ঐতিহাসিক: সুধী প্রধান ও বিজন ভট্টাচার্য, নবান্ন নাটকের দৃশ্যে Sourced by the ABP
স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে বাংলা থিয়েটারের সম্পর্ক প্রসঙ্গে এই প্রবন্ধ সঙ্কলনটির পরিকল্পনা ও প্রকাশনা পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির। সঙ্কলনটিতে অনির্বাণ রায়ের লেখা ‘প্রাক স্বাধীনতা পর্বে কমিউনিস্ট আন্দোলন’ শিরোনামে একটি সুচিন্তিত প্রবন্ধ রয়েছে; আছে উৎপল দত্ত, বিজন ভট্টাচার্য প্রমুখের একাধিক নাটক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। অনির্বাণ উল্লেখ করেছেন, ১৯৪৬ সালে শিশিরকুমার ভাদুড়ির প্রযোজনায় শ্রীরঙ্গমে অভিনীত তুলসী লাহিড়ীর নাটক দুঃখীর ইমান-এর। বাংলা নাটকের নামে ‘ইমান’-এর মতো শব্দের তেমন দেখা মেলে না। এ নিয়েও গবেষণা হতে পারে যে, দীর্ঘ সময় ধরে গঙ্গাপাড়ের বাংলা নাটকের নামে ঐতিহাসিক চরিত্রদের নাম ও কতিপয় ব্যতিক্রম ছাড়া, কেন তৎসম, তদ্ভব শব্দেই নাটককার ও পরিচালকেরা বেশি স্বচ্ছন্দ। ‘বাংলা নাটকে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক সম্বন্ধ— সেই ট্র্যাডিশন...’ নিবন্ধে তীর্থংকর চন্দ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের রাণা প্রতাপ সিংহ প্রসঙ্গে সংলাপের ‘প্রচ্ছন্ন ঝোঁক’ নিয়ে লিখেছেন। সঙ্কলন গ্রন্থপাঠের আনন্দ হল, এই গ্রন্থেই দেখি প্রভাতকুমার দাস সরাসরি ‘বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও বাংলার রঙ্গালয়’ সম্পর্কে রাণা প্রতাপ সিংহ প্রসঙ্গেই লিখছেন, ‘আকবরের কন্যা মেহেরউন্নিসা আর প্রতাপের কন্যা ইরার পারস্পরিক আকর্ষণের ভিতর দিয়ে অন্ধ ধর্মের প্রাচীর ভেঙে মহামিলনের বার্তা’ দেওয়া হয়েছে। সুরঞ্জনা দাশগুপ্তও নীলদর্পণ-এ নবীনমাধবকে উড হত্যা করলে তোরাপের সংলাপ উদ্ধৃত করে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সে নাটক যখন অভিনীত হয়, তখন জাতীয় কংগ্রেস গড়ে ওঠেনি এবং বাঙালির নিজস্ব ধারায় সূচিত ছিল জাতীয়তাবাদ। নীলদর্পণ-কে এ কালের চিন্তাচর্চায় কেমন ভাবে দেখা যায়, সে কথা পার্থ চট্টোপাধ্যায়, রণজিৎ গুহর পর্যবেক্ষণ-সহ আলোচিত হয়েছে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের লেখায়। এমনই বিশ্লেষণ মেলে কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের ‘নীলদর্পণের মিথ ও বাস্তবতা’ প্রবন্ধে।
আবার, অভীক মজুমদার খেয়াল করেছেন, ১৯০৫ সালে গিরিশচন্দ্র ও ১৯৩৮ সালে শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত সিরাজদ্দৌল্লাকে নিয়ে জনপ্রিয় নাটক লিখলেও, উনিশ শতকে সিরাজকে নিয়ে কেন নাটক লেখা হয়নি? এই গ্রন্থেই গিরিশের নাটকটি সম্পর্কে প্রভাতকুমার দাসের পর্যবেক্ষণ, “এই বিপুল দর্শক সমাগমের প্রধান কারণ— বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের যে বাতাবরণ তৈরি করার উদ্যোগ, তা এই নাটকের মধ্য দিয়ে প্রচার পেয়েছিল।” সেই মনোভাবের গুরুত্ব যে সঙ্গত কারণে বেড়েই চলল, তা অভীকও বলছেন, “অখণ্ড বাংলা, অখণ্ড ভারত এবং সম্প্রীতির দেশভূমি শচীন্দ্রনাথের সিরাজের স্বপ্ন।” তবে অভীক মনে করিয়ে দিয়েছেন, “ভূমিকায় শচীন্দ্রনাথের ‘শাসকমণ্ডলী’র প্রতি সপ্রশংস মনোভাব”-এর কথা। এই প্রসঙ্গেই উল্লেখযোগ্য, চিরন্তন সরকার দেখছেন, এই আবেগজর্জর সময়ে “কত ভাবে বিভক্ত ছিল দেশীয় সমাজ এবং কীভাবে তা যে-কোনও জাতীয় সংকল্পকে দুর্বল করার ক্ষমতা পেয়েছিল— সেই অভিমুখে আলোচনার একটা নেপথ্য মেলে রবীন্দ্রনাথের নাটকে।”
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাংলার থিয়েটার
সম্পা: ব্রাত্য বসু
৫৬০.০০
পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি
পাঠকের কাজ, সব দৃষ্টিকোণকেই সমান মনোযোগে খেয়াল করা। তাই তিনটি অধ্যায়ে সঙ্কলিত সাতাশটি প্রবন্ধ মিলিয়ে পড়লে পাঠক একটা বড় ও উত্তাল সময় সম্পর্কে নানা তথ্য পাচ্ছেন। যেমন, সুরঞ্জনা উল্লেখ করেছেন, বঙ্গিমচন্দ্রের চন্দ্রশেখর-এর গিরিশচন্দ্র কৃত নাট্যরূপ কেমন ভাবে অপরিবর্তিত ভাবেই দীর্ঘ দিন অভিনীত হয়েছিল। বিনোদিনীর আত্মচরিত থেকে উদ্ধৃতি ও ঐতিহাসিক তথ্য ধরে ধরে তিনি দেখিয়েছেন, জনমানসে নাটক, মুকুন্দদাস, নজরুল, হেমেন্দ্রকুমারের নাটকের গান কতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। বাংলা মঞ্চে এই সময়ে শেক্সপিয়রের অবদানও আলোচিত হয়েছে সবিস্তারে।
তাই এই সঙ্কলনে বাংলার সংস্কৃতিরই একটি ইতিহাস যেন বিবৃত হয়েছে। যেমন, পরিচয় পত্রিকার ইতিহাসও প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে, নবান্ন প্রসঙ্গে বিজন ভট্টাচার্যের বিভিন্ন সময়ে করা মন্তব্যগুলি পড়ে নেওয়া যায়। বিভিন্ন গ্রন্থের প্রচ্ছদ, অভিনেতা, নাটককার, পরিচালক, নানা উপন্যাসের বিভিন্ন সংস্করণের ছবি রয়েছে। শেখর সমাদ্দারের ‘স্বদেশচিন্তা ও বাংলা উপন্যাসের নাটকরূপ’ নিয়ে পৃথক আলোচনাও রয়েছে। তৃপ্তি মিত্রের বিদ্রোহিনী নাটকটির কথা উল্লেখ করে স্বাতী গুহ ‘ন্যাশনাল’-এর ধারণা গড়ে ওঠার কথা এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নারীর ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। স্বদেশভাবনায় বাংলা নাটকে মেয়েদের নিয়ে লিখেছেন শম্পা ভট্টাচার্যও।
সেই রেশ ধরেই শোভন তরফদার সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা-র সঙ্গে আশ্চর্য সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন কাপ্তেন বেণী-র। টিনের তলোয়ার প্রসঙ্গে তিনি লিখতে পারেন, “এই শহরে থেকেও মথুর ভিন্ন একটি শহরের বাসিন্দা।” তাতে স্বাধীনতার নানা মাত্রা কেমন করে উৎপল দত্তের নাটকে ফুটে ওঠে, তার বিবরণে শোভন অকুণ্ঠ। তিনি উত্তর-আধুনিক তত্ত্বের আলোয় একটি বিশেষ সময়ের একটি বিশেষ নাটককে দেখতে চেয়েছেন। ভাস্কর লেটের কল্লোল নিয়ে লেখাটিও সেই ধারার। সত্য ভাদুড়ি একলা চলো রে প্রসঙ্গে দেশভাগ ও গান্ধীর ভূমিকার উৎপল দত্তের ব্যাখ্যা হাজির করেছেন।
তাই এই সঙ্কলনে নাট্যসূত্রে বাঙালির চিন্তার্চচারই ঐতিহ্যের সঙ্গে সমকালের সন্ধি হয়েছে।
অলখ মুখোপাধ্যায়