নন্দিত: নোবেল মঞ্চে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, ১৯৮২।
একটা বই বেরোবে বলে সারা পৃথিবী অপেক্ষা করে আছে, এমন ব্যাপার ক্রমে কমে আসছে পৃথিবীতে। তেমন লেখকেরা হয় প্রয়াত, অবসৃত বা আক্রান্ত। কিংবা তাঁদের সৃষ্ট চরিত্রদের ছাড়িয়ে চলে এসেছে এই বিশ্ব, হ্যারি পটারকেও এক সময় জাদুর ছড়ি মুছেটুছে তুলে রাখতে হয়। লেখকের ‘ইমেজ’টাও একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়: মিলান কুন্দেরা বা হারুকি মুরাকামির নতুন বই প্রায় নিঃশব্দেই বাজারে এসেছে সব। কিন্তু গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বা সলমন রুশদির নামেই যে অভাবনীয় হইচই পড়ে যায় তার জুড়ি মেলা ভার। এ বছরটা হইচই করারই বছর, দু’জনেরই বই বেরিয়েছে।
গার্সিয়া মার্কেসের এই বই, আনটিল অগস্ট নিয়ে উত্তেজনার পারা চড়বার কারণও আছে। একে তো এত বড় লেখকের মৃত্যুর দশ বছর বাদে একটা বই বেরোচ্ছে, তায় ‘ফিকশন’, এ-ই যথেষ্ট। প্রকৃত গার্সিয়া মার্কেস-ভক্তেরা সব খবরও রাখেন: এই বইয়ের খসড়া তো আজকের নয়, সেই নব্বই দশকের শেষেই তার হদিস পাওয়া গেছে, লেখক স্বয়ং খসড়ার খণ্ডাংশ পড়েছেন কোনও অনুষ্ঠানে, কিছুটা অংশ ছাপা হয়েছে বিদেশের কাগজে, এই সবই তাঁদের জানা। এখন প্রকাশের পরে জানা যাচ্ছে আরও তথ্য: গার্সিয়া মার্কেস পাঁচখানা খসড়া করেছিলেন এই বইয়ের, মেমরিজ় অব মাই মেলানকোলি হোরস নামে তাঁর আগের নভেলার খসড়া (সেখানে যদিও অন্য নামে) আর এই বইয়েরও, দুটোই তাঁর ঘরে রাখা ছিল একই ফোল্ডারে। মেমরিজ়... তো বেরিয়ে গিয়েছে ২০০৪-০৫’এ, এই বইটা থেকে যায় ফাইলবন্দি।
কেন? পাঁচখানা খসড়া তৈরির পরেও খোদ লেখকের মনে ধরেনি নিজের লেখা। ঘনিষ্ঠ মহলে বলে দিয়েছিলেন, এ বইটা কিচ্ছু দাঁড়াচ্ছে না, এ লেখা নষ্ট করে ফেলতে (“দিস বুক ডাজ়ন’ট ওয়ার্ক। ইট মাস্ট বি ডেস্ট্রয়েড”)। ও-দিকে তখন স্মৃতি মুছে যাওয়ার রোগ একটু একটু করে ঘিরে ধরছিল লেখককে। গার্সিয়া মার্কেসের জীবনকালে আর বইটা বেরোয়নি, বেরোল এত কাল পরে, ওঁর দুই ছেলের ইচ্ছায়, অনুবাদক-সম্পাদক-প্রকাশকের উদ্যোগে। লেখকই যখন চাননি বইটা বেরোক, তার পরেও কেন? নক্ষত্রের পুত্রকন্যারা নক্ষত্র নির্বাপিত হলেও তার আলো ফুরোতে দিতে চান না, সেই কারণেই কি? কলমের নাম যখন গার্সিয়া মার্কেস, পাঠকেরা পড়তে চাইবেনই তাঁর দেরাজবন্দি যা-কিছু লেখা, হোক তা খসড়া বা খণ্ডিত। এই বইয়ের শুরুতে গার্সিয়া মার্কেসের দুই ছেলে এই বই প্রকাশকে ‘অ্যাক্ট অব বিট্রেয়াল’ বলে স্বীকার করেও এই সাফাই-ই গেয়েছেন: তাঁদের মনে হয়েছে পাঠকের আনন্দকে রাখা দরকার সব কিছুর আগে, এমনকি লেখকের নিজের ইচ্ছেরও আগে! পাঠক আনন্দ পেলে তাঁরা মনে করবেন তাঁদের বাবা, প্রিয় ‘গাবো’ ক্ষমা করে দেবেন ওঁদের। দুনিয়া জুড়ে বইয়ের বিপুল বিক্রিবাটা সূত্রে অর্থকরী লাভের ব্যাপারস্যাপার নিয়ে অবশ্য কিছু বলেননি ওঁরা। কে না জানে, অচিরেই ওটিটি-তে আসছে ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড থেকে তৈরি ওয়েব সিরিজ়, যে বই থেকে ছবি বা এই জাতীয় কিছু তৈরির অনুমতি গার্সিয়া মার্কেস ঠেকিয়ে রেখেছিলেন আজীবন! সে-ও তো হল।
আনটিল অগস্ট: দ্য লস্ট নভেলগ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস,
অনুবাদ: অ্যান ম্যাকলিন
৭৯৯.০০
ভাইকিং (পেঙ্গুইন)
বইয়ে ফেরা যাক। একশোর একটু বেশি পৃষ্ঠার মূল কাহিনি (সেই অর্থে নভেলাও বলা যায় না একে), পড়তে সময় লাগে না। মূল চরিত্রটি— বছর ছেচল্লিশের এক মহিলা, আনা মাগদালেনা বাখ। ফি-বছর অগস্টের একটি দিনে ফেরিতে চড়ে তিনি যান এক ক্যারিবিয়ান দ্বীপে, সেখানে এক সমাধিস্থলে আছে তাঁর মায়ের সমাধি। হোটেলে একটা রুম নেওয়া, একটু গুছিয়ে বেরোনো, ফুলের দোকান থেকে একগুচ্ছ গ্ল্যাডিওলি কিনে মায়ের সমাধিতে রাখা, হোটেলে ফিরে রেস্তরাঁ-বারে বসে ডিনার আর প্রিয় পানীয়ে চুমুক, একটা দিন কেটে যায় এ সবেই। রাতে ঘুম, সকালে উঠে আবার ফেরি চড়ে শহরে, স্বামী আর দুই ছেলেমেয়ের সংসারে ফেরা। সেখানে অর্কেস্ট্রা কনডাক্টর স্বামীর সঙ্গে অভ্যস্ত দাম্পত্য আছে (বরং মধ্যবয়সের তুলনায় একটু বেশিই বৈচিত্র সেখানে, যেমন শাওয়ারে এক সঙ্গে স্নান, রুটিনমাফিক কিন্তু উত্তেজনাময় যৌনতা), সদ্যতরুণী কন্যার কনভেন্টে সন্ন্যাসিনী হিসেবে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তে উৎকণ্ঠা আছে।
তবু আনার জীবনটা বদলে দেয় বাড়ি থেকে দূরের হোটেলে একটা অগস্টের রাত। সে কি হঠাৎ-পাওয়া নিষিদ্ধ আনন্দের জন্য, অচেনা পুরুষসঙ্গের শিহরনের জন্যই শুধু? আমরা আনাকে দেখতে পাই পর পর চার বছরের ‘অভিযান’-এ, অভিসার বললেও ভুল হয় না। লেখক আমাদেরও সঙ্গী করে নেন আনার তাৎক্ষণিক আবিষ্কারের রহস্য-রোমাঞ্চে— এ বছর কাকে খুঁজে নেবে আনা হোটেলের বারে? প্রথম বছরে মনে হচ্ছিল এ যেন একটা দুর্ঘটনা, একটা দুঃস্বপ্নের মতো অনুভূতি (প্রথম পুরুষটি ভোরে উঠে চলে যাওয়ার পরে আনা আবিষ্কার করেন, টেবিলে সে হতচ্ছাড়া রেখে গিয়েছে একটা কুড়ি ডলারের নোট, এত আস্পর্ধা!), দ্বিতীয় বছরে মনের ভিতরে পুষে রাখা অসহ্য রাগ বদলে যায় বিছানায় পুরুষটির প্রতি প্রতিস্পর্ধী প্যাশনে, তার পরের বছর একেবারে থালায় বেড়ে দেওয়া সুযোগ সত্ত্বেও স্রেফ উল্টো দিকের মানুষটির প্রতি বিরক্তিতে ঘেঁটে যায় সব, তারও পরের বছর আবার জীবন ঘটিয়ে দেয় চূড়ান্ত অভাবনীয়কে।
তা বলে যদি ভেবে নেন এ স্রেফ পরকীয়া-কলা উন্মোচনের আখ্যান, নিতান্ত ভুল হবে। আনটিল অগস্ট আসলে এমন একটা প্রেমের গল্প, যে প্রেম জীবনভর এক অসমাপিকা ক্রিয়া হয়ে থেকে যায়। বা, প্রেমটাও উপলক্ষ মাত্র, আসল কথা অপেক্ষা। এই অপেক্ষা কি প্রেমের জন্য? এমন এক জনের জন্য যে আমাকে পূর্ণ করবে বলে আমরা মনে করছি? না কি অপেক্ষা করতে করতে কখনও শরীরের খেলায় মেতে উঠে, কখনও রাগ হতাশা ক্লান্তি ঘেন্নায় ভরে গিয়ে আমরা বেআব্রু করছি নিজেদেরকেই? নিজেকে নগ্ন দেখা অসহ্য, তার আগে ঘর অন্ধকার করতে হয়।
প্রেম, অপেক্ষা, যৌনতা, স্মৃতি— গার্সিয়া মার্কেস তাঁর প্রায় প্রতিটি বইয়ে যা-যা নিয়ে লোফালুফি করেন অনায়াসে, সব কিছুই আছে এই বইয়ে। তবু তার সঙ্গে ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড, লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা-র তুলনা টানা চলে না। আনটিল অগস্ট-এর লেখক গোড়া থেকেই জানেন যে তাঁর আখ্যানের মধ্যে একটা পুনরাবৃত্তির ফাঁদ পাতা আছে। তাই আনার প্রতিটি বছরের প্রতিটি অভিসার যেখানে লেখা যেতে পারত পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসসুলভ অনুপুঙ্খে, সেই প্রলোভন এড়িয়ে তিনি এগিয়ে যান, এবং পাঠককেও এগিয়ে নিয়ে যান উল্কাগতিতে। লেখক নামধারী পৃথিবীর আর যে কেউ যেখানে রতিক্রিয়ার বয়ানে পাঠককে বাঁধতে চাইবেন, সেখানে মাত্র কয়েকটা লাইনের আঁচড়ে পাঠককে একটু চিমটি কেটে এই গার্সিয়া মার্কেস চলে যান পরের কথায়: এত নির্মম, উদাসীন, পরিণত তিনি। কে বলবে, স্মৃতি আর প্রিয় কলমও একটু একটু করে ছেড়ে যাচ্ছিল তাঁকে এই সময়!
গার্সিয়া মার্কেস পড়ার সময় আমরা খেয়াল রাখি না যে তিনি ইংরেজিতে লেখেন না। ঠিক সেই কারণেই তাঁর অনুবাদকদের ঠাঁই দেওয়া দরকার সাহিত্যের ‘হল অব ফেম’-এ। কে ভুলতে পারে গ্রেগরি রাবাসা-কে, যাঁর ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড-এর ইংরেজি অনুবাদকে খোদ লেখক বলেছিলেন মূলের স্প্যানিশের থেকেও সুন্দর! রাবাসা প্রয়াত হয়েছেন গত ২০১৬-তে— গার্সিয়া মার্কেস অনুবাদের গুরুভারটি এ বার অ্যান ম্যাকলিনের কাঁধে, এর আগেই ২০১৯-এ যিনি অনুবাদ করেছেন গার্সিয়া মার্কেসের সাংবাদিক-জীবনের লেখালিখি-সমৃদ্ধ বই দ্য স্ক্যান্ডাল অব দ্য সেঞ্চুরি অ্যান্ড আদার রাইটিংস। একটু বুড়িয়ে যাওয়া কলমেও যে হঠাৎ আলোর ঝলকানি, অ্যান তা ধরেছেন তুখোড় ইংরেজিতে। কেমন করে অনুবাদে ধরে রাখতে হয় শিশুর মতো সরল কিন্তু সন্তের মতো গম্ভীর এক লেখককে, শুধু সেটুকু শিখতেই পড়া যায় এ বই।
শিশির রায়