কিছু নবীন যুবার দল বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার গড়ে ১৮৬৮-র দুর্গাসপ্তমীর রাতে মঞ্চস্থ করল দীনবন্ধু মিত্রের প্রহসন সধবার একাদশী। এক সাহেবি কোম্পানির বুককিপার, দলের নাট্যনেতা, ‘নৈরাশ্য-পীড়িত মদ্যপ’ নায়ক নিমচাঁদের ভূমিকায় মঞ্চ মাতালেন তিনি, গিরিশচন্দ্র ঘোষ। অমৃতলাল বসুর কলমে: “মদে মত্ত পদ টলে/ নিমে দত্ত রঙ্গস্থলে/ প্রথম দেখিল বঙ্গ/ নব নটগুরু তার।”
বঙ্গরঙ্গমঞ্চে শুরু হল গিরিশ-পরম্পরা। নট গীতিকার নাট্যকার নির্দেশক সর্বোপরি প্রযোজক— যাত্রা-কথকতা-পাঁচালির গীতিময় ঐতিহ্য আর ইউরোপীয় থিয়েটারের মেলবন্ধনে নতুন যুগ। উৎপল দত্তের ব্যাখ্যায়, “গিরিশ নাট্যকৌশল ছাড়াও আরো অনেক কিছু। নাটকগুলির লোমহর্ষক বহিরংগে আবদ্ধ না থেকে আমরা যদি সেগুলির অন্তস্থলে পৌঁছবার চেষ্টা করি, তবে দেখবো গিরিশ ভারতের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার তো বটেই, তাঁর কোনো কোনো রচনা বিশ্বনাট্যসাহিত্যে স্থান পাওয়ার যোগ্য। আধুনিকতায় তিনি... বের্টল্ট ব্রেখট-এর এপিক থিয়েটারে সমাবিষ্ট। জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টদের আবির্ভাবের পূর্বেই তিনি এক্সপ্রেশনিজম-এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগকর্তা, মানব চরিত্রের জটিল ও দ্বন্দ্বময় বিকাশে তিনি কখনো বা শেক্স্পিয়ারের যোগ্য ছাত্র।”
গিরিশের জীবদ্দশায় শ্রীশচন্দ্র মতিলাল, অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় এবং কুমুদবন্ধু সেনের কলমে জীবনকথা প্রকাশের পর তাঁকে না-দেখা জীবনীকার হেমেন্দ্রপ্রসাদ দাশগুপ্তের (১৮৭৮-১৯৬২) লেখায় ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশ পায় গিরিশ প্রতিভা। বিধানচন্দ্র রায়ের সহপাঠী হেমেন্দ্রনাথ আইনি পেশায় সহকারী ও অনুগামী ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের। স্বদেশি কার্যকলাপের পাশাপাশি রচনা করেছেন চার খণ্ডের দ্য ইন্ডিয়ান স্টেজ ও ভারতীয় নাট্যমঞ্চ। গিরিশ প্রতিভা তেরো পরিচ্ছেদের সমাহার, ‘গার্হস্থ্য জীবন’, ‘নট জীবন’, ‘ধর্ম্ম জীবন’, ‘গিরিশ-নাটকে রামকৃষ্ণ প্রভাব’, ‘জাতীয়তায় গিরিশচন্দ্র’, ‘গিরিশ ও বিবেকানন্দ’, ‘ঐতিহাসিক নাটক’, ‘সামাজিক নাটক’, ‘পৌরাণিক নাটক’, ‘রঙ্গমঞ্চে গিরিশের স্থান’ ইত্যাদি। গিরিশচন্দ্রের নাটকগুলিকে চুলচেরা বিচার করেছেন হেমেন্দ্রনাথ, কোনও কোনও ক্ষেত্রে মতের সাযুজ্য না থাকলেও লেখকের আলোচনায় যৌক্তিক পরম্পরা অনস্বীকার্য।
গিরিশ প্রতিভা
হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, সম্পা: শম্পা ভট্টাচার্য
৭০০.০০
প্রতিভাস
গিরিশচন্দ্রের নাট্যরচনা ও অভিনয় সম্পর্কে সংবাদপত্রের মতামতের সংযোজন সমকালের দর্শকভাবনাকে প্রসারিত করে। হেমেন্দ্র-সমীক্ষায়, “গিরিশচন্দ্রের স্বদেশপ্রেম খাঁটি বাঙালির স্বদেশপ্রেম, তাঁহার রাজনীতি গভীর দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত... তাহার প্রথম ভিত্তি জাতির আত্মবোধ জাগরণের পথ আত্মনির্ভরশীলতায় ও আত্মত্যাগে।” গিরিশ ও বিশিষ্টজনের সখ্য, গিরিশের অধ্যাত্মবোধ, জাতীয়তাবাদ, স্ত্রী-শিক্ষার ক্ষেত্রে অনুধ্যান প্রকাশিত এ গ্রন্থে, গিরিশের ভাবনায় হিন্দু-মুসলমান মিলনগাথার কথাও। লেখকের ভাষায়, “গিরিশ রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করিয়া, নিজে নাটক লিখিয়া, নাটকের শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা করিয়া, স্বয়ং অভিনয় করিয়া, অভিনয়ের উচ্চাদর্শ দেখাইয়া ‘রঙ্গালয়কে’ জাতীয় শিক্ষামন্দিরে পরিণত করিয়াছিলেন।” ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত বইটি আবার প্রকাশ পেল শম্পা ভট্টাচার্যের পরিশ্রমী সম্পাদনায়। হেমেন্দ্রনাথের সাধুভাষা, সাবেক বানান, কোথাও কোথাও বানানের ভিন্নতাও অক্ষুণ্ণ। অতীত অস্মরণের আড়াল থেকে শ্রমসাধ্য উদ্ধারে প্রতিটি পরিচ্ছেদে সম্পাদক সংযোজন করেছেন টীকা। তবে সুসম্পাদিত বইটিকেও ছাপাখানার ভূত পিছু ছাড়েনি, দ্বিত্বে, বানানে বা মুদ্রণে।