বিশ্বাস: মৌলালির দরগায় জলপড়ার জন্য আকুল প্রতীক্ষা। রণজিৎ সিংহের তোলা ছবি।
কবি অরুণ মিত্র বলেছিলেন রণজিৎ সিংহ প্রসঙ্গে, ‘‘ওর গদ্য খুব ভালো। জীবন দিয়ে লেখে।’’ প্রথম গদ্যের বই মাটির সুরের খোঁজে (১৯৯০) বেরিয়েছিল রণজিতের প্রথম কবিতার বই (স্থান কাল পাত্র, ১৯৬৬) বেরনোর অনেক পরে। চারটি গদ্যের বই আর বেশ কিছু অগ্রন্থিত নিবন্ধ সম্মিলিত এই গদ্য সংগ্রহ নাগালে আসার সুবাদে পাঠকের নতুন করে সমর্পণ অরুণ মিত্রের ওই মন্তব্যের কাছে। চারটির মধ্যে শেষ বইটি আলোকচিত্রের ভাষা আর বাহারি আটপৌরে গদ্যের যোগাযোগে কলকাতার প্রাণস্পন্দনকে স্পর্শ করেছিল। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মর্মস্পর্শী ভূমিকা-সহ বেরিয়েছিল, রণজিৎ সিংহের (১৯৩৭-২০০১) আকস্মিক মৃত্যুর পরের বছর। রণজিতের উদাত্ত কণ্ঠ, প্রাণখোলা হাসি, রণজিৎ-মাধুরী সিংহের দৈনিক প্রাতঃভ্রমণের লা-জবাব সব গল্প তখনও পরিচিতজনের সদ্য স্মৃতি। ২০০২-এ ‘বাংলা বই’ আলোচনাপত্রে প্রকাশ পায় ‘কবির সঙ্গে বিহুর মাটিতে’, সূচনায় ছিল দেবেশ রায়ের আন্তরিক কথামুখ। সম্পাদকীয় যত্নে ওই কথামুখ আর ভূমিকা যুক্ত হয়েছে এই গদ্য সংগ্রহের ‘গ্রন্থপরিচয়’ অংশে। পড়তে পড়তে মনে হল, রণজিৎ সিংহের মৃত্যুর আকস্মিকতা থেকে আজ, এত দিন পরেও, তাঁর পুরনো পাঠকদের মন পুরোপুরি মুক্ত হয়নি। আরও বিষণ্ণ লাগছে, এ বই মাধুরী সিংহের দেখা হল না বলে। রণজিতের লোকসঙ্গীত সংরক্ষণ, লেখা, ছবি তোলা, আঁকা— অর্থাৎ সঙ্কলন-সম্পাদক শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কথায় ‘বাণিজ্যবাতাসের বিপরীতে এক সাংস্কৃতিক বিকল্পের স্বপ্ন’ (গদ্য সংগ্রহ ১, পৃ ৩৯৫) লালন করায় মাধুরীর ছিল অন্তহীন আগ্রহ এবং সহযোগ। প্রসঙ্গত মনে পড়ে তাঁর পাগল নিয়ে ঘরকন্না এবং অন্যান্য (কথাপ্রকাশ, ২০১১) বইটির কথা।
দ্বিতীয় খণ্ডের ‘অগ্রন্থিত রচনা’ অংশে রণজিৎ সিংহের করা বারোটি পুস্তক পর্যালোচনা গ্রন্থিত হয়েছে ‘কেতাবমহল’ শিরোনামে। তাঁর মতো সুরসিকের নিশ্চয় পছন্দ হত এই নামকরণ। ‘আত্মজনকথা’য় চিত্তপ্রসাদ, কামরুল হাসান, মণীন্দ্র গুপ্ত, রাহুল সাংকৃত্যায়নের (তাঁর ভবঘুরে শাস্ত্র অনুবাদও করেছেন রণজিৎ) উজ্জ্বল খণ্ডচিত্রগুলি একান্ত মনোজ্ঞ। তবে ‘কথাশিল্পের আড্ডা’ সম্ভবত সব থেকে জরুরি। পরের যুগের পাঠক যদি সংস্কৃতি আর আড্ডার দেওয়া-নেওয়া নিয়ে বিকল্প ইতিহাস রচনা করতে চান, তবে এই নিবন্ধটি হবে বিকল্পবিহীন তথ্যসূত্রের উপমা। প্রথম খণ্ডের ‘অগ্রন্থিত রচনা’ অংশের নিবন্ধের পৃষ্ঠানির্দেশে সূচিতে যে ভ্রান্তি আছে, সূচির ক্রম আর বইয়ের ভিতরে নিবন্ধের ক্রমে যে-অসঙ্গতি আছে, তা দেখলে স্বভাবসুলভ উচ্চ কণ্ঠে নিশ্চয় শাসন করতেন রণজিৎ, যাতে অনেকখানি স্নেহও নিহিত থাকত।
একটা সময় আর সেই সময়ের সংলগ্ন বিশিষ্ট এক মন বিছিয়ে আছে সংগ্রহটিতে। বিহারের ছাপরা জেলার কক্র্হট গ্রাম থেকে নদিয়ার আলমডাঙা— এই পরিক্রমার ইতিবৃত্ত যে-মানুষের অতীত, তিনি দেশভাগের পর মুর্শিদাবাদের রেজিনগর, বেলডাঙা হয়ে অনেক ভাঙচুরের ভিতর দিয়ে কলকাতায় পৌঁছলেন। কুড়ি বছর বয়সে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পেলেন, তিন-চার বছরেই বুঝলেন, সক্রিয় রাজনীতি তাঁর জন্য নয়। ইতিমধ্যেই হাতের কাজের দৌলতে বন্ধুমহলে তাঁর নাম ‘পোস্টারমাস্টার’। লোকসঙ্গীত সংগ্রহে, ‘ফোকমিউজিক অ্যান্ড ফোকলোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট’কে সমৃদ্ধ করে তোলার তাগিদে রণজিতের পরবর্তী যাত্রা। সে যাত্রাপথের বিন্যাস মেলে মাটির সুরের খোঁজে আর বস্তার অরণ্যের সুর (১৯৯৫) বই দু’টিতে। মাটির গন্ধমাখা নিখাদ লোকসঙ্গীত খুঁজতে গেলে যে বিকৃত, আধুনিকতার তালেগোলে দুষ্ট মিথ্যে সুর আর অসত্য গায়নকে প্রত্যাখ্যান করার জোর চাই, সেই সত্যি ছড়িয়ে আছে ছত্রে ছত্রে। অনন্তবালা বৈষ্ণবী থেকে তিজন বাঈ, রণেন রায়চৌধুরীর সুনামগঞ্জ থেকে উত্তরবঙ্গের কুনোর গ্রামে বাংলাদেশ-দিনাজপুরের হরেন্দ্রনাথ রায়ের গলায় ভাওয়াইয়া আর চটকা শোনা। রণজিৎ জানাতে ভোলেন না, প্রচলিত খঞ্জনি কেনার পয়সা নেই বলে সাইকেলের এক জোড়া বাতিল করা বেলের বাটি দিয়ে হরেন বানিয়েছেন তাঁর গানের সঙ্গত। এ খঞ্জনিতে ধ্বনির অনুরণন দীর্ঘতর। আবার উত্তরশিবপুরে গরিব চাষি ধর্ম রায়ের গান শোনার বর্ণনায় এসে পড়ে উত্তরবঙ্গের দোতারায় মুগার সুতো আর পূর্ববঙ্গের দোতারায় তারের ব্যবহারের প্রসঙ্গ। সুনামগঞ্জের দোকানদার বিদায়ের মুহূর্তে বলে ওঠেন ‘‘আজ না হয় আমরা ভিন্ন হয়েছি, কিন্তু আমরা তো এক মায়ের সন্তান।’’
সব মিলে মনে হয়, লেখকের অমলিন জীবনের সানন্দযাপন যেন রূপকথারই নামান্তর। সেই রূপকথাই যেন বলে চলেছে নিজের পছন্দসই আরও আরও রূপকথা। সঙ্গে খালেদ চৌধুরী (রণজিতের লোকসঙ্গীত সংগ্রহের উপরে যাঁর ছিল অসীম ভরসা), যুধাজিৎ সেনগুপ্তর বিশিষ্ট সব অলঙ্করণ। লোকসুর সংগ্রহের পথপরিক্রমায় রণজিৎ কখনও লালন করেন অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের পাঠস্মৃতি, কখনও বা পড়েন দেবেশ রায়ের মফস্বলি বৃত্তান্ত। আজ বাণিজ্যবাতাসের তোড়ে চারপাশ যতই থরথর করে, প্রচারমাধ্যমের ঝলকানি লোকসঙ্গীতের নামে যতই ভুলিয়ে দিতে চায় সে-সঙ্গীতের সত্যিকে, ততই সংস্কৃতির বিকল্প স্বপ্ন রূপকথায় উপমা পায়। বস্তারে সুর খুঁজতে খুঁজতে তির্থা গ্রামে দণ্ডামি মাড়িয়া পরিবারের যাপনছন্দে মুগ্ধ হয়েছিলেন রণজিৎ— ‘‘অদ্ভুত পরিশ্রমী আর পরিচ্ছন্ন এই মানুষেরা। অথচ পরিশ্রমের কোনো ভার নেই... নৃত্যময়। ছন্দ আর সুরে বাঁধা। মুখে হাসি... আতিথ্যে, আপ্যায়নে... ঝরে পড়ে।’’ (গদ্য সংগ্রহ ১, পৃ ৩০৭)। লেখার বিষয় আর লেখার গদ্য এমন মিলেমিশে যায় যে, কে কার উপমা, তা ঠাহর হয় না।
রণজিৎ সিংহ/ গদ্য সংগ্রহ ১,২
সম্পাদক: শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়
৬০০.০০ প্রতি খণ্ড
৯ঋকাল বুকস
‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকার পাতা ভরানোর জন্য নাকি লেখা হয়েছিল তৃতীয় বই দখিন হাওয়া-র (২০০০) অধিকাংশ নিবন্ধ। ঘুমভাঙানিয়া দোয়েলপাখি, কলকাতার গাছপালা, বিশিষ্ট গ্রুপ থিয়েটার প্রযোজনা প্রসঙ্গে দর্শকের প্রতিক্রিয়া, কন্যাসমা নাবালিকার সামনে গল্পের ভুবন উন্মোচিত করা— এমন সব বিচিত্র প্রসঙ্গে লেখা যখন প্রথম পড়েছিলাম পত্রিকার পাতায়, তখন রণজিৎ সিংহের প্রাণবন্ত কণ্ঠস্বর বা চতুষ্পার্শ্ব সচকিত করা তাঁর হাসি নিয়মিত শোনা যেত পত্রিকা দফতরের ভিতরে, বাইরে। জীবনের এমন প্রাচুর্য সহসা চোখে পড়ে না। অসুখবিসুখের প্রসঙ্গে চরম বিরক্তি— চিড়িয়ার জান নিয়ে বাঁচার মানেটা কী? আজ যখন নতুন করে পড়ি সদা-সরব পয়েন্টসম্যান লালচনকে নিয়ে সেই কবেকার লেখা ‘লালচন’, স্মৃতিমেদুর বিষাদ ভর করে। রণজিৎ লিখেছিলেন, ‘‘আজকাল... মনে হয় আমি ইয়ার্ডে পড়ে থাকা একটা ওয়াগন... এমনকী আমার দেশ বলে যে ভৌগোলিক পরিচিতিটা আমাকে মুখস্থ করানো হয়েছে, সে-সমস্তই... ইয়ার্ডে পড়ে থাকা একটা ওয়াগন... ইঞ্জিন নেই... এগোনো নেই। কম্মের মধ্যে তার চাকা কেবল মরচের সঞ্চয় বাড়িয়ে চলেছে।’’ (গদ্য সংগ্রহ ২, পৃ ৩৬) একেই কি বলে জীবন দিয়ে লেখা?