১৯৯১-এর কলকাতা পুস্তকমেলায় অরুণ সেন ও আবুল হাসনাতের সম্পাদনায় নয়া উদ্যোগ প্রকাশ করেছিল বাঙালি ও বাংলাদেশ শীর্ষক এই সঙ্কলন। সম্প্রতি সঙ্কলনের দুই সম্পাদকই প্রয়াত হয়েছেন। অরুণ সেনের প্রয়াণের পর আবুল হাসনাতের ভূমিকায় উভয় সম্পাদকের পরিকল্পিত পরিমার্জন ও পরিবর্ধন-শেষে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের কিছু দিন আগে মৃত্যু হয় হাসনাতেরও।
৩৯ জন লেখকের প্রবন্ধ ও অরুণ সেনের সংযোজনী ভাষ্য সমেত মোট চল্লিশটি রচনায় ঋদ্ধ এই সঙ্কলন। মুক্তিযুদ্ধের কুড়ি বছর পর সঙ্কলনটি প্রথম প্রকাশিত হয় মূলত পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির কাছে বাংলাদেশের বাঙালির মানস ও ইতিহাস সম্পর্কে বিশদ ধারণা দিতে। আবার সম্পাদকদ্বয়ের মতে: “শুধু পশ্চিমবঙ্গের পাঠকই লক্ষ্য নয়। বাংলাদেশের পাঠকের কাছেও এই সঙ্কলনের মধ্য দিয়ে আত্মসমীক্ষার একটা ছবি হাজির হবে, এই আমাদের প্রত্যাশা।”
বহুভাষাবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অভিভাষণের কথামালা প্রমাণ করে, এই সঙ্কলন বৃহত্তর বাঙালির সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ ইহজাগতিক চেতনার দীপ্ত স্মারক। শহীদুল্লাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই উচ্চারণ করেন: “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।... মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জোটি নেই।”
বাঙালি ও বাংলাদেশ: বাংলাদেশের প্রবন্ধ সংকলন
সম্পা: অরুণ সেন, আবুল হাসনাত
৩৫০.০০
নয়া উদ্যোগ
ক্তচিন্তার জন্য নিপীড়িত লোকায়ত দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর ‘আমার পরিচয়’ নিবন্ধে ঘোষণা করেন, “মানবতাই হবে আগামী দিনের মানুষের আন্তর্জাতিক ধর্ম তথা ‘মানবধর্ম’।” আবুল ফজল লেখার শিরোনাম দেন ‘মানবতন্ত্র’। বাংলাদেশের বৌদ্ধিক মানসের সচেতন গন্তব্য অনুধাবন করা যায়।
ভাষা-সংস্কারের নামে নানা সময় বাঙালি চেতনার বিকৃতি-প্রয়াস পর্যবেক্ষণ করেছেন আহমদ শরীফ। বদরুদ্দীন উমর তাঁর লেখায় ১৯৪৭-১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনমুখী সাংস্কৃতিক সংগ্রামকে চিহ্নিত করেছেন বাঙালি মুসলমানের ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’-রূপে; সনজীদা খাতুন ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ’-কে অবলোকন করেছেন অভেদ উদ্ভাসে: “বাংলাদেশের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তাঁকে আমরা আমাদের পথের সাথী এবং বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক হিসেবেই জেনেছি।” সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যাচাই করে দেখতে চেয়েছেন ‘দ্বি-জাতিতত্ত্বের সত্য-মিথ্যা’; আর আনিসুজ্জামান তাঁর লেখার উপান্তে যুক্ত করেছেন ১৯৬৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পূর্ববাংলায় প্রচারিত কথকতার তথ্য, যেখানে প্রকৃতার্থে বলা আছে চিরায়ত বাঙালি প্রাণের কথন ‘একটি বাংলা অক্ষর— একটি বাঙালির জীবন’।
হাসান আজিজুল হক ‘বাংলাদেশ: পালিয়ে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়’ শিরোনামের গল্প-সম লেখায় নিরুদ্দেশ সদর্থক চেতনা নিয়ে কথা বলেছেন, প্রত্যাশা করেছেন বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক উত্থান। বাংলাদেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও অর্জনের সুদীর্ঘ পরিক্রমা ও অব্যাহত আলোক-অভিযাত্রার কথা লিখেছেন মালেকা বেগম ও সুলতানা কামাল।
এই সঙ্কলন আরও সমৃদ্ধ হয়েছে কাজী মোতাহার হোসেন, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ, রণেশ দাশগুপ্ত, আবদুল হক, কবীর চৌধুরী, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, সৈয়দ শামসুল হক, সালহউদ্দীন আহমদ, রশীদ করীম, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, জাহানারা ইমাম, আবদুল্লাহ আল-মুতী, ওয়াহিদুল হক, মমতাজুর রহমান তরফদার, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হায়াৎ মামুদ, সনৎকুমার সাহা, আতিউর রহমান, শামসুজ্জামাম খান, আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ, আবুল মোমেন, মুনতাসীর মামুন, তসলিমা নাসরিন, হাসান ফেরদৌস, অনুপম সেন, আলী আনোয়ার প্রমুখের প্রবন্ধে।