বিবর্তনের বিভিন্ন স্তর এখানে লক্ষ করবেন। পোস্ট-মডার্নিস্টরা ঔপনিবেশিক সরকারের ক্ষমতা প্রদর্শনের বিভিন্ন তল ও তাপমাত্রার গতিপ্রকৃতি উপলব্ধি করতে পারবেন। ওই সময়কার রিপোর্টগুলির বদলে অবশ্য এই বইয়ে সম্পাদকরা মহামারির সূচনাকালের শতাধিক বছরেরও পরের রোগ ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারি প্রতিবেদন বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন। উনিশ শতকের শেষ বা বিশ শতকের শুরু থেকেই কলেরা, ম্যালেরিয়া বা বসন্তরোগ তাদের এপিডেমিক চরিত্র ত্যাগ করে বাংলার গ্রাম ও শহরে ‘এনডেমিক’ হয়ে পড়েছিল। গ্রন্থের ভূমিকায় এই তিনটি রোগের এপিডেমিক চরিত্র নিয়ে সুন্দর আলোচনা থাকলেও নথি নির্বাচনের সময় এনডেমিক কালপর্বই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছে। সম্পাদকেরা পছন্দ করার স্বাধীনতা নিতেই পারেন। কিন্তু ইতিহাসের ডকুমেন্টেশনে বা ডকুমেন্টেশনের ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত ‘জন্‌র’ এ ব্যাপারে সায় দেয় কি না, আমার জানা নেই।

গ্রন্থের ভূমিকায় কয়েকটি বক্তব্য থেকে ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হতে পারে। যেমন, ম্যালেরিয়া কোনও সময়ই গ্রামবাসীদের দলে দলে (‘হোলসেল’) গ্রাম ছেড়ে পালানোর (পৃ ২) মতো ঘটনা ঘটায়নি। সমকালীন অধিকাংশ রিপোর্ট সে কথাই বলে। আসলে, মহামারির সময়ে পালানোর মতো কোনও নিরাপদ গ্রামই অবশিষ্ট ছিল না। দরিদ্র কৃষকেরা সাধারণত বাসস্থান ছেড়ে পালানোর কথা ভাবতেনও না, কেননা তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, তাঁদের ভদ্রাসনবাটি পরলোকগত পূর্বপুরুষেরা গভীর মমতা দিয়ে রক্ষা করছেন। ভিটেমাটি ত্যাগ করা তাই পরিবারের কাছে অশুভ। তবুও যাঁরা পালিয়েছিলেন শহরে, তাঁরা ছিলেন গ্রামের বর্ধিষ্ণু জমিদার বা সম্পন্ন কৃষক ও মহাজন। এঁদের এই চলে যাওয়ায় কৃষির যত না ক্ষতি হয়েছিল, তার চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতি হয়েছিল অসংখ্য দরিদ্র কৃষকের মৃত্যুর ফলে। বর্ধমান ও হুগলি জেলার বহু গ্রামে চাষবাস করার মতো মানুষজনই অবশিষ্ট ছিল না। জনমানবশূন্য জঙ্গলাকীর্ণ কোনও কোনও গ্রাম ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। আর এই রকম পরিবেশ গড়ে তুলেছিল দেবযান-এর মতো উপন্যাসের পটভূমি।

মহামারির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নানা গুজব। কই ও মাগুর মাছ বসন্তরোগের জীবাণু বহন করে, এমনতর প্রচলিত গুজবের কথা আমরা ভূমিকা থেকে জানতে পারি। কিন্তু মহামারি নিয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক গুজবের কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে। বসন্তরোগের পশ্চিমি টিকার বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের ফরাজি মুসলমানদের সবচেয়ে বড় আপত্তি ছিল রাজনৈতিক। এর পিছনে কাজ করেছিল একটি গুজব। ফরাজিরা গুজব রটিয়েছিল, ইংরেজ শাসন থেকে মুসলমানদের উদ্ধার করতে তাদের মধ্যে এক ইমামের আবির্ভাব হয়েছে, যাঁর ধমনীতে প্রবাহিত রক্তের রং সাদা। ইংরেজরা এ কথা জানতে পেরেছে, এবং ইমামকে শনাক্ত করতে তারা টিকাকরণের অজুহাতে যাবতীয় মুসলমানের শরীর বিদ্ধ করে রক্তের রং দেখে তাঁকে বন্দি করতে চাইছে। ফলত, এই গুজব বসন্তরোগ ও টিকাকরণকে একটি রাজনৈতিক চরিত্র দেয়। গুজবের সামাজিক চরিত্রও সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গুজব রটেছিল, নারীদের বাহুতে নয়, স্তনে টিকা দেওয়া হবে। এই গুজবের সামাজিক প্রতিক্রিয়া সহজেই অনুমেয়।

পরিশেষে, ভূমিকার ফুটনোটে কয়েকটি ত্রুটি চোখে পড়ল। এক নম্বর ফুটনোটে কবিতা রায়ের বহুপঠিত বইটির নাম ভুল আছে; স্বাস্থ্য পত্রিকার (পৃ ১৪) ইংরেজি বানান ঠিক নেই, ধ্রুব কুমার সিংহের (পৃ ১৬) প্রবন্ধের শিরোনামে ‘causality’ শব্দটি ‘ছাপার ভুলে মূল অর্থে অনর্থ ঘটিয়েছে। ৬৬ নং ফুটনোটে (পৃ ১৭) ‘ফিভার’ শব্দটির যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। ঔপনিবেশিক বাংলার সেনসাস রিপোর্টে, মৃত্যুহার প্রতিবেদনে, ‘ফিভার’ শিরোনামটি বড় গোলমেলে। অধিকাংশ রোগেরই সুস্পষ্ট চারিত্রলক্ষণ হল জ্বর। সে জ্বর ম্যালেরিয়া, কলেরা বা বসন্তরোগের কারণেও হতে পারে। গ্রামের যে চৌকিদার গ্রামবাসীর রোগ, শোক ও মৃত্যুর খবর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দিত, তাঁর পক্ষে কী কারণে ‘জ্বর’, তা নির্ণয় করা সহজ ছিল না। সে সব রকমের মৃত্যুর পিছনেই ‘জ্বর’-এর কারসাজি দেখত। ‘জ্বর’ শিরোনামের মধ্যেই তাই লুকিয়ে আছে ম্যালেরিয়া, কলেরা বা বসন্তরোগীর খবর। সুতরাং, বাংলায় ‘ফিভার’-এর ঘটনা প্রায়ই ঘটত। সেগুলি এপিডেমিক শ্রেণিতে পড়ে না, কথাটির (পৃ ১৭) অর্থ স্পষ্ট হচ্ছে না।

এমন ছোটখাটো কিছু ত্রুটি সত্ত্বেও উৎসাহী পাঠক ও গবেষকদের কাছে নির্বাচিত রিপোর্টগুলি পৌঁছে দেওয়ার সম্পাদকীয় উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়, বিশেষ করে এই সময়ে। প্রকাশক গোষ্ঠীকেও আলাদা করে ধন্যবাদ, এই দুর্মূল্যের বাজারে তারা এ ধরনের নথি নিবদ্ধীকরণে উৎসাহ দেখিয়েছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement