১৯৭৪ নাগাদ, প্রকাশের দশ বছর বাদে ক্রীতদাস ক্রীতদাসী-র চার গল্প পাঠ, সেই বইয়ে এক অভূতপূর্ব ভূমিকায় প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রের বিরোধিতা, সেই বই নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভবিষ্যদ্বাণী, সব অতীতের পর সেই ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার অদ্বিতীয় নায়ক’ (অরুণেশ ঘোষ বন্দিত) যখন গান স্যালুটে মাথা ঘুরিয়ে নিলেন না, টের পেয়েছিলাম এই কাহিনিও তিনি প্রায় লিখে গেছেন, ‘অন্ধস্কুলে ঘণ্টা বাজে’ গল্পে— সেই বিড়ালের হাঁ মুখে প্রবিষ্ট ইঁদুর, অলস আর বিশ্রামরত বিড়ালের লেজে পা পড়লেই তবে না সে খ্যাঁক করে উঠবে বিরক্তিতে, ইঁদুর চলে যাবে মুখের ভিতরে। অন্ধস্কুলে ছুটির ঘণ্টা পড়লেই তা সম্ভব। তাঁর জন্য গান স্যালুট, তিনি যেন তখনও নিঃশব্দ মৃত্যুর হাঁ মুখে। বন্দুকের শব্দে বিড়ালের ঘুম ভাঙল। সেই দিনটির কথা মনে পড়ে... সেই শবযাত্রায় নীরব অনুসরণ।
কিন্তু তিনিই বলেছিলেন, “আসল এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধিতা হল ক্রিয়েটিভ লেখা দিয়ে। বিরোধী রচনারীতি মনন ও মেধা দিয়ে। একমাত্র লিখেই লেখক হওয়া যায়…।”
‘অসামান্য সন্দীপন’ শিরোনামে শঙ্খ ঘোষ যা লিখেছেন, সন্দীপনকেই উল্লেখ করে, ‘একক প্রদর্শনী’র ভূমিকার মতো একটি লাইনে, “আপনাদের যাঁদের গল্পটা ভালো লাগল তাঁরা অনুগ্রহ ক’রে আমাকেও ভালবাসুন, কেননা, আমি ও আমার গল্প একই। নমস্কার।” ওই বই তাঁকে উপহার দেওয়ার সময় (১৮/৬/৭১) সন্দীপন, ‘আমি ও আমার গল্প একই’ বাক্যাংশে তাঁর স্পষ্ট ও খরতাময় অক্ষরের হাতের লেখায় ‘একই’ শব্দের আগে লিখেছিলেন ‘কতকটা’।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে দুটো একটা কথা যা আমরা জানি
সম্পাদক: অদ্রীশ বিশ্বাস ও
প্রবীর চক্রবর্তী
৫৫০.০০
৯কাল বুকস
তাঁর লেখায় তিনি কতটা আছেন, কতটা নেই এই সংশয় তৈরি করে দিয়ে সন্দীপন থাকেনই তাঁর সমস্ত লেখায়। শঙ্খ ঘোষের লেখায় অধরা সন্দীপন ধরা পড়েন এই ভাবে: “সেই এক সময়, যার অনেকটাই জানি না, কেউ কেউ মনে করছেন সন্দীপন ফুরিয়ে যাচ্ছেন কি না, এই সংশয়ের দিনগুলি নিয়ে লেখাটি পড়তে পড়তে থেমে আবার পড়তে হয়। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে অনুভব করতে করতে এই লেখা শেষ হয়েও শেষ হয় না।”
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত তাঁর ‘কিছু স্মৃতি, কিছু সন্দীপন’ শিরোনামে লিখেছেন, “…আমরা যাকে আধুনিক বলে নির্ধারিত করে থাকি সেই কবিতা আর মূল কবির সম্পত্তি নয়, জঙ্গম এক উত্তরাধিকার। আরো পিছিয়ে বলা সম্ভব, সেই কবিতা এখন পাঠকের আত্মজীবনীর অন্তর্গত। সন্দীপনই বোধহয় এই সূত্রটি প্রথম আমাদের ধরিয়ে দিয়েছিলেন…।” সন্দীপনের গদ্যরীতি নিয়ে কথা বলতেই এই কথা।
সন্দীপনের গদ্যভাষার অনুগত পাঠক দেবেশ রায় লিখেছেন তাঁর গদ্যের যে সামাজিক শিকড়, তা না চিনে নেওয়ার কথা। গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের নাগরিক ও গ্রামীণ সমাজ যে ভাবে বদলে গেছে, তার নতুন কথা বলতে পুরনো ভাষায় কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। তাই সন্দীপন।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এই বই তাঁরই গল্পের শিরোনাম ভেঙে: ‘…সম্পর্কে দুটো একটা কথা যা আমরা জানি’। একচল্লিশ জন লেখকের লেখায় ভরা এই বই তাঁর পক্ষে বিপক্ষে। এঁদের কেউ তাঁর অগ্রজ শঙ্খ ঘোষ, সমসাময়িক দেবেশ রায়, উৎপলকুমার বসু, অনুজ অশোক দাশগুপ্ত, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, কিন্নর রায়, রবিশঙ্কর বল, কৃষ্ণরূপ চক্রবর্তী প্রমুখ। এবং অদ্রীশ বিশ্বাস।
আটটি সাক্ষাৎকার কখনও হয়েছে ইঁদুর-বিলাই খেলা, কখনও সেয়ানে সেয়ানে, বা সমানে সমানে। কথার জালে তিনি জড়িয়ে নিয়েছেন, জড়িয়ে পড়েছেন। মূল্যবান সাক্ষাৎকারগুলির সন তারিখ নেই। মূল্যবান প্রয়াত সম্পাদক অদ্রীশ বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আলাপন। এই আলাপনেই সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে একটা দুটো নয়, অনেক কথাই পাঠকের জানা হয়ে যায়।