চিত্তপ্রসাদ-এর (১৯১৫-১৯৭৮) জন্মশতবার্ষিকী অতিবাহিত হল গত বছর। আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতি মহলে বিশেষ কোনও সাড়া জাগেনি। তাঁর ‘অ্যাঞ্জেলস উইদাউট ফেয়ারি টেলস’ চিত্রকলার কিছু ছবি নিয়ে একটি সংকলন অবশ্য প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলায় আর একটি বড় সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল বছর দুয়েক আগে প্রকাশ দাসের সম্পাদনায়। এর বাইরে আর কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি সরকারি বা অ-সরকারি স্তরে। আজকের বাঙালি মনেই রাখেনি চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য কত বড় মাপের শিল্পী ছিলেন। এবং ভারতীয় চিত্রকলার আধুনিকতাবাদী আন্দোলনের সূচনা পর্বে কী গভীর অবদান রেখেছিলেন তিনি!
এই অভাবকে খানিকটা হলেও প্রশমিত করল কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজের উপর তলায় অবস্থিত বই-চিত্র গ্যালারিতে বই-চিত্র ও চিত্তপ্রসাদ সেন্টিনারি কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত চিত্তপ্রসাদ জন্মশতবার্ষিকী প্রদর্শনীটি।
আধুনিকতাবাদী চিত্রের বিকাশে চিত্তপ্রসাদের অবস্থানটিকে বুঝতে হবে। চিত্তপ্রসাদ ১৯৪০-এর দশকের প্রধান একজন শিল্পী। সামাজিক দায়বোধকে নান্দনিকতায় উদ্ভাসিত করার যে বিশেষ ধারা, তার প্রধান পথিকৃৎ তিনি। চল্লিশের দশকের যে সামাজিক-রাজনৈতিক আলোড়ন ও ঔপনিবেশিক শোষণ তার কদর্যতম প্রকাশ ঘটেছিল ১৯৪৩-এর মন্বন্তরে। এই মন্বন্তরের আঘাতে উদ্ভাবিত হয়েছিল বিশেষ এক রূপকল্প। পরবর্তী কালে তা থেকেই বিকশিত হয়েছিল এক আঙ্গিক-পদ্ধতি, যার শ্রেষ্ঠ দুই রূপকার ছিলেন চিত্তপ্রসাদ ও তাঁর শিষ্যপ্রতিম শিল্পী সোমনাথ হোর।
চিত্তপ্রসাদ ১৯৪৩ সালে দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন: ‘ছবির সংকট’ ও ‘আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার ভূমিকা’। তাতে চিহ্নিত করেছিলেন চিত্রকলার আধুনিতার সংকট এবং তা থেকে মুক্তির উপায় কী? শিল্পের সঙ্গে জীবনের বিচ্ছিন্নতার কথা বলেছিলেন তিনি। কিন্তু সংযোগের পথে প্রধান তিনটি বাধাকে চিহ্নিত করেছিলেন। প্রথম বাধা বিদেশির শাসন। দ্বিতীয়, ধনিকের শাসন ও শোষণ। তৃতীয়, প্রয়োজনীয় শিক্ষা’। উত্তরণের পথও দেখিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থেকে।
১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘুরে আকালের তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতাকে লিপিবদ্ধ করেন ‘হাংরি বেঙ্গল’ নামে ছবি ও লেখায় সাজানো এক পুস্তিকায়। এর আগে পার্টির জন্য তিনি এঁকেছেন অজস্র ফ্যাসি-বিরোধী পোস্টার। তিনি চেয়েছিলেন ছবিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। তাই সাদা-কালোয় লিনোকাট ও কাঠখোদাইয়ের আঙ্গিক বেছে নিয়েছিলেন। বাস্তববাদী অবয়বী আঙ্গিকে সহজ, সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় সারা জীবন ছবি এঁকেছেন। স্বাভাবিকের সঙ্গে লৌকিককে মিলিয়েছেন। যেখানে তাঁর প্রধান প্রেরণা ছিলেন নন্দলাল বসু। ১৯৪৬ সালে পার্টির গুরুত্বপূর্ণ কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য বম্বে যান। বাকি জীবন সেখানেই কেটেছে। ছবি ছাড়া নাটকের কাজের সঙ্গেও যুক্ত হন। ১৯৫১ সালে তিনি এঁকেছিলেন ‘অ্যাঞ্জেলস উইদাউট ফেয়ারি টেলস’ শিরোনামে ২২-টি চিত্রমালা। ১৯৬৯ সালে ডেনমার্কের ইউনিসেফ থেকে সেই ছবির একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়।
এই প্রদর্শনীতে তাঁর যে সব ছবি রয়েছে তাতে বিপন্নতার ছবি যেমন আছে, তেমনই আছে উজ্জীবনের ছবিও। ‘ভিকটিমস অব ফেমিন’ ছবিটিতে (১৯৫২) কঙ্কালসার বালক-বালিকা বসে থাকে পথের উপর। ‘প্রেগনান্ট মাদার’ ছবিতে (১৯৫২) অন্তঃসত্ত্বা নারীর মাথায় বোমা তুলে দিচ্ছেন তাঁর সহযোগী এক পুরুষ শ্রমিক। সাদা-কালোর সংবৃত ও সুস্মিত বিভাজন ছবিগুলিতে সহজের মধ্যে অমিত শক্তি সঞ্চার করে। এই যেমন বিপন্ন বাস্তবতার ছবি, তেমনই আছে আদর্শায়িত স্বপ্নের ছবিও। ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’ শীর্ষক একটি ছবিতে পশ্চাৎপটে প্রান্তরে কৃষিকাজের আবহ। পাখি উড়ছে। সম্মুখপটে বসে আছে মা। মুক্ত বক্ষে সন্তানকে স্তন্যপান করাচ্ছে। চিত্তপ্রসাদ চেয়েছিলেন জীবনে এই স্বপ্ন পরিব্যাপ্ত হোক।