পৃথিবী আমারে চায়
সংকলক: পরিমল রায় ও কাজী অনির্বাণ
মূল্য: ৪০০০.০০
পরিবেশক: বিংশ শতাব্দী
তখনও তিনি উত্তমকুমার হননি। সন্ধেয় কলেজ, সারাটা দিন ছুটে বেড়ান। সকালে সাঁতার কেটে চলে গেলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিতে। দুপুরে কোনও রকমে খাওয়াটা সেরেই ঢুঁ মারতে বেরলেন কোনও স্টুডিয়োর দরজায়, কিংবা কোনও জলসার উদ্যোক্তার বাড়ি। যদি অভিনয়ের শিকে ছেঁড়ে ছবিতে, যদি গাইবার সুযোগ এসে যায় জলসায়।
কখনও কখনও ভাইয়ের মুখোমুখি পড়ে যেতেন, তরুণকুমার প্রশ্ন করলে প্রথমে বিষণ্ণ হাসি ছড়িয়ে পড়ত উত্তমের মুখে, বলতেন ‘জীবনে আমায় বড় হতেই হবে বুড়ো। তা সে অভিনয় করেই হোক। বা গান গেয়ে।’ তার পর অবশ্য আত্মপ্রত্যয় তাঁর স্বরে, ‘সুযোগ পেলে দেখিস বুড়ো, আমিও একদিন বড় অভিনেতা বা গায়ক হব। কারও মতো নয়। নিজের মতো।’
তরুণকুমারের এই স্মৃতির সঙ্গে কী আশ্চর্য মিল সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘নায়ক’-এর। সেখানে অরিন্দম তাঁর প্রথম ছবি ‘দেবী চৌধুরাণী’ রিলিজের ক’দিন আগে বন্ধু জ্যোতির সামনে উত্তেজিত হয়ে টেবিল চাপড়ে বলে উঠেছিল: ‘আই উইল গো টু দ্য টপ, দ্য টপ, দ্য টপ!’ অথচ তরুণকুমারের স্মৃতিগ্রন্থটির (আমার দাদা উত্তমকুমার) প্রকাশ ২০০০-এ, আর ‘নায়ক’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৬-তে।
উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর ২৬ জুলাই ১৯৮০ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় সত্যজিৎ লিখেছিলেন ‘নায়ক-এর গল্প আমি লিখি উত্তমকুমারের কথা ভেবেই। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের এক অভিনয় পাগল যুবক ছবিতে নেমে তরতরিয়ে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে।’ সত্যজিতের রচনাটির শিরোনাম ছিল ‘অস্তমিত নক্ষত্র’। তাঁকে নিয়ে ‘সানডে’-তেও লেখেন সত্যজিৎ, ৩ অগস্ট। সেই অস্তমিত নক্ষত্র, উত্তমকুমার, ১৯৫৪ থেকে ১৯৮০ অবধি বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশে কী ভাবে দীপ্যমান ছিলেন, সেই উজ্জ্বল ক্রমপরিক্রমার সচিত্র বিবরণই পৃথিবী আমারে চায়। ভরকেন্দ্রে সত্যজিতের রচনা দু’টি।
দ্য কালার্স অব আর্ট প্রকাশিত এই সুবিপুল বইটি রীতিমতো অভিনব। এতে হরেক রকমের দুর্লভ স্থিরচিত্র তো আছেই, আছে উত্তমের ব্যক্তি ও পরিবারজীবন, তারকাজীবন, তাঁর নায়িকারা, সহযোগী ও সহযাত্রী অভিনেতা-অভিনেত্রী, তাঁর কণ্ঠে যে শিল্পীরা গান গেয়েছেন এ রকম আরও অনেকের ছবি। কিন্তু সব ছাপিয়ে গিয়েছে উত্তম অভিনীত প্রায় সমস্ত ফিল্মের পোস্টার, লবিকার্ড, বুকলেট, বিজ্ঞাপনের সংকলন। পরিমল রায় আর কাজী অনির্বাণের হাতযশে তৈরি এ সংকলনে ১৯৫২-’৮২ পর্যন্ত বাংলা, আর ১৯৬৭-’৮২ পর্যন্ত হিন্দি ফিল্মের পোস্টার কালানুক্রমে সাজানো। একই ভাবে বিন্যস্ত লবিকার্ড, বুকলেট, এবং ফিল্ম রিলিজের দিনে প্রকাশিত খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন। উত্তম অভিনীত ফিল্মের গানের রেকর্ড কভার, সিনেমা পত্রিকার প্রচ্ছদ, ডাকটিকিট, আরও কত কী! তাঁকে ঘিরে পরিচালক প্রযোজক পরিবেশকরা সযত্নে যে তারকাপ্রথা বাঁচিেয় রাখতেন বাণিজ্য-বিপণনের স্বার্থে, তার হাতে-নগদ নমুনা।
স্বাধীনতার সত্তর বছরেও দূরদৃষ্টি আর সামাজিক চেতনার অভাবে আমরা বাংলা ফিল্মের রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমতো করে উঠতে পারিনি। অতীত মূল্যায়নের জন্যে যে ইতিহাসের নথি তৈরি করা দরকার তা বেমালুম ভুলে বসেছি। এখানে যে ভাবে উত্তমকুমারের বর্ণময় তারকাজীবনের চিত্র-সংরক্ষণ করা হয়েছে তা বাংলা ফিল্মচর্চাকে সাবালক করে তুলবে। প্রবেশক রচনাটি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের: ‘উত্তমদা দেখতে খুবই গ্ল্যামারাস ছিলেন।... উনি যেখানেই উপস্থিত থাকতেন, তাঁর গ্ল্যামার-এ সব কেমন ঝলমল করত।’
প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে উত্তমের জনপ্রিয় ছবিগুলির গায়ে বাঙালির জীবনযাপনের, সে সময়ের আবর্তের চেহারা-চিহ্ন কতটা ফুটে উঠেছে; আর উত্তমই বা কী ভাবে দুর্গাদাস বা প্রমথেশের মতো পূর্বসূরিদের সরিয়ে সেই সময় জুড়ে ধীরে-ধীরে মধ্যবিত্ত বাঙালির মলিন হতশ্রী সমাজে স্বপ্নপূরণের অবিসংবাদী আইকন হয়ে উঠেছিলেন, তার একটা হদিশ এনে দেবে এই ছবির বইটি— পাঠক, দর্শক, গবেষক, সকলের কাছেই।
শিলাদিত্য সেন
হারানো বইয়ের খোঁজে
লেখক: পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
মূল্য: ১৫০.০০
প্রকাশক: একুশ শতক
পড়ার বইয়ের বাইরে পড়ার সময় ছোটদের কমে গিয়েছে। কমে গিয়েছে বাংলা বই পড়ার অভ্যাসও। এক সময়ে ছোটদের জগৎ আলো করে থাকতেন যে সব লেখক তাঁরাও আজ স্মৃতির অতলে। সেই লেখকদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চান পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। নিজে শিশু সাহিত্যিক। বাংলার শিশু সাহিত্যের নানা হারানো সম্পদ খুঁজে বার করেছেন। তাঁর এই বইটি সেই ধারা বজায় রেখেছে। স্মৃতির অতল থেকে তুলে এনেছে হারিয়ে যাওয়া চল্লিশ জন শিশু সাহিত্যিকের একটি করে বইয়ের পরিচয়। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী থেকে যে সংকলনের যাত্রা শুরু হয়ে শেষ হয়েছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ে। প্রত্যেক লেখকের অধুনা দুষ্প্রাপ্য একটি করে বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন লেখক। টুকটুকে রামায়ণ, আইসক্রীম সন্দেশ, সাঁজের কথা-র মতো বইয়ের কথা সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন। রয়েছে গ্রন্থের অলংকরণও। সঙ্গে মিশে গিয়েছে লেখকের পরিচয়। দুইয়ে মিলে সহজ, সরল প্রা়ঞ্জল উপস্থাপনা। বইয়ের শেষে সংক্ষেপে লেখকদের পরিচয়ও রয়েছে। এই অংশে লেখকদের ছবিও থাকলে সর্বাঙ্গসুন্দর হত। শেষ একটি প্রশ্ন থেকে যায়, এই হারানো বইগুলি কি এখনকার প্রজন্মের জন্য ফিরিয়ে আনা যায় না?
ভাবনা জুড়ে চে/ মার্গারেট র্যান্ডাল
অনুবাদক: সলিল বিশ্বাস
মূল্য: ১৬০.০০
প্রকাশক: মনফকিরা
মার্গারেট র্যান্ডাল কবি, লেখক, ছবি তোলেন, সেই পঞ্চাশের দশক থেকে সমাজ বদলানোর লড়াইয়ে আছেন, সর্বোপরি নারীবাদী। কিউবা বিপ্লবের দ্বিতীয় দশকে বাস করেছেন ওই দেশে। চে গেভারা-র পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, সে অভিজ্ঞতা থেকেই চে-কে নিয়ে যে বইটি লিখেছেন, চে অন মাই মাইন্ড, তাতে কিন্তু নিছক বন্দনা নেই চে-র। তাঁর জীবন ও সংগ্রামকে যেমন আন্তরিক ভাবে বুঝতে চেষ্টা করেছেন মার্গারেট, তেমনই ভুলত্রুটি নিয়েও মুক্ত মনে আলোচনা করেছেন। তাই ভাষান্তর করেছেন সলিল বিশ্বাস, ভূমিকায় জানিয়েছেন ‘পড়েই আমার মনে হল, বইটি অন্য ধরনের হবে, প্রথাগত সন্ত-বন্দনা হবে না।... এমন অনেক বিষয় মার্গারেট তুলে এনেছেন, যেগুলো সাহস করে এখনও কেউ বলে না।’ এই বঙ্গদেশে চে-কে নিয়ে আবেগে ভরপুর বাঙালি, সেই সত্তর দশক থেকেই তিনি তরুণদের প্রেরণা, তাঁকে খুন করে তাঁর মরদেহ লুকিয়ে ফেলা সত্ত্বেও তাঁর স্বপ্ন আর আদর্শ আজও মুছে ফেলা যায়নি। যে যে ব্যাপারে দৃষ্টান্ত ছিলেন চে, সেগুলি থেকে একটির দৃষ্টান্ত তুলে এনেছেন মার্গারেট: ‘স্বাধীন ভাবে পড়াশোনা করা আর অনবরত প্রশ্ন করে যাওয়া।... তাঁর সর্বদা জিজ্ঞাসু মন, আজকের সামাজিক কর্মীদের পক্ষে অত্যন্ত মূল্যবান দৃষ্টান্ত।’