পাঠক: সহজ পাঠ-এ নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি
সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “প্রথম পর্বে পরিচয় ছিল কাগজের আন্দোলন, দ্বিতীয় পর্বে পরিচয় হল আন্দোলনের কাগজ।” ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৯৩১ সালে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সম্পাদনায় পরিচয়-এর যাত্রা শুরু। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “দুঃসাহসে ভর করে তুমি ‘পরিচয়’ ত্রৈমাসিক বের করেছ।” ১৯৪৩ সালে হাত বদল হয়ে মার্ক্সবাদীদের শিল্পচর্চার কাগজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল পরিচয়। কিন্তু সঙ্কীর্ণ রাজনীতির বোধকে পাশ কাটিয়ে ১৯৬৩ সালে ভবানী সেন লিখিত ভাবে ঘোষণা করেছিলেন, পরিচয় পার্টি-পত্রিকা হবে না, শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞানের জগতে সত্যসন্ধানের ক্ষেত্রস্বরূপ পরিচয় প্রগতি শিবিরের নির্দলীয় রূপ। সেই ঐতিহ্য আজও রেখে চলেছে পত্রিকাটি। নব্বই বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রবন্ধ ও গল্প সঙ্কলনের তিনটি করে খণ্ড প্রকাশের উদ্যোগ করেছেন সম্পাদকমণ্ডলী। প্রথম খণ্ড দু’টি হাতে পাওয়া গেছে।
প্রবন্ধ সঙ্কলনে রবীন্দ্রনাথের ১৯৪১-এ লেখা ‘সৃষ্টির আত্মগ্লানি’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারতে সহিংস সাম্প্রদায়িকতার আবিলতায় আলোকপিপাসু লেখকচিত্তের তীব্র আর্তি ও নৈরাশ্যকে বিরল ভঙ্গিতে প্রকাশ করেছে, “বর্বর এখনো মরেনি, কদর্য এখনো তার রাজ্যের জন্য লড়াই করছে।” পরিচয়-এই প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘কালান্তর’, যেখানে অপরিসীম বেদনায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “ক্রমে ক্রমে দেখা গেল য়ুরোপের বাইরে অনাত্মীয়মণ্ডলে য়ুরোপীয় সভ্যতার মশালটি আলো দেখাবার জন্যে নয়, আগুন লাগাবার জন্যে।” হীরেন্দ্রনাথ দত্তের ‘মননের নিয়তি’ প্রবন্ধে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন পরিক্রমার পরের প্রবন্ধ প্রমথ চৌধুরীর লেখা ‘মার্কস-এর ডায়ালেকটিক’। আশ্চর্য অন্তর্ভেদী মন্তব্য তাঁর, “রুশিয়ার Communism-এর দর্শন থেকে উদ্ভূতও নয়, তার উপর প্রতিষ্ঠিতও নয়। কোন নূতন সামাজিক ব্যবস্থা কোন পুরনো idea-র কথায় কথায় অনুবাদ হয় না। এই নব Communism-এর সঙ্গে Dialectical Materialism-এর সম্পর্ক হচ্ছে দেহের সঙ্গে বেশের যে সম্পর্ক সেই জাতীয়।” প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বইতে বিবেকানন্দ তাঁর স্বাভাবিক বলিষ্ঠতায় ঘোষণা করেছিলেন, “আর্যরা কোথা হতে উড়ে এসে ভারতের ‘বুনোদের’ মেরে কেটে জমি ছিনিয়ে বাস করলেন— ও সব আহাম্মকের কথা। আমাদের পণ্ডিতরাও দেখেছি সে গোঁয়ে গোঁ— আবার ঐ সব বিরূপ মিথ্যা ছেলেপুলেদের শোনানো হচ্ছে।” সম্পূর্ণ বিপরীত মত প্রকাশ করেছেন তাঁর অনুজ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ‘আর্যতত্ত্ব’ প্রবন্ধে। “এ দেশে শাসক শ্রেণির স্বার্থ ও দেশি বনিয়াদী স্বার্থ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বনিয়াদী স্বার্থ একত্রিত হওয়ার ফলেই ভারতীয় ইতিহাসের ব্যাখ্যায় বিড়ম্বনা ভোগ করিতে হয়। ...ভারতের ইতিহাসে ‘আর্য’ নামক একটা মূলজাতির অস্তিত্ব খোঁজা ও তাহার কীর্তিকলাপ অনুসন্ধান বা সেই দৃষ্টিকোণ দ্বারা ভারতীয় কৃষ্টি ও ইতিহাসের ব্যাখ্যা করা সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক।” অর্ধেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায় ‘ভারতের ভাস্কর্য’ প্রবন্ধে গ্রিক ও রোমান ভাস্কর্যের প্রতিতুলনায় ভারতের ভাস্কর্যের নিজস্ব চারিত্র্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিশেষত পশুমূর্তি সৃষ্টিতে পাশ্চাত্যের ভাস্কর যেখানে বাস্তব আদর্শ থেকে নড়তে চাননি, সেখানে “প্রকৃতির আদর্শ ও সৃষ্টি অতিক্রম করে নূতন কল্পনার রূপ সৃষ্টি করবার অধিকার যে শিল্পীর আছে, ভারতের পশুচিত্রে তার যথেষ্ট প্রমাণ আমরা পাই।”
পরিচয় ৯০ বছর পূর্তি উদ্যাপন প্রবন্ধ-সংকলন ১
সম্পা: অভ্র ঘোষ, পার্থপ্রতিম কুণ্ডু
৭৫০.০০
মননচর্চার যে বিপুল ঐশ্বর্যময় ধারা নব্বই বছর জুড়ে পরিচয় ধারণ করেছে, তাতে সঙ্কলকদের নির্বাচনের কাজ নিঃসন্দেহে কঠিন। নতুন করে মুগ্ধ করে অতুলচন্দ্র গুপ্তের ‘রীতিবিচার: শ্লেষ’— সংস্কৃত, বাংলা ও পাশ্চাত্য সাহিত্যে সাত সমুদ্রের নাবিক লেখক বাংলা গদ্যের চলনটি লক্ষ করেন, “গত একশো বছর ধরে বাংলা গদ্য-সাহিত্যের ‘স্টাইল’ যে বদলে আসছে তার গতি হচ্ছে দীর্ঘ সমাস ও দীর্ঘ শব্দ, আলঙ্কারিকেরা যাকে বলেন ‘উদ্ধত পদ’,— তার গাঢ় বন্ধত্বের মায়া ছেড়ে, ছোট ছোট টুকরো দিয়ে বাক্যকে গাঢ় করে গড়ে তোলার দিকে। অর্থাৎ গৌড়ী ওজঃ ছেড়ে বাংলা গদ্য বৈদর্ভী শ্লেষের পথ ধরেছে, যে পথ সংস্কৃত গদ্য কখনও খুঁজে পায়নি।” আফসোস হয়, কেন আরও লিখলেন না তিনি। আইনব্যবসার চাপে সময় যে বড় কম পেয়েছেন। নলিনীকান্ত গুপ্ত লেখেন, “কাব্যে শালীনতাই অন্তরাত্মার নিজস্ব ধর্ম। শালীনতার অভাব যা— অর্থাৎ অন্তরাত্মার অভাব যা তাকেই বলা যায় গ্রাম্যতা (vulgarity)।”
পরিচয় ৯০ বছর পূর্তি উদ্যাপন গল্প-সংকলন ১
সম্পা: সাধন চট্টোপাধ্যায়, পার্থপ্রতিম কুণ্ডু
৭৫০.০০
গাঙচিল
শহিদ সুরাবর্দি আজ প্রায় বিস্মৃত নাম। পাশ্চাত্য আধুনিক নাট্যকলা নিয়ে তাঁর দিগদর্শী প্রবন্ধটি মুগ্ধ করে। বরং মনে দ্বিধা জাগে ভাষাচার্য সুনীতিকুমারের ‘ভারত ও সংস্কৃত’ প্রবন্ধের কিছু পর্যবেক্ষণে। তবে বিরুদ্ধ ভাবনা জাগানোও প্রবন্ধের এলাকাতেই পড়ে। “বর্তমানে আমাদের দেশে আঞ্চলিক ভাষার ওপরে এক নতুন ধরনের গুরুত্ব (এবং বলতে বাধ্য হচ্ছি যে অযৌক্তিক গুরুত্ব) আরোপ করা হচ্ছে।” সুনীতিকুমারের মনে হয়েছে দেশভাগের একমাত্র কারণ “এমন জনকয়েক মুসলমান নেতা ছিলেন যাঁদের মানসিকতায় সংস্কৃত ভাষার কোনও স্থান ছিল না।” ব্যক্তিগত স্তরে ভাল লেগেছে রাধারমণ মিত্রের ‘মহাত্মা গান্ধী, সাবরমতী আশ্রম ও আমি’। আশ্রমে বইপড়া নিষিদ্ধ, তাই তলস্তয়ের নিজের হাতে মহাত্মাজির নাম লিখে উপহার দেওয়া দ্য কিংডম অব গড ইজ় উইদিন ইউ পড়তে গিয়ে মগনলাল গান্ধীর রোষের পাত্র হন লেখক। যদিও গান্ধীজির সঙ্গে স্নেহসম্পর্ক অটুট ছিল। গান্ধীজির তাঁকে লেখা শেষ চিঠি— ‘রিমেমবার মি সামটাইমস ইফ আই ডাই’— লেখকের চোখে জল এনে দিয়েছিল। কাজী আবদুল ওদুদের ‘পথ ও পাথেয়’ আর একটি অসামান্য প্রবন্ধ। মুসলিম নেতা হিসেবে ইকবালকে চেনাতে গিয়ে কী তীব্র সত্যসন্ধানী মন্তব্য ওদুদের, “ইকবাল বলেছেন ইসলাম মানুষের জন্য ‘আরে হায়াত’ মৃতসঞ্জীবনী, ডা মুঞ্জে বা শ্রীঅরবিন্দ বলেছেন, হিন্দুত্ব মানুষের জন্য অমোঘ বিধান— এ সব কথা মানুষ কখনও ধীরেসুস্থে বুঝে দেখতে চেষ্টা করবে কি না জানি না, কিন্তু এর প্রভাবে ভারতবাসীর জীবন যে হয়ে উঠল দুর্বহ।” মণীন্দ্রকুমার ঘোষ ‘সাহিত্যের হট্টগোল’ নামে প্রখর প্রবন্ধটিতে ভুল শব্দ ব্যবহারের যে তালিকা দিয়েছেন তা অবশ্যপাঠ্য। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের গদ্য কোনও দিনই সরলতার ধার ধারেনি, কিন্তু চিন্তনের উজ্জ্বলতায় সেই জটিলতা পিছনে পড়ে যায়। “সৌরমণ্ডলে যেমন সূর্যের প্রাধান্য অনস্বীকার্য, মনুষ্যসমাজে তেমনই মহামানব নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু সমগ্র সৌরমণ্ডলের অনুপাতে স্বতন্ত্র সূর্য যে কারণে গৌণ, ঠিক সেই কারণে মানবগোষ্ঠীর তুলনায় মহামানব নিকৃষ্ট”— এই অভিমতের তুলনা পাই না। পরিচয়-এর উদার পরিসরে বিপরীতধর্মী মতকে চিরকাল সাদরে স্থান দেওয়া হয়েছে। সুনীতিকুমারের প্রবন্ধের বিপরীত সুর অন্নদাশঙ্করের লেখায়, “তুর্ক মুঘল প্রভৃতি ইসলামপন্থীদের আগমনের পূর্বেই আমাদের সংস্কৃতভিত্তিক সংস্কৃতি বস্তুজ্ঞান হারিয়েছিল।... আরবি পারসি শিক্ষার দ্বার হিন্দুদের কাছেও মুক্ত ছিল। যারা টোলে চতুষ্পাঠীতে প্রবেশ পেত না তারা মক্তবে মাদ্রাসায় প্রবেশ পেত। শূদ্ররা সংস্কৃত থেকে বঞ্চিত ছিল। আরবি ফারসি থেকে বঞ্চিত হল না।” সাহিত্য আলোচনামূলক প্রবন্ধগুলি আজও বিশ্লেষণে চমক জাগায়। গোপাল হালদারের ‘দ্রৌপদীর বিচার’, আবু সয়ীদ আইয়ুবের ‘সাহিত্যের চরম ও উপকরণমূল্য’, অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তীর স্টিফেন স্পেন্ডার ও উইনিফ্রেড হোলটবির কবিতা আলোচনা মনে রয়ে যায়। সমগ্র সঙ্কলনটি এক স্বচ্ছ যুক্তিবাদিতা ও মানবতাবোধে পাঠককে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা জারি রাখে। আবুল ফজল ‘মানব তন্ত্র’ প্রবন্ধে যে মন্তব্য করেছেন তা দিয়ে আলোচনা শেষ করি, “ধর্ম বা সিকুলারিজ়ম কোনওটাই মানুষকে বাঁচাতে পারেনি। কাজই ধর্ম নয়, সিকুলারিজ়মও নয়। একমাত্র মানবতার ওপরই জোর দিতে হবে।”
গল্প সঙ্কলনটিতে ত্রিশের দশক থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত যাত্রাপথে বিক্ষুব্ধ সময়ের দলিলীকরণ ঘটেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশভাগ, সাম্যবাদী আন্দোলন ও স্বাধীনতা-পরবর্তী নৈরাশ্যের ছবির সঙ্গে বাংলা ছোটগল্পের গড়ন কী ভাবে নতুন নিরীক্ষার পথে চলেছে, ভাষা গহনচারী হয়ে উঠছে, তার পথরেখা আছে। এমন কয়েকজন লেখকের গল্প আমাদের বিরল পাঠ-অভিজ্ঞতায় পৌঁছে দেয় যাঁরা ছোটগল্পলেখক হিসাবে নন, অন্য পরিচয়ে খ্যাত, যেমন সোমনাথ লাহিড়ী, বিনয় ঘোষ। সরোজকুমার রায়চৌধুরী, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, সোমেন চন্দ, যুবনাশ্বর আশ্চর্য গল্পগুলি পাঠককে বিষণ্ণ করে— কী ভাবে এঁরা বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেলেন। এই দলেই আছেন নবেন্দু ঘোষ ও বরেন বসু। সঙ্কলিত গল্পগুলি ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ কালের পটে বাংলা গল্পের ঐশ্বর্যময় যাত্রাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
দু’টি সঙ্কলনেই সম্পাদনা, মুদ্রণ ও পরিসজ্জায় যত্ন ও পারিপাট্যের ছাপ। বাকি খণ্ডগুলির জন্য প্রতীক্ষা রইল।