নাট্যসত্য: উইঙ্কল টুইঙ্কল নাটকের দৃশ্য। ছবি সৌজন্য: সংসৃতি নাট্যদল
বাঙালির নাট্য-ইতিহাসটি বিস্তৃত, বর্ণময়, এবং তা একটি চলমান প্রক্রিয়া।
আমি যে তোমাকে পড়ি, আমি যে তোমার কথা বুঝি বইটিতে সেই ইতিহাস তৈরির কাজ খানিকটা এগিয়ে রাখলেন ব্রাত্য বসু। তিনি এই বইয়ের লেখক নন, ভূমিকা, সম্পাদনার দায়িত্বে। আর যে আলোচনাগুলির সঙ্কলন এটি, সেগুলির সঞ্চালক। নতুন শতাব্দীর থিয়েটারকে ছুঁয়ে, ভেঙে, কার্যত টুকরো করে, কখনও ভালবেসে, কখনও নির্মম হয়ে দেখতে চাওয়ার সঙ্কলন। ‘ব্রাত্যজন’ নাট্যদল একদা আয়োজন করেছিল বেশ কিছু আলোচনার। এই বইতে যাকে বলা হয়েছে ‘গোলটেবিল’। বাংলা নাট্যকেন্দ্রিক গোলটেবিল। গোড়াতে মনে হতে পারে, ছড়িয়ে থাকা সকলের নানা মতকে বেঁধে কোনও নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছতেই এই উদ্যোগ। পাঠের পর ধারণা বদলায়। নিজের ভাবনা বাকিদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে, ভাবনার পরিসরকে বাড়িয়ে নেওয়াটাই এর মূল উদ্দেশ্য ছিল। একে মত ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ‘কথা-আসর’ বললে খুব ভুল হবে বলে মনে হয় না।
২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সাতটি আলোচনা। পরিকল্পনা ও মূল উদ্যোগ ব্রাত্যজনের প্রতিষ্ঠাতা, নাটককার, পরিচালক ব্রাত্য বসুর। ছ’টি আলোচনা সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। বাংলা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত কমবেশি চল্লিশ জনকে কথা বলতে দেওয়া হয়েছে। এক-একটি আসর নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক হলেও সব ক’টিকে একত্রে দেখলে মূল সন্ধানটি ছিল, এই শতাব্দীতে থিয়েটারের চলার পথটিকে দেখা। সে কী ভাবে, কোথায় চলেছে। বিস্তৃত, বর্ণময় যুগ পেরিয়ে আজ বাংলা থিয়েটার যে তীরে এসে দঁাড়িয়েছে, সেই জলে কি জোয়ার? না কি ভাটার টান লেগেছে? জেগেছে কি দিগন্তপ্রসারিত ভিজে অথচ তপ্ত বেলাভূমি? পা রাখলে ফোস্কা পড়ছে? সমাজ, প্রযুক্তি, আর্থিক চেহারা, ভাবনা, বিশ্বাস, আদর্শ বদলের বঁাকে বঁাকে এই সময়ের বাংলা থিয়েটার নিজেকে কতটা মানিয়ে নিতে পারছে, আলোচনায় তারই তত্ত্বতালাশ হয়েছে। যে যেমন বলেছেন, তেমন ভাবেই বইতে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্পাদক কাটাছেঁড়া খুব কিছু করেছেন বলে পড়তে গিয়ে মনে হল না, অনেকটা সিনেমার ‘রাশ প্রিন্ট’-এর মতো। এতে পাঠের স্বাদ বেড়েছে, মাত্রা আর পঁাচটা বইয়ের থেকে ভিন্ন হয়েছে। পাতা উল্টে মনে হবে, পাঠক নই, আসলে শ্রোতা। আলোচনার পাশেই বসেছি। বলার দায় নেই, বোঝার আগ্রহটুকু রয়েছে।
আমি যে তোমাকে পড়ি
আমি যে তোমার কথা বুঝি/ নাট্যবিষয়ক
ভূমিকা, সঞ্চালনা ও সম্পাদনা: ব্রাত্য বসু
৪৯৯.০০
দে’জ পাবলিশিং
সম্পাদকের ঘোষণায় এই বই গত ত্রিশ বছরের বাংলা থিয়েটারের আকর্ষণ-বিকর্ষণ, সহযোগিতা-প্রতিযোগিতার দলিল। শুধুই কি তা-ই? থিয়েটারের সঙ্গে নানা ভাবে যুক্ত এই সময়ের গুণিজনেরা যা বলেছেন, তা শুধু পারস্পরিক সম্পর্কের কথা নয়। থিয়েটার কোন পরিসরে কাজ করতে পারছে, কতটা ইচ্ছে থাকলেও পারছে না, সে কথা হয়েছে বিস্তারিত। অর্থাৎ সামাজিক এবং সুধীজনের মনোরঞ্জনে বাংলা থিয়েটার নিজের গুরুত্ব কতটা ধরে রাখতে পেরেছে, সে সম্পর্কে মতামত, তর্ক, বিশ্বাস-অবিশ্বাস এসেছে। খানিকটা আলোর ঝলকানি তোলা সংঘাতের মতো।
সাত দফায় কোন কোন বিষয় বাছা হয়েছিল? এক-একটির শিরোনাম এক-এক রকম। তাতে যেমন ‘থিয়েটারে গৌরী সেন ও ভবানীর ভঁাড় বিষয়ক বৃত্তান্ত’, ‘পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন’, ‘সদর ও মফস্সল’ ধরনের সাহিত্যরস রয়েছে, আবার সোজাসাপ্টাও রয়েছে। যেমন ‘নতুন যৌবনের দূত’ অথবা ‘মুখোমুখি ব্রাত্য বসু’। মোদ্দা কথা হল, আলোচনায় এসেছে, নব্বইয়ের দশকে বাংলা থিয়েটার করার সমস্যা ও সমাধান প্রসঙ্গ, এসেছে কেন থিয়েটারে আসা, তরুণরা থিয়েটার নিয়ে কী ভাবছেন, কোথা থেকে জুটছে অর্থ? শোনানো হয়েছে, যাঁরা নিয়মিত থিয়েটার লেখেন, তাঁদের কথা। কথা হয়েছে, মফস্সলে থিয়েটার কোন বাধার সামনে? স্বল্প পরিসরে সব ক’টি আলোচনার প্রসঙ্গ এখানে তোলা সম্ভব নয়, তাই নমুনা হিসেবে দু’টি বেছে নেওয়া যেতে পারে।
যেমন প্রথম আসরটি। অতি চিত্তাকর্ষক। সাত আসরের সেরাও বলাও যেতে পারে। বোঝা যায়, আয়োজন শুধু অভিনব নয়, গুরুত্বপূর্ণও। আবার শুধু গুরুত্বপূর্ণও নয়, সুখপাঠ্যও। আসরটির বিষয় ছিল, ‘৯-এ নবগ্রহ— বাংলা থিয়েটারে ৯’-এর দশক: সূচক ও বদল।’ ২০১০ সালের সে আসরে অংশ নিয়েছিলেন বাংলা আধুনিক থিয়েটারের অতি-পরিচিত জনেরা। কৌশিক সেন, মণীশ মিত্র, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, অর্পিতা ঘোষ, কিশোর সেনগুপ্ত এবং গৌতম হালদার। গুণিজনেরা জানিয়েছেন, যখন কাজ শুরু করেছিলেন, সেই সময়ের ভাল লাগা কি আজও অটুট? না কি, তা কালের নিয়মেই বদলেছে? বলার সময় সকলে যতটা পেরেছেন মনকে মুক্ত করেছেন। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া, আবেগ এবং যোগাযোগের মাধ্যম খুঁজতে খুঁজতেই কী ভাবে থিয়েটার নামের নৌকাটিতে উঠে ভেসে পড়ার কথা বলেছেন। ভাঙা মাস্তুল, ছেঁড়া পালের নৌকাকে বাগে আনতে হয়েছে। এসেছে নেশা, পেশা আর অর্থ ও ভাবনার সঙ্কট। স্পষ্ট হয়েছে বিনোদনের সামাজিক, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলা থিয়েটার তার আত্মপরিচয় কী ভাবে সুরক্ষিত রাখতে পারে, সে প্রসঙ্গে কথা হয়। তবে আসরের মূল সুরটি ছিল— থিয়েটার ছাড়া বঁাচব না।
আরও একটি আসর বসেছিল বাংলা থিয়েটারের টাকাপয়সা জোগান সম্পর্কিত। বসেছিল ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর। সৌমিত্র বসু, বিজয় মুখোপাধ্যায়, বিলু দত্ত, ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তী ছিলেন সেখানে। যাঁরা থিয়েটারে অর্থের আয়োজন করেন, কোথা থেকে অর্থ পান? কেমন ভাবে তা ব্যবহার করেন? যেখানে সরকারি অনুদান সামান্য, ব্যক্তি-উদ্যোগই বেশি, সেখানে কোন নেশায় তাঁরা এগিয়ে এসেছেন? লাভ-লোকসানই বা কতটা? এ সব নিয়ে কথা। হয়তো একটু লঘু হয়ে যাবে, তার পরেও বলতে হয়, এই আসরটি যথার্থই রোমহর্ষক। অর্থকড়ি, নিজস্ব বাজেট, লাভ-লোকসানের কৌশল এক ধরনের গোপনীয় বিষয়, তার পরেও সবাই মুক্তমনে কথা বলেছেন। কোম্পানি থিয়েটার, কর্পোরেট সহায়তা থিয়েটারের স্বাধীনতা, সৃষ্টিশীলতাকে কতটা টুঁটি চেপে ধরতে পারে বা বঁাচিয়ে তোলে সে আলোচনাও রয়েছে। তবে সবারই কথা এক, কষ্ট হলেও থিয়েটার ছেড়ে যাওয়া অসম্ভব। পর্দা উঠলে আমরা থিয়েটারের গল্প দেখি, অভিনয় দেখি, কৌশল দেখি, দেখি আঙ্গিক, মঞ্চসাজ, আলোর কেরামতি। কিন্তু এত কিছুর জন্য প্রয়োজনের অর্থ কোথা থেকে এল, তা দেখা হয় না। এই আসরে সেই পর্দা উন্মোচিত হয়েছে। নতুন প্রজন্মের কাছে আসরটি দিকদর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে।
এই বইয়ের বাকি আসরগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ব্রাত্যর মুখোমুখি’। আধুনিক বাংলা থিয়েটারে সর্বার্থে সফল এই নাট্যব্যক্তিত্বের ভাবনা বিশেষ গুরুত্বের তো বটেই। অনুজদের সঙ্গে বসে, তিনি যতটা না নিজেকে দেখাতে চেয়েছেন, তার থেকে বেশি নিজেকেই নিজে দেখেছেন। এক ধরনের আত্ম-উন্মোচন। সাহসী আসর।
বইটি পড়তে পড়তে বহু বার মনে হয়েছে, এখানকার কোনও কোনও ‘কথা-আসর’কে থিয়েটার হিসেবে মঞ্চে আনলে বেশ হত। দর্শক তো থিয়েটারেরই অংশ। এই থিয়েটারে তাঁরা সহজেই একাত্ম হবেন। সংলাপ যা লিখতে হয়নি, অসংখ্য অজানা ঘটনা যা বানাতে হয়নি, কুশীলবের আশা-হতাশা, রাগ ও ভালবাসা যা তৈরি করা নয়, তাকে মঞ্চে নিয়ে এলে বাংলা থিয়েটারে আর এক নতুন সংযোজন হবে।
দে’জ প্রকাশনা থেকে সুমুদ্রিত বইটি এই শতাব্দীর বাংলা থিয়েটারকে নতুন ভাবে চেনাবে। শঙ্খ ঘোষের পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ বইয়ের কবিতা থেকে শিরোনামটি নেওয়া। যথার্থ।