যাঁরা মনে করেন পণ্ডিতেরা অস্বস্তিকর প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর এড়িয়ে চলেন, তাঁদের ধারণা ভুল প্রমাণ করবে অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের এই সঙ্কলন বলা যায়। রচনার সঙ্কলন না লিখে ‘বক্তব্যের’ লিখলাম, কারণ এর বারো আনা জুড়ে রয়েছে তাঁর দশটি সাক্ষাৎকার। দু’টি লিখিত বক্তৃতার তর্জমা, আর একটি দীর্ঘ আলোচনাও আছে। বক্তৃতা দু’টি ইংরেজি থেকে তর্জমাকৃত।
তাঁর সোজাসাপ্টা কথার নমুনা দিই। “কলকাতায় আসার পথে শুনছি যে লোকে বলছে, এই স্বৈরাচার যদি বন্ধ করতে হয় সেটা তো সিপিএম করতে পারবে না, সেটা বিজেপিকে দিয়ে করতে হবে। এটা একটা খুব আশ্চর্য চিন্তা। স্বৈরাচার নিয়ে আলোচনা নিশ্চয় হতে পারে...কিন্তু সেটা করতে গিয়ে এমন একটা বিষ আনা, সাম্প্রদায়িকতার বিষ— এই জিনিসটা লোকে কী করে ভাবতে পারে!” এ কথা বলছেন ২০১৮ সালের অগস্টে। অমর্ত্য সেন বিস্মিত হলেও ‘লোকে’ যে তখন ও ভাবেই ভেবেছিল তার কিঞ্চিৎ প্রমাণ তো গত বছরের লোকসভা নির্বাচনে পাওয়া গিয়েছে। সে নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভোট শতাংশ বাড়া আর সিপিএম-এর কমার সরল অঙ্কেই তা রয়েছে।
বিবিধ প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন কী বলেন, তা নিয়ে আমাদের আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। অতীতে বহু বার বলা তাঁর কথাগুলো যেমন ঘুরেফিরে এসেছে, আবার আছে কিছু নতুন কথাও। যেমন বামপন্থীদের রাজনৈতিক ভূমিকার বিষয়টি। মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা যখন প্রধান প্রশ্ন, তখন ‘বামপন্থী দর্শন’কে প্রধান ভেবে আঁকড়ে ধরে থাকলে সুবিধে হবে না। বামপন্থীদের মধ্যে যাঁরা মনে করেন অন্যদের সঙ্গে হাত মেলালে পার্টির শুদ্ধতা নষ্ট হবে, তাঁদের সঙ্গে তিনি সহমত নন। ১৯২০ নাগাদ ইটালিতে ফ্যাসিজ়মের উত্থানও বামপন্থীদের এই দ্বন্দ্বের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল, মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। এক দিকে আন্তোনিয়ো গ্রামশ্চি আর অন্য দিকে গ্রামশ্চির সুহৃদ কেমব্রিজের শিক্ষক পিয়েরো স্রাফা (যিনি অমর্ত্যেরও শিক্ষক)। গ্রামশ্চি বলেছিলেন, অন্য পার্টির সঙ্গে হাত মেলালে আমরা শুদ্ধতা হারিয়ে ফেলব। স্রাফা বলেছিলেন, এটা ভুল চিন্তা; মুসোলিনির বিরুদ্ধে যে লড়াইটা তাঁরা লড়ছেন তাতে এমন অনেকেই সামিল হতে পারেন যাঁদের রাজনীতি বামপন্থী নয়, কমিউনিস্ট তো নয়ই।
বলা যায়
অমর্ত্য সেন
৪০০.০০, আনন্দ পাবলিশার্স
বামপন্থা অমর্ত্য সেনের পছন্দের রাজনৈতিক দর্শন। কিন্তু তাঁর ‘প্রকৃত বামপন্থী’ বন্ধুরা, যাঁরা মনে করতেন রাশিয়াতে কোনও অন্যায় অত্যাচার ঘটেনি, যা ঘটেছে তা হল ‘জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা’র প্রয়োগ (এই চিন্তাকে অমর্ত্য বলেছেন ‘অপার বালখিল্যতা’), তাঁদের সঙ্গে তিনি কখনওই সহমত হতে পারেননি। এমনকি, সংসদীয় গণতন্ত্রকে ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ বলাটাও তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। এ প্রসঙ্গেই আসে গোষ্ঠী আর ব্যক্তির আপেক্ষিক গুরুত্বের বিষয়ে তাঁর নির্দিষ্ট অবস্থানটি। সামাজিক চয়ন তত্ত্ব নিয়ে যে বিপুল জ্ঞানভান্ডার তিনি দীর্ঘকাল ধরে গড়ে তুলেছেন, এটি তার একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, সামাজিক চয়ন তত্ত্বের যে পোশাকি যুক্তি কাঠামো, যেখানে পূর্বধারণা থেকে শুরু করে গাণিতিক নিয়ম অনুসরণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছনোই প্রধান কাজ, তার সঙ্গে বাস্তব সামাজিক বিষয়গুলি নিয়ে তাঁর অবস্থানের কী-ই বা সম্পর্ক থাকতে পারে? সম্পর্ক যথেষ্টই জোরালো, কিন্তু তা অনুধাবন করতে দু’দিকটাই খানিক জানতে হবে। বামপন্থী হয়েও ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সক্ষমতাকে সমাজ ব্যবস্থাপনার মানদণ্ড হিসেবে দেখা— এই দর্শনে উপনীত হতে তাঁকে ন্যায্যতা ও সামাজিক চয়ন তত্ত্বের রাস্তায় গভীর অন্বেষণের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে এ সব দুরূহ চিন্তায় না ঢুকেও এই বই আস্বাদনে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। শুধু এটুকু নিঃসংশয়ে বলা যায়, তাঁর প্রতিটি বক্তব্যই নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শনে জারিত।
বহু বার বলা কথাগুলিও আর এক বার ঝালিয়ে নেওয়া যায় সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে। যেমন পরিচিতির বহুমাত্রিকতা। সকলের মধ্যেই একাধিক পরিচিতি সহাবস্থান করে। যেমন কোনও ব্যক্তি একই সঙ্গে কলকাতাবাসী, স্বাস্থ্যকর্মী, মহিলা, মণিপুরী, হিন্দুস্তানি ক্লাসিকাল ভক্ত হতে পারেন। কিন্তু হেনস্থাকারীদের কাছে তাঁর পরিচিতি শুধুই ‘নর্থ-ইস্ট’। কোনও একটা পরিচিতিকে এই ভাবে খোপে ঢোকানোর প্রবণতা থেকেই আসে ‘আমরা-ওরা’ এবং হিংসা। অমর্ত্য তাঁর পরিচিতি ও হিংসা বইয়ে এ বিষয়ে সবিস্তার আলোচনা করেছিলেন। ‘বাঙালির স্বরূপ’ বক্তৃতায় আবার তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। বাঙালির ঐতিহ্যের প্রসঙ্গে একটি সাংস্কৃতিক দিকের কথা বলছেন, যা তাঁর মাতামহ ক্ষিতিমোহন সেন রচিত ‘হিন্দুইজ়ম’ বইয়ে বার বার উল্লিখিত হয়েছে। সেটি হল, নিছক পারস্পরিক সহিষ্ণুতার সম্পর্ক নয়, হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সুসম্পর্কের ভিত্তি আসলে যৌথ ভাবে কাজ করা। ইতিহাস ঘেঁটে এই যৌথ কাজের বেশ কিছু দৃষ্টান্তও তুলে ধরছেন তাঁর বক্তৃতায়, যা কৌতূহলোদ্দীপক।
আর একটি সাম্প্রতিক ঘটনা চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনমন, পণ্য বয়কটের ডাক ও ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র কল্পনা। অমর্ত্যর বক্তব্য, “মেক ইন ইন্ডিয়া তখনই সম্ভব যখন আমাদের ‘মেক’ করার ক্ষমতা আছে।” আমরা হয়তো তিনটে জিনিসে দক্ষ, আর চিন তিন হাজারটায়। এমন হল কেন? আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অভাব, অসাম্য। আশ্চর্য, এমন ব্যাখ্যা শুধু ওঁর কথাতেই পাই। চিনের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমাতে ‘মেক’-এর কথা লক্ষ বার এসেছে, কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে নড়বড়ে নাগরিক দিয়ে যে চিনের সমকক্ষ হয়ে ওঠা কঠিন, এ কথাটা তো শুনি না।
অমর্ত্যের স্পষ্ট বিজেপি-বিরোধী অবস্থানকে কেউ যদি ‘প্যাথলজিক্যাল’ মনে করেন, তা হলে কিন্তু ভুল হবে। আপাদমস্তক সেকুলার বলে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিষ’ নিয়ে তিনি নিরলস লড়ে যাবেন, সতর্ক করে যাবেন, কিন্তু একটি রাজ্যে বিজেপি সরকার যখন সেই বিষের কৌটো সরিয়ে রেখে খাদ্য বণ্টন ব্যবস্থাকে উন্নত করায় মনোযোগ দেয়, তিনি কিন্তু তার প্রশংসা করতেও ভোলেন না। জঁ দ্রেজের সঙ্গে লেখা ভারত: উন্নয়ন ও বঞ্চনা বইয়ে তৎকালীন বিজেপি-শাসিত ছত্তীসগঢ়ের গণবণ্টন ব্যবস্থার প্রশংসা দেখেছিলাম।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্তৃতাটি মূলত স্মৃতিচারণ। পঞ্চাশের দশকের কলকাতার বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কী ভাবে তাঁর তর্কপ্রিয় সত্তাটি উন্মোচিত হতে থাকল, তার এক চমৎকার ছবি উঠে আসে। আসে কয়েক জন মানুষের কথা, যাঁরা সকলেই পরবর্তী কালে স্বনামধন্য চিন্তাবিদ। তাঁদের সান্নিধ্য তাঁর চিন্তাজগৎ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে যে বিশেষ ভূমিকা নেয়, তার অকুণ্ঠ স্বীকৃতিও দেখতে পাই। আবার, মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি যাদবপুরে পূর্ণ অধ্যাপক নিযুক্ত হলে পরশ্রীকাতর বঙ্গসমাজ কী রকম সমালোচনায় মুখর হয়েছিল তার কৌতুককর বর্ণনাও পাই।
বক্তৃতার যেমন একটি মূলসূত্র বা সারমর্ম থাকে, যার ইঙ্গিত তার শিরোনাম থেকে কিছুটা পাওয়া যায়, সাক্ষাৎকারে সাধারণত তা হয় না। এক প্রশ্ন থেকে আর এক প্রশ্ন একাধিক বিষয় ছুঁতে ছুঁতে যায়, এবং বিষয়গুলির বিস্তারিত বিশ্লেষণের সুযোগও তেমন থাকে না। কিন্তু আশ্চর্য হতে হয়, নাতিদীর্ঘ উত্তরগুলিতে তাঁর সুনির্দিষ্ট অবস্থানটি যেমন স্পষ্ট ভাবে রাখেন, তাদের যৌক্তিক ভিত্তিও প্রাঞ্জল ভাবে বুঝিয়ে দেন অমর্ত্য সেন। বইটির পরিকল্পনা, বক্তৃতাগুলির তর্জমা, সাক্ষাৎকারগুলির সঙ্কলন ও সম্পাদনা করেছেন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ও কুমার রাণা।