পুস্তক পরিচয় ১

তাঁর যা বলার, তিনি বলেন

সম্প্রতি নতুন বইয়ের প্রকাশ উপলক্ষে ভারতে এসে নানান মঞ্চে কথা বলতে গিয়ে রাজন জানিয়েছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পর্ব চুকিয়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়ে তিনি আনন্দে আছেন, কারণ ‘পেপার লেখা আর পড়ানো, এটাই আমি ভালবাসি।’

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

রঘুরাম জি রাজন।

আই ডু ওয়ট আই ডু

Advertisement

লেখক: রঘুরাম জি রাজন

৬৯৯.০০

Advertisement

হার্পার কলিনস

বক্তৃতার সংকলনকে ‘বই’ বললে সাধারণত অত্যুক্তি হয়। কিন্তু রঘুরাম রাজন, আর যা-ই হোক, সাধারণ নন— রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কোনও গভর্নর কখনও রকস্টার খেতাব পাননি। প্রধানত গভর্নর হিসেবে (২০১৩-১৬) বিভিন্ন বক্তৃতা, আর তার আগে আইএমএফ-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও শিকাগোর বুথ স্কুল অব বিজনেস-এর শিক্ষক হিসেবে কয়েকটি ভাষণ নিয়ে তৈরি শ’তিনেক পৃষ্ঠার সংকলনটি একটি মূল্যবান বই হয়ে উঠেছে— লেখক রকস্টার বলে নয়, তিনি এই বক্তৃতাগুলিতে নিজের চিন্তাভাবনাকে সুশৃঙ্খল যুক্তি আর প্রাসঙ্গিক তথ্যের কাঠামোয় গ্রন্থিত করেছেন বলে।

সম্প্রতি নতুন বইয়ের প্রকাশ উপলক্ষে ভারতে এসে নানান মঞ্চে কথা বলতে গিয়ে রাজন জানিয়েছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পর্ব চুকিয়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়ে তিনি আনন্দে আছেন, কারণ ‘পেপার লেখা আর পড়ানো, এটাই আমি ভালবাসি।’ বক্তৃতাগুলি পড়লে বোঝা যায় সেটা কথার কথা নয়, প্রত্যেকটিতেই শিক্ষকের কণ্ঠস্বর সুস্পষ্ট— ব্যাঙ্কের স্বাস্থ্য থেকে মূল্যবৃদ্ধির মোকাবিলা, ঋণ নীতি থেকে মেক ইন ইন্ডিয়া, বিশ্ব অর্থনীতির সংকট থেকে গণতন্ত্র, বিষয় যা-ই হোক, বক্তা শান্ত ভাবে যুক্তি দিয়ে নিজের প্রতিপাদ্য বুঝিয়ে বলেন।

সেই বিশ্লেষণের পরেও অনেক প্রশ্ন থেকে যেতেই পারে, বিশেষ করে অর্থনীতিকে রাজনীতি-বিযুক্ত একটা যান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখার যে ধারা মূলধারার অর্থশাস্ত্রে প্রচলিত, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের লেখায় তার প্রভাব অনেক সময়েই প্রবল। তার ফলে লেখাগুলি শেষ অবধি একটা চেনা ছকের মধ্যেই সীমিত থাকে, অর্থনীতিকে বোঝার কোনও নতুন পথ দেখাতে পারে না। কিন্তু সেটা সম্ভবত বক্তা তথা লেখকের উদ্দেশ্যও নয়। তিনি অর্থনীতির তত্ত্ব এবং নিজের আর্থিক প্রশাসনের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে বিভিন্ন সমস্যাকে বুঝতে চেয়েছেন, তাদের মোকাবিলার কার্যকর উপায়গুলি নির্দিষ্ট করতে চেয়েছেন। নিজের প্রশিক্ষণের কাঠামো ভেঙে নিজেকে অতিক্রম করার কোনও বাসনা তাঁর নেই। তাঁর সাফ কথা: আমার যা করার, আমি তা করি।

এবং তাঁর যা বলার, তিনি তা বলেন। ২০১৫ অক্টোবরে দিল্লি আইআইটি’র সমাবর্তন ভাষণে রঘুরাম রাজন যে বিষয়টি বেছে নিয়েছিলেন তার শিরোনাম: টলারেন্স অ্যান্ড রেসপেক্ট। সহিষ্ণুতা ও সম্মান। অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে ভারত তখন উত্তাল। স্বভাবতই, সেই বিষয়-নির্বাচন নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছিল। মোদীভক্তদের নিন্দেমন্দ ধর্তব্য নয়, কিন্তু তার বাইরেও অনেকেই বলেছিলেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্ণধারের এমন স্পষ্টত রাজনৈতিক মতামত পেশ করা উচিত হয়েছে কী?

প্রায় দু’বছর পরে সংকলনের জন্য লেখাটিতে যে পরিশিষ্ট সংযোজন করেছেন রাজন (অধিকাংশ লেখার সঙ্গেই, শুরুতে এবং শেষে, এমন সংযোজন আছে বইটিতে— সম্পাদনার এই যত্ন সুলভ নয় বলেই অভিনন্দন দাবি করে), সেখানে তিনি এই সমালোচনার তীক্ষ্ণ উত্তরে জানিয়েছেন, তিনি ভারতের সহিষ্ণুতার ঐতিহ্যের কথাই বলেছিলেন, লোকে ভুল বুঝলে তিনি নাচার। এবং, সচরাচর কঠোর সমালোচনা-প্রবণ তাঁর কিশোর পুত্র এই বক্তৃতা পড়ে তাঁকে লিখেছিল, ‘তোমায় নিয়ে আমি গর্বিত।’ রাজন বলেছেন, এটাই তাঁর পরম প্রাপ্তি।

আরও পড়ুন:ছাঁচভাঙা অন্য জগতের কথা

শুধু অসহিষ্ণুতা নয়, রাজন বিভিন্ন বিষয়ে নিজের মত প্রকাশ্যে বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের মতের সঙ্গে না মিললেও চুপ করে থাকেননি, সেই মতানৈক্য সুদের হার কমানোর প্রশ্নেই হোক কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতার প্রসঙ্গেই হোক— এ দেশে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরদের আচরণে এমনটা বিশেষ দেখা যায়নি। কিন্তু তিনি ভেবেচিন্তেই এই ব্যতিক্রমী আচরণের পথ নিয়েছেন। এই বিষয়ে তাঁর মত স্পষ্ট। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব তার পরিচালকদের, সে জন্য যখন প্রকাশ্য বিতর্কের দরকার হয় তখন তা থেকে পিছিয়ে যাওয়ারও কোনও কারণ নেই। অর্থাৎ, অর্থমন্ত্রী বা সরকারের অন্য কর্তারা যদি ‘বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়ার জন্য সুদ কমানো উচিত’ বলে প্রকাশ্যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্দেশে তোপ দাগতে থাকেন, তা হলে তার গভর্নরকেও এক সময় সরব হতে হয়। অরুণ জেটলিদের মোকাবিলা করতেই রঘুরাম রাজনকে সরব হতে হয়েছে। অর্থনীতির যুক্তি স্পষ্ট করার তাগিদেই।

তাঁর বিচারে অসহিষ্ণুতার প্রশ্নটিও অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। দিল্লি আইআইটি-র বক্তৃতাটিতে রাজনের একটি প্রতিপাদ্য ছিল, ভারতের আর্থিক উন্নতির জন্য উৎপাদন শিল্পের চেয়ে বেশি উপযোগী তথ্যপ্রযুক্তির মতো পরিষেবা শিল্প। উৎপাদন শিল্পে যান্ত্রিক দক্ষতা দিয়েই কাজ হয়, পরিষেবায় সফল হতে চাইলে উদ্ভাবন দরকার। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং সমাজে চিন্তা ও তর্কের স্বাধীনতা না থাকলে উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ হবে না। এই সত্য ঠেকে শিখে চিন এখন তার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টির চিন্তা-শাসনের শৃঙ্খল কিছুটা খোলার চেষ্টা করছে। নরেন্দ্র মোদীর শাসন তর্কপ্রিয় ভারতের মগজে কার্ফু জারি করতে তৎপর। রঘুরাম রাজনরা এই জমানায় স্বাগত হতে পারেন না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement