কয়েক দশক ধরে সুধীর চক্রবর্তীর নানান ব্যক্তিগত রচনা পড়তে পড়তে অনেক বারই মনে হয়েছে, তিনি যা দেখেন তা-ই লেখেন, আর সেই লেখায় নিজেকে, নিজের অনুভূতি আর ভাবনাগুলিকে অনায়াসে মিশিয়ে দেন। তাঁর বহু অভিজ্ঞতার বিবরণে গল্পের স্বাদ পেয়ে এসেছি, আবার একই সঙ্গে অনুভব করেছি যে, তা গল্প হলেও সত্যি। ২০১৯ সালের বড়দিনে প্রকাশিত এই সঙ্কলন সম্পর্কে লেখক জানিয়েছিলেন, ২০১৫ থেকে ২০১৮, তিন বছরে নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ‘পঞ্চাশটি মিতায়তন গদ্যে পঞ্চাশ রকম অভিব্যক্তি’ ধরা আছে। সেই সব অভিব্যক্তির অসামান্য স্বাদে টইটম্বুর লেখাগুলিতে জীবন আর কাহিনি অসঙ্কোচ কৌতুকে এগিয়ে এসে একে অপরের হাত ধরে, মনে হয় লেখক যেন অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছেন, চোখের কোণে একটু হাসি।
যেমন ধরা যাক সঙ্কলনের নামটি। ‘আত্মপক্ষ’ নামাঙ্কিত প্রস্তাবনায় সুধীরবাবু লিখেছেন, অনেক দিন আগে মৃণাল সেনের মুখে শুনেছিলেন দক্ষিণ ভারতের একটি প্রবচন— তুমি চলো মেঘে মেঘে, আমি চলি তারায় তারায়। বেশ লেগেছিল তাঁর, আমাদের ‘তুমি চলো ডালে ডালে আমি চলি পাতায় পাতায়’ কথাটির মতো ‘পাল্লাদারি’ নেই এই দক্ষিণী প্রবচনে। লেখক জানান, “আমার এই সদ্যতন বইটির নামকরণের ব্যাপার নিয়ে এটুকুই আত্মকথন।” প্রবচনটি ফিরে আসে ‘মেঘে মেঘে তারায় তারায়’ শিরোনামের একটি লেখার উপসংহারে। সে এক বিষণ্ণ কৌতুকের আশ্চর্য বৃত্তান্ত। প্রবীণ গৃহকর্তার দীর্ঘ দিনের বন্ধু উমেশ আসতে চান এক বার, ক’দিন কাটিয়ে যেতে চান বন্ধুর বাড়িতে। শুনেই বৌমার প্রবল আপত্তি, “ডিসেম্বরে সোনাইয়ের একজাম, না না ওকে কোনওভাবে কনসেনট্রেশনে বাধা দেওয়া যাবে না।” অতএব গৃহকর্তা লেখেন, “বুঝলে উমেশ, যে সময় তুমি আসতে চাইছ, সে সময় বাড়িতে মিস্ত্রি লাগবে। সবকটা মেঝেতে মার্বেল বসানো হবে, ছেলের আবদার।... তবে বুঝি অবশ্যই আসবে কিন্তু, এই ধরো জানুয়ারিতে।” কিন্তু জানুয়ারি আসার আগেই উমেশ এক দিন সকালে বিরাট এক খাবারদাবারের প্যাকেট হাতে এসে হাজির হলেন। এসেই জানিয়ে দিলেন, ঘাবড়ে যাওয়ার কারণ নেই, তিনি কাছেই একটা লজে উঠেছেন। বাড়ির বৌমাকে ডেকে জানিয়ে দিলেন, চা-জলখাবার খেয়েই এসেছেন, বন্ধুর সঙ্গে একটু দেখা করেই চলে যাবেন। তার পর বিমূঢ় বন্ধুকে বললেন, “কী ফ্রেন্ড? ছেলেবউয়ের খ্যাঁচাকলে পড়েছ তো? শোনো বাপু, তুমি চলো মেঘে মেঘে আর আমি চলি তারায় তারায় বুঝলে? কই মার্বেল মেঝে দেখাও।” সুধীরবাবুকে আজ আর জিজ্ঞেস করার সুযোগ নেই, বইয়ের প্রস্তাবনায় মৃণাল সেনের গল্পটি শুনিয়ে দেওয়ার সময় তিনি কি খেয়াল করেছিলেন যে উমেশ ছদ্মনামের রহস্য ফাঁস হয়ে যাচ্ছে? তবে, জানি নিশ্চয়, এ প্রশ্ন শুনলে তিনি মুচকি হেসে বলতেন, “কী মনে হয়?”
সঙ্কলনের অনেক লেখাতেই মিশে থাকে বিষাদ আর কৌতুক। সদর-মফস্সলের মধ্যবিত্ত জীবনের নানান আধুনিক অসঙ্গতি নিয়ে কৌতুক, আর সবাই মিলে বেঁচে থাকার শেকড়বাকড় হারিয়ে ফেলার যে দুর্ভাগ্য সেই অসঙ্গতির গভীরে, তা নিয়ে বিষাদ। ‘পরিজন কথা’ নামের লেখাটির শুরুতেই শুনি সমাজ-সংলগ্ন জীবন থেকে উঠে আসা প্রজ্ঞার সহজ স্বর: “মানুষের সমাজে বেঁচেবর্তে থাকতে গেলে, নিজেকে একটু প্রসারিত করতে হয়। তখন ওঠে পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিজন আর আত্মীয়দের কথা আর অবশ্যই তাঁদের মাঝেমধ্যে আসাযাওয়া।” এ-কথার পরেই পরস্পর জড়িয়ে থাকা সাহিত্য আর জীবনের অমোঘ মায়ার টানে লেখক পৌঁছে যান অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে, যেখানে বাস করে নিঃসঙ্গ কুঞ্জবিহারী: “আত্মীয় কেহ নাই নিকট কি দূর/ আছে এক লেজকাটা ভক্ত কুকুর।” পড়তে পড়তে ভাবি, ভাঙা মন্দিরের জীর্ণ ফাটল ধরা এক কোণে নিস্তব্ধ দুপুরে দু’টি নিঃসঙ্গ প্রাণী একে অন্যের আশ্রয় হয়ে শুয়ে আছে— “কেউ কাউকে কিছু দিতে পারবে না। কিন্তু দেবে সঙ্গ আর উষ্ণতা।” চোখ বুজলে দেখতে পাই তাদের দু’জনকে। দুই বন্ধুকে। আমাদের ফ্রেন্ড লিস্টে এখন ব্রিগেড ভরে যায়, কিন্তু উষ্ণতা?
মেঘে মেঘে তারায় তারায়
সুধীর চক্রবর্তী
৩৫০.০০
মুদ্রা প্রকাশনী
সুধীর চক্রবর্তীর স্বভাবলীন কৌতুক তাঁর বিষণ্ণতাকে কিছুতেই মনোভূমির দখল নিতে দেয় না। এমনকি মৃত্যু বিষয়ক লেখাও ক্রমাগত আমাদের এই মেকি নাগরিকতাকে নিয়ে রঙ্গ করে চলে। ‘মৃত্যুর রঙ সাদা’ লেখায় নিরাসক্ত ভাবে বর্ণনা করেন তিনি, ‘শোকে তাপে মলিন, ক্রন্দনে বিধুর’ একটি পারিবারিক ঘটনা থেকে মৃত্যু ব্যাপারটা কেমন করে এক পোশাকি উদ্যাপনের উপলক্ষ হয়ে উঠল, যে উপলক্ষে এখন সবাই সাদা রঙের ড্রেস কোড মেনে চলেন, কারণ সিনেমা আর সিরিয়ালে তেমনটাই দেখেন তাঁরা। কোড তো কেবল পোশাকের নয়, যে কোনও মৃত্যুর খবর পেলেই সবাই সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে টাইপ করতে শুরু করেন ‘ও মাই গড’! আবার, হাসির ছলে কখন যে মেঘ ঘিরে আসে, তারও কোনও হিসেব নেই। একটি অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন সুধীরবাবু। “আমার এক ছাত্র তার বাবার শ্রাদ্ধের পরের দিন ভোজের শেষে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল তার ঘরে। একটা স্টিল আলমারি খুলে দেখাল, ‘দেখুন স্যার, অন্তত পঞ্চাশ-ষাটটা পিস শার্ট আর প্যান্টের কাপড় আমাকে দিয়ে গেছেন নিমন্ত্রিতরা, অনেকে খামে করে টাকাও দিয়ে গেছেন’ বলে সে কাঁদতে কাঁদতে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘বাবা চলে গেলেন বলে এত কাঁদিনি, কিন্তু আমি কি ভিখিরি? সকলে এসব কেন দিয়ে গেলেন বলতে পারেন?’”
আড়াইশো পৃষ্ঠা জুড়ে ছড়িয়ে আছে দৈনন্দিন চলার পথ থেকে সযত্নে তুলে আনা অজস্র মণিমুক্তো। লোকজীবনের গভীরে অন্বেষণ ছিল সুধীর চক্রবর্তীর সাধনা, যে সাধনা তাঁকে এক স্বকীয় দৃষ্টি দিয়েছিল। সেই দৃষ্টিতে চার পাশের সমাজকে দেখতেন তিনি, পড়তেন সেই সমাজের মন, যে মনে হাজার অস্থিরতা আর রকমারি ক্লেদ ছাপ ফেলে চলেছে, বিষিয়ে দিচ্ছে মানুষের সামাজিক অস্তিত্বকে, এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতাও হয়ে উঠছে রাজনীতির কৌশল। এই গ্লানিময় প্রতিবেশ তাঁকে পীড়া দিয়েছে, কিন্তু তিনি জানতেন, “সেসব পরিধির বাইরে রয়ে গিয়েছে বিরাট জনসমাজের হাজার হাজার মানুষ।... সবাই তারা যে শিক্ষিত, তৎপর বাক্যবাগীশ বা স্মার্ট, তা নয়। তবে এটা পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখেছি যে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ কাকে বলে— তারা তা আলাদা করে জানে না, মাথাও ঘামায় না। বেশ মিলেমিশেই থাকে, সুখে-দুঃখে, খেতেফসলে, নৌকো পারাপারে।” শেষ অবধি এই লোকসমাজেই ভরসা রাখেন তিনি।
এবং ভরসা রাখেন প্রান্তিক মানুষের নাছোড় প্রত্যয়ে। ‘এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে’ শিরোনামের লেখাটি শেষ হয় দোয়াতালির কাহিনিতে। সত্তরের দশকে নদিয়ায় ফকিরি সাধনার অনুসারী ‘খুশি বিশ্বাসী সম্প্রদায়’-এর খোঁজ করতে গিয়ে গ্রামের মুরুব্বিদের কাছে শুনেছিলেন, “ওরা ভণ্ড, ওরা ভ্রষ্ট। ওরা কেউ বেঁচেও নেই।” কিন্তু এক সাধারণ গ্রামবাসী সঙ্গোপনে জানালেন, মুরুব্বিরা ঠিক বলছেন না, সম্প্রদায়ের এক জন এখনও আছেন। নিয়ে গেলেন তিনি সেই এক জনের কাছে। দোয়াতালি বিশ্বাস। অন্ধকার বাঁশবন পেরিয়ে একটি চালাঘর, অপ্রশস্ত উঠোনের এক পাশে একটি ঢিবি। “সেখানে আমাকে নিয়ে গিয়ে ঢিবিতে সেলাম জানিয়ে দোয়াত বলল, ‘এইখানে কবরে শুয়ে আছেন খুশি মুর্শেদ। কতশত বছর পার হয়ে গেল। আমি তাঁর পাঁচপুরুষের অধম সন্তান। অক্ষম, অসার, গরিব। কোনওরকমে অন্যের জমিতে মুনিশ খেটে বেঁচে আছি। সন্ধেকালে মুর্শেদের মাটিতে হরদিন চেরাগ জ্বালি। ধুপধুনো কোথায় পাব? গাঁয়ের কেউ আমাকে মনুষ্য ভাবে না। কিন্তু...’ বলে শীর্ণ বুকে এক চাপড় মেরে হুংকার দিয়ে গর্জে উঠল, ‘কিন্তু তিনি আজও আছেন। আমি তাঁর বংশ।’ তার ক্ষীণ রিক্ত চেহারার স্পর্ধিত হুংকার শুনে বললাম, ‘কিন্তু দোয়াতালি, তুমি তো একা।’ সে বলল, ‘এক চন্দ্র, এক সূর্য, এক আল্লা, এক মুর্শেদ, একজন দোয়াত। একের শক্তি কি কিছু কম?’”
সুধীর চক্রবর্তী চলে গেছেন। সব চলে যাওয়া সমান নয়।