—প্রতীকী চিত্র।
গণতন্ত্র বিষয়ে কোনও বই পড়তে বসলে লেখকের ব্যক্তিপরিচয়ের গুরুত্ব কতখানি হওয়া বিধেয়? লেখকের নাম যদি স্যাম পিত্রোদা হয়, তা হলে সেই ব্যক্তিপরিচয়কে যথেষ্ট গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। তার প্রথম কারণ, গণতন্ত্রের তাত্ত্বিক (বা, নিদেনপক্ষে ভাবুক) হিসাবে পিত্রোদার কোনও পূর্বার্জিত খ্যাতি নেই। বইটিতেও স্পষ্ট যে, গণতন্ত্রের তত্ত্বের গভীরে যেতে তিনি বিশেষ আগ্রহী নন। তা হলে বইটা আদৌ পাঠযোগ্য হবে কেন? তার কারণও নিহিত আছে পিত্রোদার ব্যক্তিপরিচয়েই।
এক অর্থে তিনি ভারতীয় এবং বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সন্তান। ওড়িশার গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম তাঁর। জাতিপরিচয়ে তাঁর পরিবার নিম্নবর্ণের। যদি ১৯৪২ সালের বদলে তাঁর জন্ম হত ১৯০২ সালে? তা হলেও কি সেই পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে আমেরিকায় পিএইচ ডি করতে যেতে পারতেন তিনি, শতাধিক পেটেন্টের অধিকারী হতেন, পরবর্তী কালে ভারতের আর্থিক উন্নয়নের একটি বিশেষ পর্বের পুরোধা হয়ে উঠতে পারতেন? কেউ ভীমরাও রামজি আম্বেডকরের উদাহরণ দিয়ে বলতেই পারেন যে, শতাব্দী পরিবর্তনের মুহূর্তে দরিদ্র দলিত পরিবারে জন্ম হলেও সম্ভব হত এই উত্তরণ। তবে, আম্বেডকরের বিদেশযাত্রায় প্রয়োজন হয়েছিল রাজ-অনুগ্রহের। পিত্রোদার তা দরকার হয়নি। কারণ, জন্মমুহূর্ত নিশ্চিত করছিল যে, তিনি বড় হবেন নেহরু-যুগের গণতন্ত্রের ভাবনায়— যে সময়ে ভারতীয় রাষ্ট্র প্রথম বার নাগরিককে তাঁর ধর্ম, জাতি বা আর্থিক অবস্থানের বাইরে, শুধুমাত্র ভারতের নাগরিক হিসাবে দেখার চেষ্টা করেছিল। যে রাষ্ট্র চেয়েছিল সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে। পিত্রোদা সেই রাষ্ট্রভাবনার উত্তরাধিকার বহন করেন।
গণতন্ত্র বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি একটি অধ্যায় বরাদ্দ করেছেন গণতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের সম্পর্কের জন্য। নির্দ্বিধায় জানিয়েছেন, তিনি ধনতন্ত্রের সমর্থক। কোন ধনতন্ত্রের? যা বাজারব্যবস্থার মাধ্যমে এক ধরনের সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করে— যেখানে ভারতের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা এক যুবকের পক্ষে সম্ভব হয় উন্নত দুনিয়ার প্রথম সারির সংস্থার অগ্রণী কর্মী হয়ে ওঠা। গণতন্ত্র এমন পরিস্থিতি তৈরি করে, যেখানে ধনতন্ত্রের বিকাশ সম্ভব— সুযোগের সমতা, নাগরিকের পছন্দ ও ব্যক্তিগত মতামতের গুরুত্ব ইত্যাদি ধনতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। অন্য দিকে, পিত্রোদা লিখেছেন, ধণতন্ত্রে একটি মজবুত ও বিস্তৃত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে, গণতন্ত্রে যার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু, একই সঙ্গে থেকে যায় সাঙাততন্ত্র গড়়ে ওঠার সম্ভাবনা, যেখানে গণতন্ত্রের শীর্ষে অবস্থিত নেতার সঙ্গে সংযোগ গড়ে ওঠে কতিপয় শিল্পপতির— সেই নেতার ক্রমে অগণতান্ত্রিক হয়ে ওঠার সুফল পান সেই শিল্পপতিরা, আর উল্টো দিকে তাঁরাও মদত জুগিয়ে চলতে থাকেন সেই একনায়ককে। ঘটনাক্রম যদি অতিপরিচিত বলে মনে হয়, তা হলে বলার যে, পিত্রোদা সচেতন ভাবেই সেই পরিচিত ঘটনাক্রমের কথা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন। ধনতন্ত্র বলতে তিনি যার কথা বলছেন, সেখানে রাষ্ট্রের প্রশ্নাতীত দায়বদ্ধতা নাগরিকের প্রতি— পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মুনাফা যাতে গুটিকয়েক হাতে জমা না হয়ে নাগরিকের মধ্যে সমতার নীতি বজায় রেখে বণ্টিত হয়, তা নিশ্চিত করার কথা বলেছেন তিনি।
দি আইডিয়া অব ডেমোক্র্যাসি
স্যাম পিত্রোদা
৬৯৯.০০
পেঙ্গুইন বিজ়নেস
ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় পিত্রোদার প্রধানতম গুরুত্ব যে সময়কালে, তখনও আর্থিক উদারীকরণ ভবিষ্যতের গর্ভে। রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বে পিত্রোদা ভারতে টেলিকমিউনিকেশন বিপ্লবের পুরোধা ছিলেন। সে প্রসঙ্গ এসেছে বইটিতে। তিনি জানিয়েছেন, কত সহজে কত বেশি মানুষের কাছে টেলিফোন সংযোগ পৌঁছে দেওয়া যায়, সেই ভাবনা থেকেই তৈরি হয়েছিল রাস্তার মোড়ে-মোড়ে পিসিও তৈরির মডেল। আর্থিক উন্নতির জন্য যে আর্থিক অবস্থা নির্বিশেষেই নাগরিককে দ্রুততর যোগাযোগব্যবস্থার শরিক করে তোলা প্রয়োজন, এই রাষ্ট্রভাবনাটি গণতন্ত্রের একটি বিশেষ দিকের কথা বলে, যে কথা সচরাচর গণতন্ত্র বিষয়ক সন্দর্ভে পাওয়া যায় না। এখানেই বইটির গুরুত্ব।
আরও একটি বিষয়ের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য— একটি অধ্যায়ে পিত্রোদা প্রযুক্তির সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্কের কথা আলোচনা করেছেন। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার কী ভাবে ফেক নিউজ়ের রমরমায় সহায়ক হয়েছে, বিশ্ববাসী সে কথা অভিজ্ঞতায় জেনেছেন। কৃৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেই বিপদকে এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে, টের পাওয়া যাচ্ছে সে কথাও: কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা, কোনটা বানিয়ে তোলা— তা বোঝা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। কাজেই, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বিষয়ক আলোচনায় প্রযুক্তির প্রশ্নটি ক্রমে অপরিহার্য হয়ে উঠছে। বোঝা প্রয়োজন, গণতন্ত্রের স্বার্থে তাকে কী ভাবে ব্যবহার করা সম্ভব।
বইটির খামতিগুলিও স্পষ্ট। প্রথমত, অনেকগুলি অধ্যায়েই যে কথা আলোচিত হয়েছে, তার জন্য নতুন করে বই লেখার প্রয়োজন পড়ে না— বর্তমান ভারতের অবস্থা সম্বন্ধে অবহিত পাঠক এমনিতেই সে কথা জানেন। মোদী-জমানা ভারতীয় গণতন্ত্রের কী ক্ষতি করছে, সে কথা অতি অবশ্যই আলোচনার যোগ্য— কিন্তু, সে আলোচনাকে যে স্তরে উন্নীত করতে হয়, পিত্রোদা সেখানে পৌঁছননি। লেখাগুলির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সেগুলি ‘পয়েন্ট বাই পয়েন্ট, প্যারা বাই প্যারা’ লেখা— ছোট ছোট প্যারাগ্রাফে আলোচনা করা হয়েছে এক-একটি বিষয়। ফলে, অনেক ক্ষেত্রেই আলোচনা থেকে গিয়েছে বিষয়ের উপরি-স্তরে, গভীরে যাওয়া হয়নি। রয়েছে বেশ কিছু তথ্যগত ভ্রান্তিও। যেমন, এক জায়গায় রয়েছে, ভারতে ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। সম্পাদনার এ-হেন ত্রুটি অক্ষমণীয়।