book review

সময়ের গায়ে ফুটে ওঠা ভাঙনচিহ্ন

‘সর্পহার’ উপন্যাসটির আখ্যান বাঁকুড়ার পুরুষোত্তমপুরকে কেন্দ্র করে। অতীতের জমিদার পরিবারের বৌ সুলতা ও পার্টি নেতা বঙ্কিম তুঙ্‌য়ের বয়ানে উপন্যাসের চলন।

Advertisement

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২২ ১০:০৫
Share:

প্রতীকী ছবি।

“এবারকার গল্প বানাতে হবে এ-যুগের কারখানা-ঘরে।” চোখের বালি-র সূচনায় বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই বইয়ের চারটি উপন্যাস পড়তে গিয়েও এ কথা বলে চলে, ‘যুগের কারখানা-ঘর’ থেকেই এর সৃষ্টি। সময়, তার গায়ে লেপ্টে থাকা সামাজিক, ব্যক্তিগত ও চিন্তন জগতের ক্ষত আর ভাঙনের গল্প নিয়েই লেখকের ‘সর্পহার’, ‘শিকড়ের ঘ্রাণ’, ‘ফ্যাসিস্ট’ ও ‘আরশিচরিত’— এক মলাটে মুষলপর্ব। সময়ের বৃত্তে ঘুরে-ঘুরে আসে রাজ্যে কংগ্রেস আমলের বাম রাজনীতি, যুক্তফ্রন্ট, বামফ্রন্টের ক্ষমতায় আসা ও সেই ক্ষমতা গেড়ে বসার পরে কিছু বিচ্যুতির প্রসঙ্গ, অনেক খুঁটিনাটি।

Advertisement

‘সর্পহার’ উপন্যাসটির আখ্যান বাঁকুড়ার পুরুষোত্তমপুরকে কেন্দ্র করে। অতীতের জমিদার পরিবারের বৌ সুলতা ও পার্টি নেতা বঙ্কিম তুঙ্‌য়ের বয়ানে উপন্যাসের চলন। সুলতা ও তাঁর মেয়েদের চাহিদা, বাঁচা-মরা আবর্তিত হয় বঙ্কিমকে কেন্দ্র করে, সুলতার শ্বশুরের অবৈধ সন্তান বঙ্কিম চায় জমিদারবাড়িতে তার বীজ বপন করতে। এক দিকে এই আকাঙ্ক্ষা, সুলতার টিকে থাকার প্রসঙ্গ আর তার সঙ্গে অপারেশন বর্গার ‘সুফল-কুফল’, যুক্তফ্রন্টের ক্ষমতায় আসা, সব নিয়েই এগিয়ে যায় উপন্যাস। আঞ্চলিকতা যোগ করতে লেখক ‘ড্যানক্’, ‘মদ্‌না’, ‘মাক্স সাহেব’, ‘হইয়েঁ’ প্রভৃতি শব্দ এবং ‘শয়তানকে উঁচু পিঁড়ি’র মতো প্রবাদকথন ব্যবহার করেছেন। তবে আখ্যানে কিছু বর্ণনায় পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।

মুষলপর্ব

Advertisement

ভগীরথ মিশ্র

৪৫০.০০

দে’জ পাবলিশিং

‘শিকড়ের ঘ্রাণ’ উপন্যাসটিকে ব্যক্তি-মানুষের আত্ম-আবিষ্কারের সূত্রে পড়া সম্ভব। ও-পার বাংলা থেকে এই পারে চলে আসা মানুষের জীবনসংগ্রাম, কলোনি তৈরি ইত্যাদি বাংলা উপন্যাসে কম নেই— মেঘে ঢাকা তারা, বদ্বীপ যেমন। এই উপন্যাসের কেন্দ্রে সূর্য সেন কলোনি। চরিত্রের ‘ডিটেলিং‌’— রুস্তমদের সিনে-পর্দার নায়িকার দেহবল্লরি বর্ণনা বা অধ্যাপক অনিমেষের রবীন্দ্রনাথ আওড়ানো, সিগারেট খাওয়া থেকে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরে পার্টির ‘স্ফিতি’র জন্য করা কর্মকাণ্ড, সবেতেই প্রস্ফুট তা। ‘কাছে তবু দূরে’ থেকেএ সব দেখতে দেখতে উপন্যাসের কথক শুখা হয়ে ওঠে শুকদেব। ফুটে ওঠে বাম-রাজনীতির উত্থান-পতন ও দ্বন্দ্ব।

এই দ্বন্দ্বই প্রকীর্ণ ‘ফ্যাসিস্ট’-এও। উমবের্তো একো বলেছিলেন, “ফ্যাসিজ়ম আদতে স্ববিরোধের কারখানা।” এখানে ‘স্ব’ শব্দটিকে ‘আপন’, এই বিস্তার-অর্থে পড়া যায়। উপন্যাসটিতে মা অর্থাৎ নূপুর চরিত্রটিতে স্ব-সত্তা এবং আপন-সত্তা হিসেবে তার ছেলে যেন দুই বিপ্রতীপ অবস্থানে দাঁড়িয়ে। সেই অবস্থানসূত্রেই উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় সুর ‘স্ব-বিরোধ’টিকে দেখা যায়। উপন্যাসের নির্মাণ মাকে লেখা ছেলের চিঠি হিসেবে। সেখানে মা-ছেলের আদর্শগত সংঘাত সুজনবান্ধব, শান্তনু, হাসি প্রভৃতি চরিত্রের আড়ালে পরিস্ফুট হয়, আর তা পরিবার, সমাজ, ব্যক্তি সম্পর্কে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটির প্রয়োগকে কেন্দ্র করে। বাম আমলের শেষ দিকে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রসঙ্গও উঠে আসে। শেষে, ছেলের মায়ের প্রতি অমোঘ প্রশ্ন, “সত্যি করে বলতো মা... কে বেশি ফ্যাসিস্ট? তুমি না ওরা?”

‘আরশিচরিত’-এর বয়নকৌশলে আসলে দু’টি উপন্যাস যেন এক সঙ্গে লেখেন লেখক। একটি, ‘বাস্তবে’ চন্দন, অর্ক, রনি, নীলা, সুদীপাদের নিয়ে, অন্যটি চন্দনের লেখা ‘অভিমন্যু ও ওরা সাত জন’— বাপ্পাদিত্য ও পারমিতা নামে দু’টি চরিত্রের আখ্যান। দুই ক্ষেত্রেই মূল সুরটি বাঁধা উদার-অর্থনীতির যুগে ব্যক্তি ও সমাজের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে। এ ভাবেই সমসময়কে নেড়েঘেঁটে দেখেন লেখক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement