পুস্তক পরিচয় ১

ছাঁচভাঙা অন্য জগতের কথা

প্রাচীন নাটকের মেয়ে চরিত্রদের মুখে তবু যদি বা কথা থাকত, সাধারণ সমাজে, মধ্যযুগ-পরবর্তী আধুনিক যুগের শুরুর দিকে, সে অংশের মুখে প্রায়শই ভাষা থাকত না।

Advertisement

যশোধরা রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

অন্দরমহল: সাংসারিক ব্যস্ততা। ১৯৬০-এর দশকে তোলা ছবি, গীতা চক্রবর্তীর সৌজন্যে

মেয়েদের স্মৃতিকথা/ আত্মঅন্বেষণ ও আত্মদর্শনের নানা পর্যায়

Advertisement

লেখক: সুতপা ভট্টাচার্য

২০০.০০

Advertisement

সিগনেট প্রেস

মেয়েদের আত্মকথায় কত ভাবেই না আলো এসে পড়তে থাকে এই সমাজের সেই অর্ধেক অংশের উপরে, যে অংশ বহু যুগ ধরে আটকে রয়েছে প্রাকৃত পালির মতো অ-সংস্কৃত পাঠে— শ্রমজীবী শূদ্রদের সঙ্গে সঙ্গেই। প্রাচীন নাটকের মেয়ে চরিত্রদের মুখে তবু যদি বা কথা থাকত, সাধারণ সমাজে, মধ্যযুগ-পরবর্তী আধুনিক যুগের শুরুর দিকে, সে অংশের মুখে প্রায়শই ভাষা থাকত না।

অথচ, মজার কথা এই-ই যে, বাংলা ভাষা এমনই এক ভাষা, যে ভাষার প্রথম আত্মজীবনীই এক নারীর লেখা— রাসসুন্দরী দেবীর আমার জীবন। এই আত্মজীবনীতে ১৮১০ সালে পুব বাংলার এক গ্রামে জন্ম নেওয়া মেয়ের কলম কাজ করে গিয়েছে যে ভাবে, পরবর্তী অনেকের গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছে তা। যেমন, তাকে যে ভাবে পাঠ বা টীকাটিপ্পনি করেছিলেন সে সময়ের শিক্ষিত সমাজের কর্তৃত্বময় পুরুষেরা, তাও একপেশে, এবং বিচারের বিষয়।

মেল গেজ নয়, ফিমেল গেজ, যার কথা ফিল্মতত্ত্বের নিরিখে প্রথম আনেন লরা মালভে, তা দিয়ে দেখলে পুরুষ আলোচকের দৃষ্টি থেকে অনেক সরে এসে দেখা যায় বেশ কিছু বিষয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গিকেই গত কয়েক দশক ধরে ক্রমাগত জোগান গিয়ে চলেছেন যিনি, মেয়েলি পাঠ-এর লেখক সেই সুতপা ভট্টাচার্যের বিশ্লেষণী কলম এ বার পড়ল মেয়েদের স্মৃতিকথার দিকে।

বিভিন্ন সময়ের মেয়েদের লেখা স্মৃতিকথা বা আত্মকথার মধ্যে একটা মিল হল, এই রচনা নিভৃতের। গৃহকর্ম শেষ করে, সংসারধর্মের কর্তব্যকর্ম করার পর, হয়তো মধ্যাহ্নের নীরব নির্জন ক্ষণে খাতা খুলে বসেছেন এর লেখকরা। এই তো মেয়েদের আত্মকথার পরিসর। তাঁদের শ্রোতা থাকে না, পাঠক থাকে না, কখনও বা কুণ্ঠায় তাঁরা নিজের এই লেখা অন্যকে দেখান না। বিছানার নিচে বা বালিশের তলে রাখা রুলটানা খাতার নিজস্ব জার্নি— একে যখন আমরা ছাপার অক্ষরে পড়তে পাই, অনেকখানিই দেখি অনুল্লেখের তলায় চাপা পড়ে থাকা কথাদের। নীরবতাগুলিই তখন অনেকটা বলে দেয়। বলা কথার থেকে না-বলা কথাই তখন সাক্ষ্য দেয় অনেকখানি।

১৩১ পাতার বইতে সুতপা ভট্টাচার্য লেখেন এই রকম বেশ কিছু বইতে মেয়েদের ‘আত্ম’কে অনুসন্ধানের বিভিন্ন ধাপগুলিকে নিয়ে। তাঁর বিশ্লেষণী কলমে কিছু পূর্বানুমান আছে নারীর সামাজিকীকরণ ও সামাজিক সত্যের। সেই কাঠামোর ভিতরে এই সব ক’টি মেয়েলি বাচন অদ্ভুত সামঞ্জস্যে এঁটে যায়। বহু পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যে ভাবে প্রমাণিত হয়ে ওঠে কোনও বৈজ্ঞানিক প্রকল্পনা, বহু পাঠের ভিতর দিয়ে সে ভাবেই নিজের ধারণাকে পাতিত করে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছন যায়— যে ভাবে পৌঁছন সুতপা ভট্টাচার্য।

‘‘যুগ যুগ ধরে মেয়েদের হয়ে ওঠা শুধু নির্দিষ্ট কিছু গুণাবলির শর্ত দিয়েই বেঁধে দিয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। ‘আমি কে’— এ প্রশ্ন মেয়েদের ক্ষেত্রে তাই ওঠেই না। ‘আমাকে কী হতে হবে’ এইটেই তার কাছে একমাত্র সত্য থাকা ভাল সমাজের পক্ষে।’’

আত্মজীবনীতে তাই, মেয়েরা সত্য আত্মপরিচয় দেবেন এটা আশাই করা যায় না। যে কোনও আত্মজীবনীতে বিষয়ী ও বিষয়ের দূরত্ব নিয়ে কূট প্রশ্ন এমনিতেই আছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়, মেয়েদের পরিস্থিতির চোরাটান।

লেখক দেখান, কী ভাবে মেয়েরা এই সব আত্মজীবনীতেই খুঁজেছেন তাঁদের ‘আত্ম’কে। তারপর সেই ‘আত্ম-সচেতন’ ব্যক্তিটি মুদ্রিত করেছেন তাঁর হয়ে ওঠা, বাঙালি মেয়ের শৈশবের দলিল যা। এখানে পরিপার্শ্বকে লিখে রাখার পাশাপাশি পাচ্ছি, আত্ম-অর্জন, আত্ম-নিয়োগ, আত্ম-সম্বন্ধ এবং আত্ম-সংগ্রামের কথা।

রাসসুন্দরীর উপমা-ব্যবহার বলে দিয়েছে কী ভাবে তিনি নীরবে প্রতিবাদী। বিবাহের কনের কান্নার সঙ্গে বলির পশুর মা-মা ডাকের মিল— অথবা পরিবারে আবদ্ধ বধূর ‘দায়মালী কারাগারে’ বন্দিত্বের উপমা। নটী বিনোদিনী নামে বিখ্যাত অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসী আমার কথা-য় নিজের অভিনয়জীবনের কথা লেখেন আত্মসচেতন ভঙ্গিতেই। আবার সাহানা দেবীর স্মৃতির খেয়া-য় নারীত্বকে ভেঙে দেন লেখক। স্টিরিয়োটাইপের ভিতরে থাকা মেয়েদের কথা এক ভাবে বাঙ্ময়, আবার স্টিরিয়োটাইপ ভাঙতে চাওয়া মেয়েদের কথা অন্য ভাবে উজ্জ্বল। ‘সংসারী মেয়েরাই মেয়েদের স্টিরিয়োটাইপ’, তাই বিনোদিনী যখন সংসারহীনতার, বা চোরাবালি-র কথা বলেন, অথবা সাহানা বলেন ‘সংসার করতে ভাল লাগত না’ তখন আমরা পাই ছাঁচভাঙা এক অন্য জগতের কথা।

অথবা মনীষা রায়ের ‘আমার চার বাড়ি’, এক অর্থে কোনও মেয়ের নিজস্ব বাড়ি খুঁজে পাওয়ার যাত্রা যেন। নিজস্ব ঘরের অন্বেষণ, যা ভার্জিনিয়া উল্‌ফের ‘রুম অব ওয়ান্স ওন’-কে মনে পড়ায়, তাকে নতুন করে চিনিয়েছেন এই প্রবাসী গবেষক-অধ্যাপক।

বেড়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে নিজেকে খোয়াতে খোয়াতে চলার, মেয়েত্বর লৌহমুখোশের তলায় নিজেকে হারিয়ে ফেলার কাহিনি লিখে রেখে গিয়েছেন সারদাসুন্দরী, মনোদা দেবী, প্রিয়বালা গুপ্তা, পূর্ণশশী দেবী, লীলা মজুমদার, সুদক্ষিণা সেন-রা। উপদেশ আর ঔচিত্যের তলায় হারিয়ে যাওয়া শৈশবের কথা খুঁজে পাব ঊনবিংশ শতকের মেয়েদের লেখায়, পাব মেয়েলি খেলা খেলতে বাধ্য হওয়া মেয়েদের পরবর্তী প্রজন্মের কথাও, যদিও শিক্ষায় আর বাধা ছিল না তখন। পাব হেমন্তবালা দেবীর ব্যতিক্রমী কণ্ঠ, স্বামীর বা পতিভক্তির আদর্শের সমালোচনামুখর। শান্তা দেবী, সীতা দেবী, শান্তিসুধা ঘোষেদের স্মৃতিকথা থেকেও তুলে আনা যায় সাহিত্য-স্বপ্ন-আত্মতা অর্জনের নিজস্ব ভ্রমণ পথগুলি। স্ত্রী, মা, বধূ, বোন, কন্যা— নানা সম্পর্কের ভিতরে বন্দিত্বের কথাটিও ভেঙে ভেঙে তুলে এনেছেন নারীর ব্যক্তিগত স্বর, যা অপ্রকাশ্য বাইরের ওই সব লেবেল লাগানো জীবনে। নানা স্তর থেকে মেয়েদের আত্মকথনে তিনি লক্ষ করেছেন স্বরের পরিবর্তন। বেবি হালদার, ছবি বসু, সুজাতা ঘোষের পাশাপাশি ১৮২৮ সালে জন্ম যাঁর, সেই কৈলাসবাসিনীর কথাও এসেছে। শেষ করেছেন সুনন্দা শিকদারের দয়াময়ীর কথা দিয়ে। আমরা লক্ষ করব, কী ভাবে অনুরূপা বিশ্বাসের সমাজ সেবামূলক কাজের মধ্যে আত্মতা অর্জনের কথা এসেছে: ‘আমার আমি জেগে উঠছে, বৌমা, মা, বৌদি— এসব সম্পর্কের বাঁধনে শুধু নয়, আমি এখন অনেকেরই অনুদি’।

এই সন্ধানের ভাগ নিতেই তো স্বাদু ও অত্যন্ত সুপাঠ্য গদ্যে রচিত এই বইয়ের পাঠ জরুরি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement