অবকাশ: ছুটির দিনের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ভিড়, ২০২২
আলোচ্য বইটিতে সঙ্কলিত হয়েছে বিগত পঁচিশ বছরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও দৈনিকে প্রকাশিত প্রবন্ধের নির্বাচিত কয়েকটি। ইতিহাসবিদের প্রবন্ধ সঙ্কলনে স্বাভাবিক ভাবেই উঠে এসেছে ইতিহাসের নানা বিষয়, তার স্বল্প-আলোকিত গলিঘুঁজি এবং ইতিহাসচর্চার জটিল বহুমাত্রিক রাজনীতি। এ ছাড়াও আরও বিচিত্র সব বিষয়ের উপর আলো ফেলে সঙ্কলনের লেখাগুলি। লেডি ডায়ানার জনপ্রিয়তা, গুজবের বিশ্বজনীন সংস্কৃতি, হ্যাকিং-এর (অ)নৈতিকতা, ‘গণতন্ত্রের গণৎকার’ অর্থাৎ সেফোলজিস্টদের বোলবোলা— এই সবই লেখকের বিশ্লেষণের বিষয়। পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রন্থের নাতিদীর্ঘ মুখবন্ধে লেখাগুলি সম্পর্কে বলেছেন, ‘সরস বাংলায় লেখা... রম্যরচনা’। নির্ভার গদ্যের মধ্যে চকিত বিস্ময় নিয়ে আসে সাহিত্যের মণিমাণিক্য। ক্লান্ত দিনশেষে জেলবন্দি প্রাক্তন রাজ্যপ্রধানের কথা ভেবে যখন স্বল্পশিক্ষিত মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর মন বিষণ্ণ হয়, লেখক জানান, “বন্দী যে তার প্রাণেশ্বর।”
সঙ্কলনের কয়েকটি প্রবন্ধ ফেলে আসা সেই পৃথিবীর চিত্রায়ণ, যার স্মৃতি আমাদের দেয় কিঞ্চিৎ বিষাদমাখা হাসি। স্মৃতিচারণধর্মী প্রবন্ধ ‘শীতকাল কবে আসবে আবার’ নিয়ে যায় মেদুর এক অতীতে, যেখানে নিম্নমধ্যবিত্তের সংসারে পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে লেপ সোয়েটার মাফলার চাদর শালের সঙ্গে বেরোত ‘শেয়ালরঙা আলোয়ান’। ‘রেল কাম ঝমাঝম’ দেয় এমন সময়ের স্বাদ যখন ইলেকট্রিক ট্রেনকে মনে হত ‘চলমান অশরীরীর থেকেও ক্ষিপ্র’। এই লেখাতেই রয়েছে কয়েক বছর পরে স্কলারশিপের ইন্টারভিউ দিতে দিল্লি যাওয়ার জন্য পূর্বা এক্সপ্রেসের টিকিট না পাওয়া লেখক কী ভাবে ‘বদ্যি’ কোটায় টিকিট পেয়েছিলেন, তার সরস বিবরণ।
অতীত লেখকের কলমে অনেক সময়ই বিষণ্ণতার টিপ পরে উপস্থিত হয়, কিন্তু তাঁর লেখাকে ‘সেন্টিমেন্টাল’ বলা চলে না। ‘দেশভাগ থেকে বাংলাদেশ’ প্রবন্ধে যিনি পূর্ববঙ্গ প্রসঙ্গে বালক বয়সের অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে বলেন, “দেশ আছে কোথাও একটা— অন্যের স্মৃতিআর নিজের কল্পনায় মাখামাখি হয়ে,” তিনিই আবার অনায়াসে বলেন, “যাঁরা... পূর্ববঙ্গের ছেড়ে আসা গ্রামকে আজকের বাংলাদেশের মধ্যে ফিরে পেতে চেষ্টা করেন, তাঁদের ইতিহাসের কৃষ্ণগহ্বরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।” একই নৈর্ব্যক্তিকতা লক্ষ করি ‘শতক শেষের বাঙালিয়ানা’ প্রবন্ধেও। ক্লিষ্ট বাঙালি যে ভাবে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের গৌরবে অবগাহন করার বাসনা নিয়ে তাঁর সাইকেল চালানো দেখতে শান্তিনিকেতন দৌড়ায়, তাকে জয়ন্ত তুলনা করেছেন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে পুরনো প্রাসাদের ছবি দেখার সঙ্গে। খেলা এবং ক্রীড়া সংস্কৃতি নিয়ে কয়েকটি লেখা রয়েছে এই সঙ্কলনে। সেগুলিও অনেকাংশে বাঙালি জীবন এবং সংস্কৃতির নির্মোহ ব্যবচ্ছেদ।যে ফুটবলপ্রেমী শিক্ষিত বাঙালি চুনী, পিকে, সুকুমার, সুরজিৎকে প্রায় দেবতার আসনে বসিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে ফুটবলের বিচ্ছেদ কী ভাবে তৈরি হল, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে লেখক ‘খেলার আড়ালে’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করেছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক উচ্চমন্যতা, তার চিরকালীন নায়কের সন্ধান ও অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস।
ইতিহাস ও সমসময়: সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি
জয়ন্ত সেনগুপ্ত
৪০০.০০
অনুষ্টুপ
বাঙালি জীবনচর্যার পাশাপাশি গ্রন্থে উপস্থিত তিতুমির, অবনীন্দ্রনাথ, নেতাজি সুভাষ এবং স্যর আশুতোষের মতো মহানায়কেরাও। ‘আশুবাবুর অবদান এবং তাঁর দোলাচল’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখক বাংলার বাঘের ডোরা-ডোরা দাগ চিহ্নিত করেছেন তাঁর নেতৃত্ব, সাহসিকতা ও ক্যারিশমার মধ্যে। ঔপনিবেশিক শাসনের সেই কালে যখন জাতীয়তাবাদের গ্রন্থিমূলে কুঠারাঘাত করার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার উপর শাসকের সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ, তখন তাদের সঙ্গে টক্কর দিতে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় পৃষ্ঠপোষকতা এবং অনুগ্রহের প্রতি-ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। নিয়ম এবং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকেও স্বাদেশিকতার এই ভিন্নতর ফর্মের বিকাশে আশুবাবুর ভূমিকা, লেখকের মতে তাঁর ব্যাঘ্রসম সাহসের পরিচায়ক। ‘নেতাজি ও তৎকালীন ব্রিটিশ রাজ’ শীর্ষক লেখাটিতে সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধানের পর সরকারি গোয়েন্দারা কী ভাবে অক্লান্ত পরিশ্রমে গোপনে পড়ে চলেছেন এবং কর্তাদের জন্য অনুবাদ করে দিচ্ছেন সাধারণ মানুষের হাজার হাজার চিঠি, সারসংক্ষেপ করে দিচ্ছেন বামপন্থী ও বিপ্লবী রচনা, সেই প্রসঙ্গে লেখক উত্থাপন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সাম্রাজ্যবাদী সরকারের বেতনভুক ভারতীয় পুলিশের উপর কি কোনও প্রভাব ফেলেনি এই সব বিপ্লবী রচনা? না কি এই ভাবেই অজানতে শিথিল হয়ে যাচ্ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের লৌহশৃঙ্খল? এই সঙ্কলনের আরও অনেক লেখার মতোই এই লেখাও এক প্রশিক্ষিত ইতিহাসবিদের কৃৎকৌশলের উদাহরণ, যার বলে তিনি মহাফেজখানার আগল খুলে ইতিহাসকে সাধারণ পাঠকের ধরাছোঁয়ার মধ্যে এনে দেন।
লেখকের কলমে বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতি তার অনেক বৈপরীত্য নিয়ে হাজির হলেও একটি সংশয় রয়ে যায়। বাঙালি সংস্কৃতি তো কোনও অখণ্ড বা অভিন্ন সংস্কৃতি নয়। এ সমাজ যেমন বহু ভাগে বিভক্ত, এ সংস্কৃতিও তেমনই বহু রঙে রাঙানো। কিন্তু বাঙালির জাতীয় চরিত্রের সচেতন নির্মাণে প্রধান ভূমিকা নিয়েছেন হিন্দু উচ্চবর্ণের ভদ্রলোক। ভাবমূর্তি এবং তার নির্মাণ— এই গোষ্ঠীর মধ্যেই চক্রাকারে ঘুরেছে। বাদ পড়েছেন নিম্নজাতি ও নিম্নবর্গের মানুষ, প্রান্তিক রয়ে গেছেন বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়। সুমিত সরকার এই প্রসঙ্গে খানিক আক্ষেপ মিশিয়ে বলেছেন, “উনিশ শতক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত, ‘বাঙালি’ কথাটির শব্দার্থ খুব বেশি প্রসারিত হতে পারেনি।” আলোচ্য গ্রন্থটিতেও বাঙালি মুসলমান মানুষজনের যাপনচিত্র প্রায় অনুপস্থিত। পাঠককে তা কিছুটা আশাহত করে বইকি।
বেশ কয়েকটি গ্রন্থের আলোচনা রয়েছে এই সঙ্কলনে। ইতিহাসবিদ জয়ন্ত সেনগুপ্তের দেখা মেলে এই আলোচনাগুলিতেও। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দীপেশ চক্রবর্তী, গৌতম ভদ্র, অশোক সেন, শাহিদ আমিন, সুরঞ্জন দাসের মতো প্রথিতযশা ইতিহাসবিদদের বইয়ের লেখক-কৃত এই আলোচনাগুলি ‘গ্রন্থ-সমালোচনা’র সীমিত পরিসরে আটকে না থেকে ইতিহাসের চলন এবং বিভিন্ন পর্বে নেওয়া বাঁকসমূহের বিশ্লেষণী পর্যালোচনা হয়ে উঠেছে। পণ্যসংস্কৃতির বিপুল বিস্তার, রাষ্ট্রায়ত্ত জাতীয়তাবাদের সর্বগ্রাসী আগ্রাসন, গণতন্ত্রের অসম বিকাশ— এগুলির ঐতিহাসিক প্রবণতাকে চিহ্নিত করা এবং প্রশ্ন করা যে ইতিহাসবিদের দায়, তা এই পুস্তক-আলোচনাগুলিতে স্পষ্ট। ইতিহাসচর্চার আপাত-নির্দোষ কর্মকাণ্ডের আড়ালে অতীতের দখল নেওয়ার জন্য ক্ষমতার লড়াই সম্পর্কেও সতর্কবার্তা রয়েছে এই লেখাগুলিতে।
শিল্পকলা বিষয়ক প্রবন্ধগুলিতে ইতিহাসবিদ, শিল্পবোদ্ধার পাশাপাশি প্রশাসক জয়ন্ত সেনগুপ্তের উপস্থিতি নজরে পড়ে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, লেখক ২০১৩ সাল থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এর নির্দেশকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সঙ্কলনের শেষ প্রবন্ধ ‘তবু পরী ঘোরে ভিক্টোরিয়ায়’ প্রশাসক জয়ন্ত সেনগুপ্তের অভিজ্ঞতাপ্রসূত। এই লেখায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কৌতুকরসে জারিত হয়, ছুঁয়ে যায় বাঙালি প্রেমজীবনের সাংস্কৃতিক দ্যোতনা, এবং পাঠককে দেয় এক অতীব জরুরি নির্জনতা, ভিক্টোরিয়ার বাগানের সবুজের মতোই। গোটা বইটিই তত্ত্ব, তথ্য ও বিশ্লেষণের পাশাপাশি আমাদের দেয় সেই জরুরি নির্জনতা, যেখান থেকে দেখা যায় সিপিয়া টোনের এক পৃথিবী— যার জন্য এখনও রয়ে গেছে আমাদের অফুরন্ত মায়া।
গুরুত্বপূর্ণ এই বইটির সম্পাদনা ও গ্রন্থনা আরও কিছুটা যত্ন দাবি করে। সঙ্কলনের প্রবন্ধগুলি বিষয়ানুসারে বা প্রকাশের কালানুসারে বিন্যস্ত হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম প্রকাশের তারিখ এবং সূত্রও অনুপস্থিত। মুদ্রণপ্রমাদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। পুস্তক-আলোচনায় কিছু ক্ষেত্রে গ্রন্থের পরিচয় দেওয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রে তার অনুপস্থিতি পাঠককে সমস্যায় ফেলে। সার্বিক প্রাপ্তির তুলনায় অবশ্য ত্রুটিগুলিকে নগণ্য বলা যেতে পারে।