book review

ইতিহাসের সাক্ষী শহরের রাস্তা

বিশ শতকের প্রারম্ভেই কলকাতা দেখেছিল সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। যার সঙ্গে পুরপ্রতিষ্ঠান প্রণীত আইন ও সঙ্ঘবদ্ধ রাজনীতি মিলেমিশে গিয়েছিল।

Advertisement

সুভোব্রত সরকার

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:৫১
Share:

সংঘাত: এসপ্লানেড এলাকা থেকে হকার উচ্ছেদ অভিযান। ১৯৮৭

শহরের ইতিহাস হল চলমানতার আখ্যান। স্ট্রিটস ইন মোশন বইটিতে শহুরে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে রাস্তাকে কেন্দ্রীয় চরিত্ররূপে উপস্থাপিত করেছেন লেখক। নানা তত্ত্বের আলোকে পথ ও শহুরেপনাকে একসূত্রে জুড়েছেন তিনি— ঊনবিংশ শতাব্দীর বহুবিধ শহুরে বিক্ষোভ-আন্দোলন থেকে বিংশ শতাব্দীর অটোমোবাইল বিপ্লব ও গণরাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্মেষের সাক্ষী হল কলকাতার রাস্তাঘাট। সমাজের নানা স্তরের মানুষ এক দিকে যেমন বিভিন্ন সময়ে এই শহরের রাস্তায় অবস্থান করেছে, কলকাতাকে কল্পনা করেছে তাদের মতো করে, অন্য দিকে আবার রাস্তা তার সমস্ত গতিময়তা দিয়ে কলকাতাবাসীকে করেছে জঙ্গম।

Advertisement

কলকাতার নগরায়ণের গুরুত্বপূর্ণ পর্বে রয়েছে ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (সিআইটি) ও তাদের কর্মকাণ্ড। লেখক উল্লেখ করেছেন সিআইটি-র চিফ ইঞ্জিনিয়ার রিচার্ডস সাহেবের কথা— ক্যামেরা ব্যবহারের মাধ্যমে প্রস্তুত তাঁর রিপোর্ট সংস্থার আধিকারিকদের কাছে গুরুত্ব না পেলেও, সমসাময়িক নগর পরিকল্পনাবিদদের যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছিল। লেখক কলকাতার ইতিহাস নির্মাণে এলিট ও সাবঅল্টার্ন উপাদানের সংমিশ্রণ তুলে ধরেছেন। এতে অনুঘটকের কাজ করেছিল শহরের রাস্তা। কলকাতার শিল্পাঞ্চল বরাবরই ছিল পুর এলাকার বাইরে, যার সঙ্গে অনেকাংশে মিল লন্ডনের। এখানে ম্যানচেস্টার বা বম্বের চেয়ে শহুরে পরিকাঠামোয় শ্রমিক শ্রেণির অন্তর্ভুক্তি ঘটেছিল ভিন্ন ভাবে। শহরের বাইরে বস্তিতে নয়, শ্রমিকরা বরং কলকাতার রাস্তায় অস্থায়ী ছাউনি নির্মাণের মাধ্যমে হয়ে উঠেছিলেন ফুটপাতবাসী। রাস্তা হয়ে উঠেছিল তাঁদের কর্মক্ষেত্র ও বাসস্থান।

স্ট্রিটস ইন মোশন: দ্য মেকিং অব ইনফ্রাস্ট্রাকচার, প্রপার্টি অ্যান্ড পলিটিক্যাল কালচার ইন টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ক্যালকাটা

Advertisement

ঋতজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১০৯৫.০০

কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস

বিশ শতকের প্রারম্ভেই কলকাতা দেখেছিল সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। যার সঙ্গে পুরপ্রতিষ্ঠান প্রণীত আইন ও সঙ্ঘবদ্ধ রাজনীতি মিলেমিশে গিয়েছিল। উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান, শক্তিশালী গোষ্ঠী হিসাবে শহুরে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মারোয়াড়ি সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ, মুসলিমদের কোণঠাসা হয়ে পড়া— পরিণতি ১৯১৮ ও ১৯২৬-এর দাঙ্গা। এই ধর্মীয় মেরুকরণ ও সিআইটি-র রাস্তা নির্মাণকার্যের এক বিভ্রান্তিকর সংমিশ্রণ লেখক তুলে ধরেছেন দ্বিতীয় অধ্যায়ে। ১৮৮০-র দশকে শিয়ালদহ থেকে হাওড়া স্টেশনে সহজে পৌঁছতে হ্যারিসন রোড নামে এক নতুন রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় ট্রাস্ট। এক নতুন পরিভাষার সঙ্গে কলকাতার পরিচিতি ঘটল— ‘রিক্যুপমেন্ট’। তৎকালীন ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ও কিছু কমিশনার স্থির করেন, এই রাস্তা নির্মাণে যতটুকু জমি প্রয়োজন, অধিগ্রহণ করতে হবে তার থেকেও বেশি জমি, যা আবাসন শিল্পে বিনিয়োগ করা হবে। ট্রাস্টের এই বিতর্কিত নীতি তাদের কোষাগারকে সমৃদ্ধ করেছিল। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ প্রশস্তকরণ প্রকল্পেও এ ভাবে বহু জমি অধিগৃহীত হয়। বিশ শতকের প্রথমার্ধে বিভিন্ন রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের ফলে লাভবান হন মারোয়াড়িরা, পরিণতিতে মধ্য কলকাতার জনবিন্যাস সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এখানকার সিংহভাগ মুসলিম এক প্রকার বাধ্য হন বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে। লেখক বলেছেন, কলকাতার সম্প্রসারণ ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ পরস্পরকে প্রভাবিত করেছে।

এ সবের ফলেই যেন ‘ঘেটো’ বা মহল্লা নির্মাণ। তৃতীয় অধ্যায়ের বিষয়বস্তু, কী ভাবে অশান্ত মুহূর্তে পুলিশ প্রশাসন কলকাতাকে সাম্প্রদায়িক ভাগে বিভক্ত এলাকা হিসাবে বিবেচনা করেছিল। পুলিশ ও জনতার খণ্ডযুদ্ধে রাস্তাগুলো অঞ্চল বিভাজকের কাজ করেছিল, কৌশল নির্মিত হয় রাস্তার অবস্থান বিবেচনা করে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিবারণে দু’ধরনের পদক্ষেপ করেছিল— ১) আইনি (১৯২৩-এর গুন্ডা আইন) এবং ২) শহরের ভৌগোলিক কাঠামোর পরিবর্তন। কারণ, বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বিভিন্ন দাঙ্গায় এই স্থানিক বিন্যাস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল আইনভঙ্গকারী এবং আইনরক্ষক উভয়ের ক্ষেত্রেই। তবে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ১৯৪৬-এর দাঙ্গা। মহল্লাগুলোকে সঙ্ঘবদ্ধ করা ও শত্রুশিবিরে আক্রমণ শাণানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো— সিমলা ব্যায়াম সমিতি, জামাত-ই-উলেমা, তানজীম-উল-মুসলমান প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

বিশ শতকের প্রথমার্ধে জনাকীর্ণ শহরকে বাসযোগ্য করে তুলতে প্রয়োজন ছিল উপনগরী নির্মাণ। পূর্ববঙ্গ থেকে আগত বিপুলসংখ্যক মানুষের জায়গা ছিল না মূল শহরে, ফলে শুরু হল জবরদখলের পালা। কলকাতার মানচিত্রে ঘটল বহু পরিবর্তন— লোয়ার সার্কুলার রোড ও প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের মধ্যবর্তী বহু জায়গা ধীরে ধীরে হল বাসযোগ্য। তৈরি হল রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট প্রণীত এই প্রকল্প ১৯৩০-এর দশকেই পরিণত হয় মধ্যবিত্ত বাঙালির পছন্দের আবাসিক এলাকায়। রিজেন্ট কলোনি, নাকতলা, রানিকুঠি জুড়ে ছিল কলকাতার ধনীদের বাগানবাড়ি, উদ্বাস্তুরা সেগুলি দখল করেন। সমকালীন রাজনীতিতেও উদ্বাস্তু সমস্যা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। বহু বিক্ষোভ আন্দোলনের মাধ্যমে পুনর্বাসন সরকারি নীতি হিসাবে স্বীকৃতি পেল। উদ্বাস্তুদের শহরের কেন্দ্রস্থলের উচ্চমূল্যের জমি থেকে উচ্ছেদের প্রাথমিক শর্তই হল পুনর্বাসন, শহরের বাইরে অপেক্ষাকৃত স্বল্পমূল্যের জমিতে। পরবর্তী কালে শহরতলি ক্রমশ জনবহুল হয়ে পড়ায় পুনর্বাসন সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি থেকে জীবিকার সন্ধানে আসা গরিব মানুষের অন্নসংস্থানের অন্যতম অবলম্বন হয়ে ওঠে হকারি, মূলত শহরের ফুটপাতগুলি তারা দখল করে। ১৯৭০-এর দশকে হকাররা কলকাতার রাজনীতিতে এক নির্ণায়ক শক্তি হয়ে ওঠেন, এবং প্রশাসনের কাছে হয়ে ওঠেন মাথাব্যথার কারণ— মহানগরের গতি রুদ্ধ করছেন তাঁরা। ট্রেড ইউনিয়নের রঙ্গমঞ্চে আগমন পরিস্থিতিকে করে তুলল জটিল। বামফ্রন্ট সরকারের নতুন শিল্পনীতি, অপারেশন সানশাইন এবং হকার সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে শহরের হকারদের ঘুরে দাঁড়ানো— সব মিলিয়ে এই অধ্যায়টি জমজমাট। ফুটপাত হকারি নিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ যুদ্ধকৌশল আরও তীক্ষ্ণ করতে হকার সংগ্রাম কমিটি নিজেদের আর্কাইভ তৈরি করে। প্রশাসনের কাছে নিজেদের ‘তথ্যনির্ভর’ বক্তব্য পেশ করতে যা ছিল অতি প্রয়োজনীয়। লেখক সেই আর্কাইভ শুধু ব্যবহারই করেননি, হকার সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ ২০০৯-এ যে জনসংযোগ অভিযান শুরু করেন, তিনি ছিলেন তার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। হকার সংগ্রাম কমিটির আর্কাইভ থেকে ব্যবহৃত আলোকচিত্রগুলি বইয়ের আকর্ষণ।

বইটি জানায়, কলকাতার রাজনীতি এবং তার রাস্তা পরস্পরকে ক্রমাগত প্রভাবিত করছে। আর এই নাটকের কুশীলব কখনও আন্দোলনকারী দাঙ্গাবাজ জনতা, কখনও বা হকার, পুলিশ বা ইঞ্জিনিয়ার। কোভিডকালীন লকডাউনের সময় রাস্তা কী ভাবে অসংগঠিত জনসাধারণের হাত ধরে এক নতুন প্রতিবাদমঞ্চে পরিণত হয়েছিল, লেখক তা মনে করিয়েছেন। ব্রিটিশ লাইব্রেরি, ন্যাশনাল আর্কাইভস, ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট আর্কাইভস প্রভৃতির সঙ্গে সিআইটি এবং হকার সংগ্রাম কমিটির আর্কাইভের ব্যবহার এ গবেষণাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই শহরের রাস্তার এমন একটি বইয়ের প্রয়োজন ছিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement