দীনেশচন্দ্র সেনের (ছবি) বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়-এর খণ্ড দু’টি আনন্দ পাবলিশার্স নতুন করে প্রকাশ করেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ‘বঙ্গসাহিত্যের একজন প্রকৃত হিতৈষী’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রতি দীনেশচন্দ্রের কৃতজ্ঞতার অবধি ছিল না। প্রাচীন কাল থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের নানা নিদর্শনের নির্বাচিত এই সঙ্কলন দীনেশচন্দ্র তাই আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করেছিলেন। প্রথম ভারতীয় উপাচার্য হিসাবে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে যে মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পরবর্তী প্রচেষ্টায় সার্থক হয়েছিল। স্যাডলার কমিশনের অন্যতম সদস্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মডার্ন ইন্ডিয়ান ভার্নাকুলার’গুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষায় এম এ পড়ানো শুরু হয়। এ কাজ দীনেশচন্দ্র সেনের সহায়তা ছাড়া সম্ভব হত না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সভায় বাংলা ভাষা-সাহিত্যকে যাঁরা প্রাপ্য মর্যাদা দিতে চাইতেন না, তাঁদের যুক্তি ছিল যে, বাংলায় পড়ার মতো কী বা আছে? যদি বাংলায় এম এ পড়ানো হয়, তা হলে তো মুদির দোকানের কাগজও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো যেতে পারে। বাংলা ভাষা-সাহিত্যে পড়ার মতো যে অনেক কিছুই আছে, তা প্রমাণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের আগেই পূর্ববঙ্গীয় দীনেশচন্দ্র প্রাগাধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রেমে পড়েছিলেন। তাঁর জীবনকাহিনি ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য বইতে তিনি জানিয়েছিলেন, ভারতীয় মাপকাঠিতে ইংরেজি সাহিত্যের একটি ইতিহাস লেখার ইচ্ছে ছিল তাঁর, এই বাসনা সাহেবদের ভারতবিদ্যাচর্চার প্রত্যুত্তর। সাহেবরা গঙ্গাকে ‘গ্যাঞ্জেস’ বলতে যদি লজ্জা না পান, তা হলে দীনেশচন্দ্র শেক্সপিয়রকে ‘শেক্ষপীর’ বলতে দ্বিধা করবেন কেন! ইংরেজি সাহিত্যের সেই ইতিহাস বই অবশ্য তাঁর লেখা হয়নি। এই সময় কলকাতা পিস অ্যাসোসিয়েশন বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে গবেষণামূলক সেরা প্রবন্ধ রচয়িতাকে রৌপ্যপদক প্রদান করা হবে। যে জাতীয়তাবাদী উদ্দীপনা থেকে ভারতীয় মাপকাঠিতে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস লিখতে উৎসাহী হয়েছিলেন, সেই উদ্দীপনা থেকেই দীনেশচন্দ্র ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভাষা ও সাহিত্য লিখতে শুরু করলেন। বছর ছয়েক বাদে তা প্রকাশিত হল। উনিশ শতকের শেষ দশকে বইটিকে চিন্তকরা সাদরে গ্রহণ করলেন। দীনেশচন্দ্র লিখেছিলেন, “অযাচিত ভাবে কলিকাতা হইতে রাশি রাশি প্রশংসার অতিশয়োক্তি আসিতে লাগিল। রবীন্দ্রবাবু, রামেন্দ্রবাবু, হীরেন্দ্রবাবু, নগেন্দ্রবাবু পুস্তকখানির বিশেষ প্রশংসা করিয়া পত্র লিখিলেন।”
বঙ্গ সাহিত্য পরিচয় (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড একত্রে)
দীনেশচন্দ্র সেন
৫০০০.০০
আনন্দ পাবলিশার্স
এই বই পূর্ববঙ্গের দীনেশচন্দ্রকে কলকাতামুখী করল। উনিশ শতকের শেষ দশক এমনিতেই বাঙালির ভাষিক আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার নানা প্রয়াসে পরিপূর্ণ। বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব লিটারেচার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রূপ পরিগ্রহ করল। রবীন্দ্রনাথ ‘শিক্ষার হেরফের’ লিখে বাংলা ভাষাকে জ্ঞানচর্চার বাহন হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিতে চাইলেন। এই ভাষিক আত্মপরিচয় প্রকল্পের রসদদার হয়ে উঠলেন তিনি। আশুতোষ দীনেশচন্দ্রকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে টেনে নিলেন। দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকের পদে নিযুক্ত হলেন। তাঁর কাজ গবেষণাধর্মী বক্তৃতা প্রদান ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুকূল্যে নানা মাপের গবেষণাগ্রন্থের প্রকাশ। একে একে প্রকাশিত হয়েছিল হিস্ট্রি অব বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার (১৯১১), দ্য বৈষ্ণব লিটারেচার অব মিডিয়েভাল বেঙ্গল (১৯১৭), চৈতন্য অ্যান্ড হিজ় কম্প্যানিয়নস (১৯১৭), দ্য ফোক লিটারেচার অব বেঙ্গল (১৯২০), দ্য বেঙ্গলি রামায়ণ (১৯২০)। নানা মাপের সঙ্কলন ও গবেষণাগ্রন্থের রচয়িতা হিসাবে দীনেশচন্দ্র প্রমাণ করেন যে, বাংলা সাহিত্যে— প্রাগাধুনিক বাংলা সাহিত্যে— পাঠযোগ্য বিশ্লেষণনির্ভর সাহিত্য উপাদানের অভাব নেই।
দীনেশচন্দ্র সেনের বঙ্গ সাহিত্য পরিচয় নামের এই সঙ্কলনটিকে এই ধারার সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে-বুঝতে হবে। আনন্দ সংস্করণের ভূমিকায় সত্যবতী গিরি যে ‘কথামুখ’ রচনা করেছেন, তাতে জানাতে ভোলেননি যে, সঙ্কলক দীনেশচন্দ্র ‘ভিক্টোরিয়ান রুচিবোধ নিয়ে’ প্রাগাধুনিক পর্বের রচনার অংশবিশেষ বাদ দিয়েছেন। সতী স্ত্রীর বৈশিষ্ট্য কী হবে, তা জানাতে রামেশ্বর যে সংস্কৃত শ্লোকের বাংলা রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন, তাতে ‘শয়নে স্বৈরিণী’ এই অংশটি ছিল— দীনেশচন্দ্রের সঙ্কলনে তা গৃহীত হয়নি। দীনেশচন্দ্র যে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের অংশীদার, তাতে ‘যৌন-নৈতিকতা’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায় দীনেশচন্দ্রের সতী গদ্যগ্রন্থটির কথা। ‘ষ্টুডেণ্টস্ লাইব্রেরী’ প্রকাশিত সচিত্র পকেট সতী বঙ্গদেশের ঘরে ঘরে পড়া হোক, এ ছিল দীনেশচন্দ্রের বাসনা। সে বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “আমাদের সর্ব্ববিষয়ে প্রাচীন আদর্শ যাহা ছিল, তৎসঙ্গে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের পরিচয় স্থাপন করা উচিত।” সর্ব বিষয়ে প্রাচীন আদর্শের কথা বললেও সেই প্রাচীনতার অনেক কিছুই অনালোচিত থাকে, রুচির দোহাই দিয়ে অনেক কিছু বাদ যায়। গণপরিসর ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিসর, উভয় ক্ষেত্রেই সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ পাঠ্য নির্বাচন ও বিশ্লেষণে দরকারে বর্জনের পক্ষপাতী।
দীনেশচন্দ্রের এই সঙ্কলনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়— হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কসূত্রের নানা নিদর্শন। ১৯১৪ সালে তিনি যখন এই সঙ্কলনের ইংরেজি ভূমিকা রচনা করছিলেন, তখন বাঙালি জীবনে হিন্দু-মুসলমান শুধু সামাজিকতার বিষয় নয়, রাজনৈতিকতারও বিষয়। এই ভূমিকা রচনার আগে রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে গ্রামে দরিদ্র মুসলমানরা কী ভাবে প্রবঞ্চিত হচ্ছিলেন, তার ছবি রবীন্দ্রনাথ এঁকেছিলেন। এই ভূমিকা রচনার বছর দুয়েক পরে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ঘরে-বাইরে উপন্যাসে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লেখক দেখিয়েছিলেন যে, কী ভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি দরিদ্র মুসলমানদের স্বার্থের বিরোধী হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে প্রাগাধুনিক সাহিত্য বিচারের সময় হিন্দু বাঙালির রচনার পাশাপাশি মুসলমান বাঙালির রচনার নিদর্শন তুলে ধরা জরুরি। দীনেশচন্দ্র তাঁর ভূমিকায় ব্রাহ্মণদের মুখে মুসলমানদের থুতু ছেটানোর কথা সনিদর্শন উল্লেখ করেছেন। মুসলমানদের হিন্দু নারী অপহরণ, মন্দির অপবিত্র করার প্রসঙ্গ এসেছে। আবার গোয়ালা সম্প্রদায়ের মানুষ কী ভাবে মৌলবিকে প্রত্যাঘাত করে, সে কথাও জানিয়েছেন। তবে সেই হিন্দুদের আগে উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে ‘মাইল্ড’ শব্দটি বসাতে ভোলেননি।
দীনেশচন্দ্র সেন সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার বশবর্তী ছিলেন না। প্রাগাধুনিক সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানদের অবদান নিয়ে পরবর্তী কালে তাঁর বই প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে চারটি বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন, এ বই তারই লিখিত রূপ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিদ্যাচর্চায় বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের প্রসঙ্গটি অনেক দিন পর্যন্ত অবিবেচিত থেকে গিয়েছিল। পরে ফাঁক পূরণ করার নানা চেষ্টা চোখে পড়ে। যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের বাঙ্গালার বৈষ্ণব-ভাবাপন্ন মুসলমান কবি বইটির কথাও মনে পড়বে। সে বই ‘হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয়ে বিশ্বাসী ভারত-রাষ্ট্রের প্রথম শিক্ষাসচিব মাননীয় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সাহেব’কে উৎসর্গ করা। দীনেশচন্দ্র যখন এই সঙ্কলন তৈরি করেন, বাঙালি মুসলমান বর্গটি নিয়ে যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করেননি।
বিশেষ কালপর্বের সাহিত্যের নিদর্শনবাহী সঙ্কলন নির্মাণ করতে গেলে নানা ফাঁক থাকবেই। তবে এই জাতীয় সঙ্কলনের গুরুত্ব অপরিসীম। সাম্প্রতিক অতীতে সাহিত্য অকাদেমি থেকে ভারতীয় সাহিত্যের পরিচয়বাহী নানা পর্বের সঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। তাঁরা যথাসম্ভব নানা ধারার রচনাকে ঠাঁই দিয়েছেন। দীনেশচন্দ্র এই সাহিত্য সঙ্কলন ১৯৪০-এর পর নির্মাণ করলে হয়তো অন্য ভাবে করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিদ্যাচর্চার যে পরিসর গড়ে তুলেছিল তার অভিমুখ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় আলাদা। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের প্রকৃত হিতৈষী দীনেশচন্দ্রের সঙ্কলনটির গুরুত্ব বিরাট। ইংরেজি ভূমিকার সুখপাঠ্য অনুবাদটি দীপঙ্কর রায়ের। ছাত্র-ছাত্রীরা ছাড়াও সাধারণ পাঠকদেরও সঙ্কলনটি কাজে লাগবে।