অক্ষরবৃত্ত: মানকুমারী বসু, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ও স্বর্ণকুমারী দেবী
উনিশ শতকের বাংলায় গড়ে উঠছে বাঙালি নারীর নিজস্ব বয়ান। ‘নিজস্ব’ বিশেষণটির পরতে পরতে অবশ্য অন্তহীন দোটানা। উপনিবেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি-অগ্রগমন-আধুনিকতার ছত্রে ছত্রে নিজবাস-পরবাস, অন্দর-বাহির, মুক্তি-বন্ধন কত জটিল দ্যোতনায় জানান দেয়। সে দিনের বয়ানের যুক্তি-আবেগ, ব্যক্ত-নিরুক্ত যদি পড়তে হয় আজ, সে কাজ সহজ নয়। সরলীকরণের প্রবণতা প্রত্যাখ্যান করে, নৈর্ব্যক্তিক অভিনিবেশে পাঠ বানিয়েছেন মেরুনা মুর্মু, জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন, নির্দিষ্ট কোনও নিশ্চিত উত্তর বাতলাতে ব্যগ্র হননি। উনিশ শতকে বাঙালি নারীর লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধ, আত্মকথা, উপন্যাস আর ভ্রমণ বৃত্তান্ত নিয়ে গড়ে উঠেছে বইয়ের দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম পরিচ্ছেদ। মেরুনা ফিরে ফিরে বলেছেন, কেমন ছিল নারীর এই নবনির্মাণের প্রতি পুরুষপ্রধান লিখনবিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি। নারীর বয়ানে সটান স্বাধীনসত্তা মূর্ত হলে, নবজাগরণের বাংলায় কালি-কলমে নারীর অধিকারে অনভ্যস্ত পুরুষ-সমালোচক অনেক ক্ষেত্রেই ওই স্বাধীনতা ছেঁটে-কেটে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন।
মেয়েদের বই নিয়ে আলোচনা খুবই কম, যা আছে তা-ও রচনায় কমনীয়তা বা পবিত্রতা পেলে হাঁপ ছাড়ে। অন্যথায় বলে, কৌতুকের অছিলায় অশ্লীলতা নারীর বয়ানের উপযুক্ত নয়, অথবা লেখে, নারীর রচনা বলেই আলোচ্য বইয়ের প্রসঙ্গ অবতারণা, নচেৎ এমন কোনও উৎকর্ষ ও বইতে নেই, যা নাকি আলোচিতের স্বীকৃতি পেতে পারে। আলোকপ্রাপ্ত পুরুষের কলম-বাহিত এমন মন্তব্য সাজিয়ে মেরুনা জানান, তবু প্রতিকূল যাত্রাপথে হার মানছে না নারীর বয়ান।
উপন্যাসের বিশদ পাঠের জন্য মেরুনা নির্বাচন করেছেন কুসুমকুমারী রায়চৌধুরানির স্নেহলতা আর স্বর্ণকুমারী দেবীর কাহাকে?। সমাজ-অর্থনীতিতে নারীর অবস্থানগত ফারাক দু’টি আখ্যানে এতই দুস্তর যে, কোনও সরলীকৃত পরিশিষ্টের জন্য আকুলতায় গবেষকের অন্বিষ্ট মেলানো যায় না। স্নেহলতার উদার মন উপন্যাসে বিন্যস্ত, কিন্তু তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উল্লেখমাত্র নেই (পৃ ১৯৭)। নিষ্কাম ধর্মের কাছে স্নেহলতার সমর্পণেই উপন্যাসের স্থিতি। নারীর অন্যতম প্রধান গুণ যে সতীত্ব, পিঞ্জরের কাছে আত্মসমর্পণেই যে স্নেহলতা পাঠকের প্রেরণা, এই সব বাঁধা ছক পেরিয়ে উপন্যাস তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা অর্জন করে— হীরালাল-ঊষাবতীর দাম্পত্য, ঊষাবতীর সমাজমন আর সমাজকর্ম এবং কাহিনি জুড়ে নারীদের পারস্পরিক সম্পর্কের নতুন মাত্রা। অন্য উপন্যাসটিতে লোরেটোর ভূতপূর্ব ছাত্রী মৃণালিনীর সুবাদে স্বর্ণকুমারী নারীর প্রত্যাখ্যানের অধিকারকে গ্রহণ-বর্জনে পুরুষের স্বীকৃত অগ্রাধিকারের উপরে জায়গা দিয়েছেন (পৃ ২৩৫)।
ওয়ার্ডস অব হার ওন: উইমেন অথরস ইন নাইনটিনথ-সেঞ্চুরি বেঙ্গল
মেরুনা মুর্মু, ১৩৯৫.০০
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
দ্বিতীয় অধ্যায়ে কৈলাসবাসিনী দেবীর হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা (১৮৬৩) আর স্বর্ণময়ী গুপ্তের ঊষাচিন্তা... (১৮৮৮) নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা। কৈলাসবাসিনী আরও লিখেছেন স্ত্রী-শিক্ষা সংক্রান্ত বই হিন্দু অবলাকুলের বিদ্যাভ্যাস ও তাহার সমুন্নতি (১৮৬৫)। নারীশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সংসারযাত্রার সুনির্বাহ, সেই শিক্ষার জন্য পুরুষসম্পর্করহিত অন্তঃপুরতুল্য বিদ্যামন্দির প্রয়োজন, নারীকে সম্পূর্ণ শৃঙ্খলমুক্ত করার মতো অশুভ সম্ভাবনা আর নেই।
কৈলাসবাসিনীর এই বক্তব্যের ঠিক আড়াই দশক পরে কাহাকে?-র প্রকাশ। পঁচিশ বছরে এত দূর স্বীকৃতি পেয়েছে বাঙালি নারীর বহিরাগমন? অবশ্য স্নেহলতা-র নিষ্কাম ধর্মও কাহাকে?-র সমসাময়িক। তবে কি ফারাকটা হিন্দু আর ব্রাহ্ম যাপনের? কাহাকে?-র সুবাদে মনে হয়, নারীর বহিরাগমন কি মনোমত পুরুষ নির্বাচনের অধিকারেই সার্থকতম? এ কাহিনির অনেকটাই কি ইচ্ছাপূরণমাত্র? যা বানানো যায় উনিশ শতকে বাংলা সংস্কৃতির সর্বাপেক্ষা আলোকিত পীঠস্থানের সংলগ্নতায়? মন্মথনাথ ঘোষ লিখেছেন, ‘মৃণালিনী দেবীর কোনো রচনা আছে কিনা’, এই প্রশ্নের জবাবে কাহাকে?-র লেখিকা জানান, “তাঁহার স্বামী বাংলার একজন শ্রেষ্ঠ লেখক, সেইজন্য তিনি স্বয়ং কিছু লেখা প্রয়োজন মনে করেন নাই।” তবে কি পরম পীঠস্থানেও মুক্তি-বন্ধনের সংজ্ঞা নারী থেকে অন্য নারীতে ভিন্নতর? স্বর্ণকুমারীর উপন্যাস প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তির্যক মন্তব্য ন্যায্যতই আছে মেরুনার বইতে (পৃ ২৪১)। ন্যায্যতর হত না কি ওই মন্তব্যের পাশাপাশি গল্পগুচ্ছ-এর ‘নষ্টনীড়’ এবং ‘দর্পহরণ’-এর উল্লেখ এবং বিন্যাস? নারীর বয়ানের স্বতঃস্ফূর্ত দেশজতার তুলনায় কোথায় নড়বড়ে ইরেজিশিক্ষিত বাঙালি পুরুষের মাতৃভাষা, তার প্রক্ষেপ মেলে গল্পগুচ্ছটিতে। আবার, নারীর প্রত্যাখ্যান যদি নস্যাৎ করে পুরুষের নির্বাচন করার প্রতিষ্ঠিত অগ্রাধিকার, সঙ্গে সঙ্গে কি প্রমাণ হয়ে যায় সেই আখ্যানের শিল্পসম্মতি বা জীবনসঙ্গতি? এ রকম কোনও শর্ত সংবেদনশীল নারীর অসম্মানেরই নামান্তর।
...হীনাবস্থা আর ...সমুন্নতি-র কৈলাসবাসিনী বলেন, বাঙালির অন্দরে কোনও আনন্দ নেই। নিরানন্দের সমাধান মিলবে, নারী তার সাক্ষরতা-শিক্ষা-সংস্কৃতিমনস্কতাকে অন্দরের শ্রী-স্থিতি-মাঙ্গল্য বৃদ্ধিতে প্রয়োগ করলে। সমাজের স্তর-স্তরান্তর কতটুকু চিনতেন কৈলাসবাসিনী? জানতেন কি কুলীন বিধবা হটি বিদ্যালঙ্কারকে, যিনি কাশীতে নিজের টোলে স্মৃতি ব্যাকরণ নব্যন্যায় পড়িয়ে পুরুষ ভট্টাচার্যের মতো দক্ষিণা নিতেন? গুরুগৃহে পুরুষ সহপাঠীদের সঙ্গে শিক্ষালাভও করেছেন রূপমঞ্জরী বোষ্টমি, আজীবন অবিবাহিতা তিনি ব্যাকরণ, সাহিত্য, চরক, নিদান প্রসঙ্গে বিধান দিয়েছেন মুণ্ডিত মস্তকে, উন্নত শিখায়। অন্তঃপুরের সৌষ্ঠব বৃদ্ধিই যদি নারীশিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য, অন্তঃপুরতুল্য বিদ্যামন্দির যদি তেমন শিক্ষার সর্বোত্তম উপায়, চতুষ্পাঠীর শিক্ষা কি তবে শিক্ষাই নয়? উপনিবেশের আলো-আঁধারিতে কোনটা যে আসল আর কোনটাই বা নকল! স্বর্ণময়ী গুপ্তের ঊষাচিন্তা...-য় আছে, হিন্দু রমণী যেন ‘বিবি’কে আদর্শ না মানেন। যাজ্ঞবল্ক্য-পরাশর-মনুর আলোয় তাঁরা আনন্দময়ী হবেন, কোরান বা বাইবেলের আদর্শে নয়। কৈলাসবাসিনীর বই প্রকাশকালে রূপমঞ্জরী বারাণসীতে স্বাধীন শাস্ত্রসাধনা করেন। স্বর্ণময়ীর বই বেরোয় রূপমঞ্জরীর মৃত্যুর তেরো বছর পরে। আপাত-পার্থক্য সত্ত্বেও কোথাও কি মিলে গেল কৈলাসবাসিনী আর স্বর্ণময়ীর বয়ান? ইংরেজের উপনিবেশে বাঙালি নারীর স্বর-সন্ধানের পরিক্রমায় চতুষ্পাঠীর বিদুষীরা নামমাত্র পরিসরও পেলেন না!
আর এক কৈলাসবাসিনী দেবী জনৈকা গৃহবধূর ডায়েরি-তে লিখেছেন স্বামীর সঙ্গে সহধর্মচর্চার, সখ্যের ব্যতিক্রমী আলেখ্য। লেখিকার বিশ্বাস-আদর্শ-মূল্যবোধ হারিয়ে গেল হিন্দু বিধবার নিয়মনিষ্ঠার আড়ালে। স্বামীর মৃত্যুতে কৈলাসবাসিনী যেন তাঁর এত দিনের বয়ানকে প্রত্যাখ্যান করলেন। অন্য দিকে, সারদাসুন্দরী দেবী যখন তাঁর আত্মকথা বলতে শুরু করলেন নাতজামাই যোগেন্দ্রলাল খাস্তগীরকে, বৈধব্য তখন তাঁর বহু দিনের বহন। মরণের, জীবনের, যাপনের বিচিত্র অভিঘাত কেশবজননীর কথকতায়। যোগেন্দ্রলালের বয়ানে সারদাসুন্দরীর কথকতা কতখানি রক্ষিত হল, সে প্রশ্ন তোলেননি মেরুনা, যদিও তাঁর বইয়ের নাম ওয়ার্ডস অব হার ওন!
ভ্রমণবৃত্তান্তের বিশ্লেষণে কৃষ্ণভাবিনী দাস (ইংলণ্ডে বঙ্গমহিলা, ১৮৮৫) এবং প্রসন্নময়ী দেবী (আর্যাবর্ত: জনৈকা বঙ্গ-মহিলার ভ্রমণ বৃত্তান্ত, ১৮৮৮), উভয়েরই মন-মননের পর্যবেক্ষণে মেরুনার মুনশিয়ানা স্পষ্ট। ইংল্যান্ডের বর্ণনায় আগ্রহী এবং পরম পরিশীলিত এক মনের হদিশ মেলে। সেই মন রানি ভিক্টোরিয়ায় খুঁজে পায় ভারতের পরম হিতৈষীর চিত্র, আবার ভারতবাসীকে দোষারোপ করে তাদের উপনিবেশদীর্ণ জীবনের জন্য (পৃ ২৬৭)। প্রভুর দেশ ভ্রমণের যোগ্য অবস্থান আর সংস্থান যাঁর নাগালে, তাঁর ঔপনিবেশিক বিভ্রমের এই মোক্ষম নিদর্শন মেরুনা তীক্ষ্ণ ঋজুতায় গেঁথেছেন নিজের পাঠে। ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোক স্ত্রী-শিক্ষাকে সচরাচর ভাবেন অন্দরকে উৎকৃষ্টতর শুশ্রূষার নিরবচ্ছিন্ন জোগানদার বানানোর পোক্ত হাতিয়ার। তেমন কোনও অন্দর যাঁর নাগালে ছিল না, সেই প্রসন্নময়ীও ভ্রমণ শেষে নিকটজনের কাছে ফেরার আবেগে ভরপুর, যেন সত্যিই কোনও উষ্ণ নিজবাসের ঠিকানা তাঁর জানা। প্রকৃতিমুগ্ধতার বিচ্ছুরণেও প্রসন্নময়ী আড়াল করেন না জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষিত বা ইতিহাসের দায়। তাই খোঁজেন মুক্তি আর পুনর্জন্মের প্রতীক্ষায় উজ্জীবিত ভারতসন্তানদের। আর্যাবর্ত ভ্রমণের সুবাদে যে দেশ জেগে উঠছে, সে জাগরণে বিভ্রান্তি আছে, তবে সচেতন মিথ্যা নেই।
ঔপনিবেশিক জীবনের দু’টি ভিন্ন স্তরে বিভ্রান্তি-ইচ্ছাপূরণের লালনে, পরম্পরা-বর্তমানের পালনে না-পাওয়ার হাহাকার থাকবেই। হাহাকারের কত মর্মভেদী প্রবাহ আছে মেরুনা মুর্মুর জানাচেনা চৌহদ্দিতেই। তেমন জান-পহচানের খবর নিজেই দিয়েছেন লেখক (পৃ ১৯)। প্রসন্নময়ীর ভ্রমণকথা পড়তে পড়তে বালবিধবা ইন্দুমতীকে মনে পড়ে। প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও উঠতে পারেনি সে সাবিত্রী পাহাড়ে। রজস্বলা অশুচি ইন্দুমতীকে একা ফেলে সঙ্গিনীরা দর্শনে চলে গেল। “ঠাকুর, লোকের মালা, চন্দন, গয়না, কাপড় নিয়ে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে থাকো... কাঠিটি নাড়তে পার না। আমার খিদে, তেষ্টা আর এই রক্তভাঙা রোগ... তোমায় দিলুম।” (পিঞ্জরে বসিয়া, পৃ ১৭, কল্যাণী দত্ত)। ইন্দুমতীর এই বুকফাটা হাহাকার বা রূপমঞ্জরী বোষ্টমির ব্যতিক্রমী শাস্ত্রযাপন সম্পূর্ণ উহ্য থাকলে, মূর্ত হয় কি উনিশ শতকে বাঙালি নারীর স্বরপ্রবাহের নিজস্বতা? ‘নিজস্ব’কে হরেক ভাঙাগড়ায় বিঁধে বিঁধে তবেই না উপনিবেশদীর্ণ জাতিসত্তার বয়ানে নারীর স্বর যোজনা।