—প্রতীকী চিত্র।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা প্রবন্ধগুলি নির্বাচন করে এখানে একত্রে বাঁধা হয়েছে তাদের ‘আন্তর সাদৃশ্য’-এর ডোরে, জানিয়েছেন লেখক। বুঝতে অসুবিধা হয় না, সংযোগসূত্রটি হল প্রবন্ধগুলির ভাবনায় অনুস্যূত হয়ে থাকা জীবন ও শিল্পের চিরন্তন টানাপড়েন। কবিরা যাঁরা এ গ্রন্থের কুশীলব, শিল্পের নান্দনিক দূরত্ব ও রাজনৈতিক বাস্তবতার অসহ্য নৈকট্য— এ দুইয়ের দ্বন্দ্ব তাঁদের তীব্র ভাবে আলোড়িত করে। বিশেষত, এই কবিরা যে-হেতু শিল্পের নৈর্ব্যক্তিক সাধক নন, ব্যক্তিগত জীবনে তাঁরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন গভীর সংরাগে। কিন্তু রাজনীতির ধারণাটি সেখানে বহুমাত্রিক; ভাষা, ধর্ম, সামাজিক সম্পর্ক, কিছুই তার আওতার বাইরে নয়। দলীয় অনুশাসন ও নান্দনিক বিশ্বাসের বিরোধ দেখা দিলে তার মোকাবিলা কবিরা করেছেন প্রত্যেকে তাঁদের নিজের মতো করে।
এ গ্রন্থে আলোচিত কবিরা বয়সে ও অভিজ্ঞতায় সমগোত্রীয় নন। তুলনামূলক ভাবে তরুণ কবিদের পাশাপাশি আলোচিত হয়েছেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। কিন্তু লেখক গ্রন্থের শুরুতেই জানিয়েছেন, তাঁর আলোচনার কেন্দ্রীয় বিভাব সত্তর দশকের কবিতা। যে কতিপয় তরুণ কবি সত্তর দশকে দেখা দিয়ে সে সময়েই মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁরা শিল্প ও রাজনীতির নান্দনিক দূরত্ব নিয়ে ভাবার সময় পাননি। এখানে এই কথাটি সর্বাগ্রে বলে নেওয়া দরকার যে, এই সব প্রায়-বিস্মৃত কবিদের আজকের পাঠকের দরবারে এনে এবং আলোচনার পরিসরে অন্য কবিদের পাশাপাশি তাঁদের আসন দিয়ে লেখক আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন।
শিল্পের বল্কল ছিঁড়ে ছিঁড়ে: সত্তর দশকের কবিতা ও অন্যান্য
সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়
৫০০.০০
আশাদীপ
বইটির ব্লার্বে উৎকলিত একটি উদ্ধৃতিতে কবি রণজিৎ দাশ জানাচ্ছেন, সত্তরের দশকে ‘সময়ের চাপে’ তাঁদের আত্মমুগ্ধতা বা আত্মমুখিনতা থেকে মুক্তি ঘটেছিল। ষাটের দশক দেখেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এক প্রতিবাদী যুবসমাজ। ভিয়েতনামের যুদ্ধ ক্ষমতাবান রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস জুগিয়েছিল। কবিতায় আত্মময়তা ও তা থেকে মুক্ত হয়ে বৃহৎ সংসারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বাসনা, এ দুইয়েরই মডেল লভ্য ছিল চল্লিশের দশকে। সে দিক থেকে দেখলে লেখক চল্লিশের দশকের কিছু কবিতায় যে সত্তরের দশকের পূর্বাভাস লক্ষ করেছেন সেটি যথার্থ। তবে আবেগের তীব্রতায় যা পূর্বসূরিদের কবিতায় ছিল স্ফুলিঙ্গ, তা এ দশকে আগুনের রূপ নিয়েছে। চল্লিশের কবিদের মধ্যে যে দু’জন কবি সে গৌরবের অধিকারী, তাঁরা সমর সেন ও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এঁদের মধ্যে সমর সেন কবিতার জগৎ ছেড়ে চলে গেছেন সাংবাদিকতায়। রাজনীতি ও শিল্পের বিরোধের প্রশ্নটি অমীমাংসিত থেকেছে। বরঞ্চ বুদ্ধদেব বসু তাকে দেখেছেন কবিতার সঙ্কট হিসেবে। পরবর্তী জীবনানন্দ সম্পর্কে তাঁর গড়ে ওঠা অস্বস্তি গোপন ছিল না। যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার শিল্পগুণ সম্পর্কে তিনি ছিলেন উচ্ছ্বসিত, তাঁর কবিতা ভরে উঠছে রাজনৈতিক প্রচারের শ্বাসরোধকারী বিষবাষ্পে (‘দ্য গ্যাস অব পলিটিক্যাল প্রোপাগান্ডা’), সে আশঙ্কা তিনি ব্যক্ত করেছিলেন চল্লিশের দশকেই প্রকাশিত তাঁর ইংরেজি রচনায়।
শিল্প ও রাজনীতির এ বিরোধাভাসটি তাত্ত্বিক বিতর্কে বন্দি না থেকে কী ভাবে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও কবি শঙ্খ ঘোষের অন্তর্জীবনকে আহত করছিল, লেখক তা দেখিয়েছেন তাঁদের নিয়ে লেখা রচনা ক’টিতে। দু’জনের সমস্যার প্রকৃতি যদিও আলাদা, তার ভিত্তি উভয় ক্ষেত্রেই রাজনীতির দখলদারি মনোভাব। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কমিউনিস্ট পার্টির দলীয় কর্মী না হলেও তাঁর উপরে যে ‘বিচ্যুতি’র দায় আরোপ করছিলেন পার্টির নেতারা, তার মূলে আছে তাঁর কবিতার মৌলিক মানবতাকে পার্টির প্রতি দায়বদ্ধতা বলে প্রচার করার চেষ্টা। পিছন ফিরে তাকালে তাঁর প্রতি তথাকথিত ‘দায়বদ্ধ’দের আচরণ অমার্জনীয় বলে মনে হয়। পার্টির প্রতাপমত্ততা নিয়ে শঙ্খ ঘোষ তাঁর নিজের লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। লেখক তাকে দেখেছেন রাজনীতি ও নান্দনিকতার সম্পর্কের কেন্দ্রীয় প্রশ্নটির সঙ্গে যুক্ত করে।
আগেই বলা হয়েছে, এই গ্রন্থের কেন্দ্রীয় বিষয় সত্তরের দশকের বাংলা কবিতা। কবিদের ক্ষেত্রে দশক-বিভাগটি বিভ্রান্তিকর হলেও এই দশকের কবিতাগুলিকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করাই যায় তার আগ্নেয় পরিসীমার জন্য। নকশাল আন্দোলনে উত্তাল ও হত্যার ধারাবাহিকতায় চিহ্নিত এই সময়ে লেখা কবিতাগুলি ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলা কবিতার ধারায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো রয়ে গেছে। তাদের উচ্চকিত উচ্চারণ সর্বসম্মত ভাবে শিল্পের মান্যতা পায়নি। বাংলা কবিতার সঙ্কলনে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আজও স্বীকৃত নয়। নকশালবাড়ি আন্দোলনের সমান্তরাল এক ভাঙার প্রকল্প চেয়েছে প্রথাগত শিল্পের অচলায়তনটিকে ভাঙতে। সে চেষ্টা সফল হয়নি। ক্ষমতাবান কবির অভাব ছিল না, শিল্প ও রাজনীতির দোলাচলে আটকে থেকে তাঁরা বাংলা কবিতায় কোনও বিকল্প মডেল গড়ে তুলতে পারেননি। লেখক যথেষ্ট উদ্ধৃতি দিয়ে কিছুটা হলেও মণিভূষণ ভট্টাচার্য, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জিত গুপ্ত প্রমুখের কবিতার ধারণা দিতে চেয়েছেন। সত্তরের দশকের আগে ও পরে প্রসারিত তাঁদের সৃষ্টিকর্মের গুণাগুণ ভাবী কাল বিচার করবে।
বইটি মুদ্রণ-প্রমাদে আকীর্ণ। যাঁরা এটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন, তাঁদের এ ব্যাপারে আরও যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন ছিল।