কুমুদিনী বিত্ত নিগম রহস্য
অভিরূপ সরকার
৩০০.০০
দীপ প্রকাশন
গোয়েন্দা গল্পের সমালোচনা লেখা এক মস্ত ঝামেলা। রহস্য ফাঁস হয়ে যায়, এমন কোনও কথা লেখা যাবে না কোনও মতেই। এটুকু বললে অবশ্য রসভঙ্গ হবে না যে, লেখকের তৃতীয় বইয়ে এসে গোয়েন্দা আদিত্য মজুমদার অনেকখানি রক্তমাংসের মানুষ হয়ে উঠেছেন। কেয়া বাগচির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও যে ভাবে গড়াচ্ছে, তাতে আগামী দু’-একটা উপন্যাসের মধ্যেই যদি আদিত্যকে সংসার পাততে দেখা যায়, পাঠক অবাক হবেন না। এই কথাটির বিশেষ উল্লেখ অকারণ নয়। কোনও চরিত্র যদি ধারাবাহিক ভাবে বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে আসতে থাকে, তবে সেই চরিত্রকে শুধু তার মুখ্য কাজটিতে আটকে রাখলেই লেখকের চলে না— চরিত্রটিকে ডালপালা মেলতে দিতে হয়। একটা খুবই অসম উদাহরণ দেওয়া যায়: ব্যোমকেশের সঙ্গে সত্যবতীর দাম্পত্য খুনসুটিগুলি না থাকলেও রহস্যভেদের ইতরবিশেষ হত না, কিন্তু সেই ছোটখাটো ঘটনাগুলি থাকায় গল্পের প্রসাদগুণ বেড়ে গিয়েছিল অনেকখানি। অভিরূপ সরকার সুলেখক। ফলে, আদিত্যকে কেন্দ্র করে তিনি আরও লিখলে সেখানে পাঠক এই উপরি পাওনার প্রত্যাশা করতে পারেন। বিশেষত লেখক যেখানে নিজে স্পষ্ট ভাবে জানিয়েই রেখেছেন, “টের পাচ্ছি, গোয়েন্দা উপন্যাস লেখার ব্যাপারে আমার আগ্রহ কিছুতেই কমছে না।”
উপন্যাসটির কেন্দ্রে রয়েছে একটি বেআইনি টাকার লেনদেন। তার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ছে ডান্স বার থেকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, অনেক কিছুই। লেখক যদি পেশাদার অর্থশাস্ত্রী হন, তা হলে উপন্যাসে ঢুকে পড়তে পারে এমন অনেক কিছুও, পাঠকের কাছে যা অপ্রত্যাশিত। খানিকটা তুলে দেওয়া যাক— “আমাদের দেশে অসংখ্য ছোট-ছোট ব্যবসায়ী আছে, কল-কারখানার মালিক আছে, চাষি আছে যারা নানা কারণে ব্যাঙ্ক থেকে ধার পায় না। লোকাল মহাজন বা লেন্ডিং এজেন্সিরা এদের ধার দেয়... বাংলা গল্প-উপন্যাস-সিনেমায় এইসব সুদখোর মহাজনদের ইনভেরিএবলি ভিলেন হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু উল্টোদিকে এটাও ঠিক যে, যতই কোয়ারসিভ হোক, এক্সপ্লয়টেটিভ হোক, যেহেতু বেসিক ব্যাঙ্কিং সার্ভিস এখনও আমাদের দেশের সব জায়গায়, বিশেষ করে রিমোট গ্রামগুলোতে, পৌঁছতে পারেনি, এই ইনফরমাল লেন্ডাররা সাধারণ মানুষদের লাইভলিহুড সাপোর্ট করার ব্যাপারে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।” গোয়েন্দা উপন্যাসের লাইন হিসাবে খানিক বেমানান, কিন্তু যেখানে রহস্যের কেন্দ্রে রয়েছে কালো টাকার লেনদেন, সেখানে এমন ব্যাখ্যা করতে পারার ক্ষমতা তাৎপর্যপূর্ণ বটে। তাঁর অর্থশাস্ত্রী-সত্তাকে কী ভাবে এই গোয়েন্দা গল্পের লেখকসত্তার কাজে লাগানো যায় আরও বেশি করে, অভিরূপবাবু মনে হয় ভেবে দেখতে পারেন। বস্তুত, এখানে থেকে একটি নতুন ধারাই তৈরি হয়ে যেতে পারে, ফিকশন আর নন-ফিকশনের সহাবস্থানে।
আদিত্য মজুমদার চরিত্রটিতে আরও পরত প্রত্যাশা করবেন পাঠক। আদিত্য একা থাকেন, কোলাহল থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন, ধূমপায়ী, উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের ভক্ত— শুধুমাত্র এই বর্ণনায় যে মানুষটির ছবি তৈরি হয়, সে কেন দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা হয়ে উঠতে পারল, এই প্রশ্নের উত্তর উপন্যাসে ‘বিটুইন দ্য লাইন্স’ পেলে অবশ্যই ভাল হত। কোন শ্রেণির পাঠকের জন্য নির্মাণ করছেন লেখক, এই প্রশ্নটিও ক্রমেই গুরুতর হয়ে উঠছে। এবং, একটি আক্ষেপ— বাংলা প্রকাশনায়, বিশেষত গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে, প্রচ্ছদ বস্তুটি রীতিমতো পীড়াদায়ক হয়ে উঠছে দিন-দিন।