ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবের গল্প দিয়ে বাজার অর্থনীতির চরিত্র বোঝানো, কার্ল মার্ক্সকে বুঝতে টেনে আনা দ্য মেট্রিক্স সিনেমার প্রসঙ্গ— অর্থশাস্ত্রের প্রথাগত বইতে যা থাকার কথা নয়, টকিং টু মাই ডটার অ্যাবাউট দি ইকনমি-তে তার অনেক কিছুই আছে। কারণ, বইটা অর্থশাস্ত্রের প্রথাগত কেতাব নয়। ইয়ানিস ভারুফাকিস তাঁর অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কিশোরী কন্যাকে উদ্দেশ করে লিখেছেন বইটা— বাজার অর্থনীতির, পুঁজিবাদের, মূল কথাগুলোকে তার মতো করে বুঝিয়ে। তার চেয়েও বেশি, বাজার অর্থনীতি কী ভাবে চারিয়ে দিতে থাকে অর্থব্যবস্থার হরেক অসুখ, সে কথা বলেছেন। এমন ভাবে, যাতে তাঁর কিশোরী কন্যা বুঝতে পারে মূল কথাগুলো। তৈরি করে নিতে পারে নিজের রাজনীতি।
টকিং টু মাই ডটার অ্যাবাউট
দি ইকনমি: আ ব্রিফ হিস্টরি অব ক্যাপিটালিজ়ম
ইয়ানিস ভারুফাকিস
৫৯৯.০০
দ্য বডলে হেড
গ্রিসের অর্থব্যবস্থা যখন চূড়ান্ত টালমাটাল, তখন সে দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন ইয়ানিস ভারুফাকিস। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন দীর্ঘ দিন। কাজেই, অর্থশাস্ত্রের দুনিয়ার জার্গন-সঙ্কুল লেখাপত্রের সঙ্গে তাঁর বিলক্ষণ পরিচয় আছে। এবং, তিনি জানেন, অর্থশাস্ত্রীরা শুধু নিজেদের মধ্যেই কথা বলেন— কঠিন তত্ত্ব দিয়ে, কঠিনতর শব্দ দিয়ে এমন এক অদৃশ্য দেওয়াল নিজেদের চারপাশে তুলে দেন তাঁরা, যা টপকে তাঁদের আলোচনার দুনিয়ায় সাধারণ মানুষের প্রবেশ করার সুযোগমাত্র নেই। সেই দেওয়ালটাকেই ভাঙতে চেয়েছেন ভারুফাকিস। তাঁর কিশোরী কন্যা উপলক্ষমাত্র— এই বই আসলে তিনি তাঁদের জন্য লিখেছেন, অর্থব্যবস্থার আঁচ যাঁদের গায়ে লাগছে সর্ব ক্ষণ, কিন্তু সেখানে ঠিক কী চলছে, তাঁদের বোঝার কোনও উপায় নেই।
এবং, এই বইয়ের ছত্রে ছত্রে রাজনীতি। বাজার অর্থনীতির পরতে পরতে যেমন রাজনীতি লুকনো থাকে, ঠিক সে রকম, খালি উল্টো রাজনীতি। ভারুফাকিস লিখেছেন, ‘খুব সহজ ভাষায় বললে, ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি, সম্পদ দাঁড়িয়ে আছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভিত্তিতে।’ কেন, সেই ব্যাখ্যায় এসেছে ধনতন্ত্রের আদি যুগের কথা, যখন ব্রিটেনে চাষের জমিতে তৈরি হল কারখানা। তত দিন অবধি যাঁরা সেই জমিতে চাষ করতেন, থাকতেনও জমির ধার ঘেঁসেই, তাঁদের উচ্ছেদ করতে হল কারখানা তৈরি করার জন্য। রাষ্ট্রক্ষমতা— তখনকার দিনে রাজা এবং চার্চ— যদি জমির মালিকের পাশে না দাঁড়াত, যদি না কঠোর হাতে দমন করত উচ্ছেদ হওয়া কৃষিশ্রমিকদের যাবতীয় ক্ষোভ, সম্ভব হত কি এত সহজে কৃষির ভিত্তি থেকে শিল্পের ভবিষ্যতে পৌঁছে যাওয়া? প্রায় পাঁচ শতাব্দী পুরনো এই গল্প আজকের তারিখেও কী প্রচণ্ড রাজনৈতিক আর প্রাসঙ্গিক, বলে দেওয়ার দরকার নেই। আজকের কথাও অবশ্য বলেছেন ভারুফাকিস। বিপুলসংখ্যক মানুষের অপার দারিদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কিছু লোকের কল্পনাতীত ধনী হয়ে ওঠা কি সম্ভব হত, যদি না রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিত সেই ধনীদের? রাষ্ট্র যদি বলত যে এই অসাম্য ন্যায্যতার ধর্মের পরিপন্থী, সব মানুষের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে এই অসম অর্জন, তা হলে কি সম্ভব হত কিছু লোকের এমন অশালীন রকম ধনী হয়ে ওঠা? মুম্বইয়ের দিগন্তপ্রসারী বস্তির মধ্যে সেই সাতাশ তলা বাড়িটার কথা মনে পড়তে পারে। ভারুফাকিস মনে করিয়ে দিয়েছেন, করের টাকায় সরকার যে রাস্তাঘাট তৈরি করে, যে শিক্ষাব্যবস্থা চালায়, স্বাস্থ্যখাতে যে খরচ করে, সেগুলো না থাকলে পুঁজিবাদ চলতেই পারত না। কাজেই, পুঁজিবাদকে যদি প্রশ্ন করতে হয়, তবে সেটা সরকারকে বাদ দিয়ে নয়, রাজনীতিকে বাদ দিয়ে নয়। এই কথাটা তাঁর মেয়ের জানা দরকার। জানা দরকার আমাদেরও।
কী ভাবে তৈরি হল অসাম্য, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা থেকেই শুরু বইটি। একেবারে আদি সাম্যের সময় থেকে অসাম্যের উৎপত্তি দেখিয়েছেন ভারুফাকিস। ইউরোপের কিছু দেশ ক্রমে সাম্রাজ্যবিস্তার করল, কার্যত গোটা দুনিয়ার মালিক হয়ে বসল, অথচ অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের আদিবাসীরা পারল না নিজেদের জায়গাটুকুও রক্ষা করতে— কেন? ভারুফাকিস উত্তর দিয়েছেন, দ্বিতীয় দলের লোকদের সৌভাগ্যই তাদের দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দাঁড়াল। ইউরোপের দেশগুলো প্রকৃতির আনুকূল্য পায়নি। প্রকৃতি তাদের আপনা থেকে দু’হাত ভরে দেয়নি। নিজেদের খাবারটুকু উৎপাদন করার জন্য তাদের কৃষিব্যবস্থা শিখতে হয়েছে— এবং, কোনও ক্রমে পেট ভরার মতো খাবার উৎপাদন করার দিন পেরিয়ে তারা উৎপাদন করেছে উদ্বৃত্ত। সেই উদ্বৃত্ত রাখার জন্য ক্রমে ক্রমে তৈরি হয়েছে রাজা, তৈরি হয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এবং, সেই উদ্বৃত্তের লোভেই তারা দখল করতে শিখেছে পাশের জমি, তার পাশের জমি, তারও পাশের। অন্য দিকে, যে আদিবাসীদের প্রকৃতি ভরিয়ে দিয়েছিল ফলমূলে, তাদের আর মাটির থেকে উৎপাদন করতে কোনও বাড়তি চেষ্টা করতে হয়নি। তারা সময় দিয়েছিল নাচ-গানে, আঁকায়। উদ্বৃত্ত উৎপাদনের প্রয়োজন ছিল না তাদের, উদ্বৃত্ত সঞ্চয়েরও না। যুদ্ধ করার কৌশলও শেখা হয়নি তাই। ফলে, ইউরোপের কিছু সৈন্যসামন্ত এসে যখন কচুকাটা করল তাদের, দখল করে নিল ভিটেমাটি, আত্মরক্ষার উপায় ছিল না। যারা উদ্বৃত্ত উৎপাদন করতে শিখেছিল, বাজার ব্যবস্থায় জয়ী হল তারাই। আবার, তারা জয়ী হল বলেই বাজার ব্যবস্থাও জয়ী হল।
সেই আদি যুগ থেকে অর্থনীতি এগিয়েছে অনেক। কারখানার অ্যাসেম্বলি লাইনে কাজ করতে করতে ক্রমশ যন্ত্র হয়ে যাওয়া চার্লি চ্যাপলিনকে পেরিয়ে এখন রোবটের যুগ। গাড়ি থেকে মোবাইল ফোন, যে কোনও বড় কারখানায় এখন উৎপাদনের কাজটা মূলত হয় রোবটের সাহায্যে। তারা ছুটি চায় না, তাদের খিদে পায় না, তারা গর্ভবতী হয় না। বাজার ব্যবস্থা ক্রমে রোবটকেই শ্রমিকের পরিবর্ত হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করল। ভারুফাকিস এখানেই বলেছেন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবের গল্প। বাজার অর্থনীতি চলে লাভের তাগিদে। যন্ত্রের ব্যবহার যত বাড়ে, উৎপাদনের খরচ তত কমে, কিন্তু লাভও কমে। কারণ, প্রতিযোগিতার বাজারে সবাই চায়, একটু দাম কমিয়ে বাজারের দখল নিতে। এই উদগ্র দৌড়ে এক সময় বসে পড়ে সবচেয়ে কমজোরি উৎপাদকরা। তারা ধার শোধ করতে পারে না। অন্য দিকে, রোবট এসে দখল নিয়েছে শ্রমিকের কাজের, কিন্তু তাদের তো মাইনে নেই। তার চেয়েও বড় কথা, তাদের তো কিছু কেনার নেই। শ্রমিকরা মাইনে পেয়েই সে টাকা নিয়ে বাজারে দৌড়াত। কিনে আনতে সে সব পণ্য, কলকারখানায় তৈরি হয় যা। ফলে, বাজারে চাহিদা থাকত। রোবট এসে সেই লাভের টাকা কুক্ষিগত করেছে কিছু অসীম বিত্তবানের। তাদের আয়ের অতি সামান্য অংশ যায় ভোগ্যপণ্য কিনতে। ফলে, বাজারে ভাটা আসে। রোবটসভ্যতা ধ্বংস করে দিতে থাকে গোটা বাজার ব্যবস্থাটাকেই। মন্দার দিকে ঠেলতে থাকে বাজারকে। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানব যেন।
মার্ক্স-এর বিচ্ছিন্নতার কথা ভারুফাকিস বলেছেন দ্য মেট্রিক্স সিনেমার রূপক টেনে। সেখানে রোবট আর মানুষের দাস নয়, বরং তারাই দখল নিয়েছে মানুষের। শুধু শক্তির উৎস হিসেবে বাঁচিয়ে রেখেছে মানুষকে, তাদের আর কোনও কাজ নেই। অথচ, শুধু খাবারদাবার, জল পেলেই মানুষ বাঁচে না— তার একটা সামাজিক পরিসর দরকার হয়, স্বাধীনতা দরকার হয়। মেলামেশার প্রয়োজন হয় অন্যদের সঙ্গে। অতএব, সেই রোবটসভ্যতা তৈরি করে দিল এক ভার্চুয়াল রিয়ালিটি— যেখানে বন্দি মানুষের মাথার দখল নিল কল্পবাস্তব; একা একা বন্দি মানুষ ভাবল, সামাজিক পরিসরেই আছে। যন্ত্রনির্ভর বাজার ব্যবস্থা মানুষকে কোন বিচ্ছিন্নতায় নিয়ে যেতে পারে, মার্ক্স দেড়শো বছর আগে জানিয়ে গিয়েছিলেন। ভারুফাকিস সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিলেন হলিউডের সিনেমার ভাষায়— যে ভাষা সাধারণ মানুষ সহজে বোঝে।
সিসিফাস থেকে মেফিস্টোফিলিস, অনেক প্রসঙ্গই এসেছে ভারুফাকিসের লেখায়। অবশ্য তিনি নিজেই মনে করিয়ে দিয়েছেন, অর্থশাস্ত্র নিয়ে যাঁরা সত্যিই ‘ভাল’ লেখেন, তাঁরা অনেকেই পুরাণ-সাহিত্য-চলচ্চিত্র থেকে ধার করেন মৌলিক ধারণা। বইটা পড়তে পড়তে মনে হল, কেন যে ইয়ানিস ভারুফাকিস বাংলা জানেন না! নয়তো, তিনি নিশ্চয় সুধীন দত্তের কথায় খুঁজে পেতেন ধনতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থার প্রকৃত রোগটা— অখিল ক্ষুধায় সে সমানেই নিজে নিজেকে খেয়ে চলেছে।