অগ্রণী: নারীশিক্ষা ও স্বরোজগারের কর্মক্ষেত্র তৈরী করেন অবলা বসু।
অবলার সঙ্গে বিয়ের পর জগদীশচন্দ্র বসু বাড়ি ভাড়া নিলেন চন্দননগরে। সেখান থেকে নৌকায় নদী পেরিয়ে নৈহাটি এসে ট্রেন ধরতে হত। তাই তাঁরা কিনলেন একটা ‘জলি বোট’। স্বামীকে ও-পারে নামিয়ে দিয়ে অবলা একাই নৌকা বেয়ে ফিরে আসতেন। বিকেলে আবার বোট নিয়ে যেতেন ও-পারে। জগদীশচন্দ্র মশলাপাতি নানা কৌটোয় ভরে লেবেল সেঁটে রাখতেন, ‘হলুদ,’ ‘জিরে’ ইত্যাদি। নববধূ সবে পড়াশোনা সেরে সংসারে ঢুকেছে, হেঁশেল সামলাতে অপটু।
নবজাগরণের বাংলায় দুই উচ্চশিক্ষিত, বিজ্ঞানমনস্ক যুবক-যুবতীর এমন যৌথজীবন হতে পারত আধুনিক দাম্পত্যের সূচনা। যেখানে দু’জনেরই রয়েছে কর্মক্ষেত্র, দু’জনেরই রয়েছে সংসার। ঠিক তেমনটি হল না। বিয়ের বারো বছর পর রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে (২৫ এপ্রিল, ১৮৯৯) অবলা বলছেন, ইংরেজি ‘মিসেস’-এর পরিবর্তে বাংলায় একটা নতুন কথা প্রয়োজন। “আপাততঃ গৃহলক্ষ্মী বলিতে পরেন... সহধর্ম্মিণী একান্ত সেকালের। আধুনিকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিমণ্ডিতা হইলে গৃহসরস্বতী লিখিতে বলিতাম।”
অবলা বেথুন কলেজ থেকে বিএ পাশ করে প্রথম শ্রেণির ছাত্রবৃত্তি নিয়ে ভর্তি হন মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজে (১৮৮২)। একা এক অচেনা শহরে থেকে চার বছর পরে ফার্স্ট এলএমএস পরীক্ষা পাশ করেন, অসুস্থতার জন্য দ্বিতীয় এলএমএস পরীক্ষা না দিয়ে ফিরে আসেন কলকাতায়। তা সত্ত্বেও সামগ্রিক ফলের ভিত্তিতে অবলাকে সাম্মানিক এলএমএস ডিগ্রি দিয়েছিল তাঁর প্রতিষ্ঠান (১৯৮৮)। এমন মেয়েকে কী করে সেকেলে ‘গৃহলক্ষ্মী’-র ছাঁচে ফেলা যায়?
বিয়ের পর আট-ন’বছর এক বৃহৎ যৌথ পরিবারে গৃহিণীপনা করতে করতে অবলারও আত্মবিশ্বাস যেন ক্ষয়ে এসেছিল। “আমি যখন আচার্য্যের সহিত ইংলণ্ডে যাই, তখন জড়পিণ্ডবৎ ছিলাম... একটি কথাও বলিতে পারিতাম না,” লিখছেন অবলা (১৮৯৬)। এর পর থেকে অবশ্য স্বদেশ-বিদেশে যে কোনও সফরে স্বামীর সঙ্গী হতেন অবলা, কারণ আত্মভোলা অধ্যাপক স্ত্রীর উপর নিজের আহার, পোশাক, সব বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিলেন। আর অবলা গৃহিণী, সখা, সচিব হয়ে আগলে রেখেছিলেন জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞানসাধনাকে। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য অবলা কী বিপুল, বিচিত্র কর্তব্যভার কেমন প্রশান্ত ভাবে বহন করতেন, তার সাক্ষ্য মেলে সহকর্মী, ছাত্রছাত্রীদের স্মৃতিকথায়।
অবলা বসু ও সেই সময়
দময়ন্তী দাশগুপ্ত
১২০০.০০
সিগনেট প্রেস
পরিণত বয়সে অবলা যখন নারীশিক্ষা ও স্বরোজগারের বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন, তখন কি জগদীশচন্দ্র তাঁর পাশে ছিলেন? অবলা-প্রতিষ্ঠিত ‘নারীশিক্ষা নিকেতন’-এর অধীনে চলত বিধবাশ্রম, হাতের কাজের প্রশিক্ষণ, সমবায়ের মাধ্যমে সে সব পণ্যের বিপণন, গ্রামে মেয়েদের স্কুল স্থাপন। মেয়েদের ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলনেও অবলা ছিলেন অগ্রণী। এ সব কাজ অবলাকে করতে হত দুপুরে, স্বামীর বিশ্রামের অবসরে। মনে হয় খানিক অভিমান করেই দময়ন্তী দাশগুপ্ত অবলার জীবনচরিত উৎসর্গ করেছেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে, যিনি নিজের চিকিৎসক স্ত্রী কাদম্বিনীর সর্বপ্রধান সহায় ছিলেন।
দময়ন্তী দাশগুপ্ত যে নারীবাদের তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে অবলা বসুর জীবন ও কাজকে আলোচনা করেছেন, এমন নয়। তিনি সাংবাদিক, তাঁর এই কাজকে বলা চলে ইতিহাসের এক নিবিড় অনুসন্ধান। তবু প্রচলিত কথাবার্তায় যা আড়ালে থেকে যায়, তার উপর আলো পড়লে ভিন্ন নকশা চোখে পড়ে। চেনা লোক, জানা কথাগুলো নতুন করে ভাবতে হয়। চিন্তায় এমন নাড়াচাড়া ফেলে দেওয়া— এও নারীবাদের বৈশিষ্ট্য।
অবলাকে জানা-বোঝায় একটা ফাঁক রয়েই গিয়েছে— অবলা যে ডায়েরি লিখতেন সে কথা পাওয়া যায়, কিন্তু ডায়েরিগুলি পাওয়া যায়নি। ফলে অবলার মানসলোকের নাগাল পাওয়া যায় না। তাঁর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ক্ষোভ-উদ্বেগ, মনের উপর জীবনের নানা ঘটনার অভিঘাত, কিছু জানা যায় না। লেখক এই ফাঁক ভরাতে চেয়েছেন প্রধানত দু’ভাবে— অবলার চার পাশের মানুষগুলির প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তুলে, এবং অবলার সম্পর্কে তাঁর পরিচিতদের পর্যবেক্ষণ, তাঁদের লেখা চিঠিপত্র তুলে ধরে। সেই সব উপাদান দিয়েই অবলার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের, নিবেদিতার সম্পর্ক সূক্ষ্ম আঁচড়ে এঁকেছেন দময়ন্তী।
অবলার পারিবারিক পরিমণ্ডলের বিশদ তথ্য থেকেও নানা সম্ভাবনাপূর্ণ ইঙ্গিত দিয়ে যায়। যেমন, নারীশিক্ষার প্রচারে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, দুর্গামোহন দাস প্রমুখ যে অগ্রণী ছিলেন, তা যথেষ্ট প্রচারিত। এই বইটি পড়ে আন্দাজ হয়, দুর্গামোহনের অকালপ্রয়াতা স্ত্রী ব্রহ্মময়ীর প্রভাবও কম ছিল না। এই ব্যক্তিত্বময়ী, স্নেহশীল মহিলা বিধবা এবং অন্যান্য বিপন্ন মেয়েদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতেন, তাদের শিক্ষা ও বিবাহের ব্যবস্থা করতেন। তাঁর বড় মেয়ে সরলা রায় (গোখলে মেমোরিয়াল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা) এবং মেজো মেয়ে অবলা, দু’জনেই নিজেদের পরিচালিত স্কুলের সঙ্গে রেখেছিলেন হস্টেল। ছাত্রীদের প্রতি তাঁদের স্নেহসিক্ত ব্যবহারের কথা মেলে প্রাক্তনীদের বয়ানে।
অবলার বিধবাশ্রমে স্থান পেত স্বামী-পরিত্যক্তারাও, নানা প্রশিক্ষণও পেত। ‘সেকেলে গৃহলক্ষ্মী’ অবলা একষট্টি বছর বয়সে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমার মনে হয় সব মেয়েদের আর্থিক স্বাধীনতা থাকা দরকার। তা নইলে আমরা আত্মসম্মান-ভ্রষ্ট হব।”