রচনা সংগ্রহ ৩ / সৌরীন ভট্টাচার্য
সম্পাদক: অম্লান দত্ত
মূল্য: ১০০০.০০
প্রকাশক: অভিযান
মার্কিন মুলুক থেকে একেবারে ভিন্ন সংস্কৃতির অল্পবয়সি কিছু ছাত্রছাত্রী এখানে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জানাবোঝার জন্যে আসার সুবাদে কবির শিক্ষাচিন্তা ও পল্লীসংগঠন নিয়ে আলোচনার সুযোগ হয়েছিল সৌরীন ভট্টাচার্যের। সেই সূত্রে তিনি জানিয়েছেন ‘ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রবীন্দ্রনাথের এই সংহতির দিকটা আরো বেশি করে আমার কাছে ধরা দেয়। তাঁর লেখার জগৎ ও কর্মকাণ্ডকে একটানে ধরতে পারলে মনে হয় আমাদের উপকার হবে।’ সৌরীনবাবুর সেই মননপ্রসূত ‘কেন আমরা রবীন্দ্রনাথকে চাই এবং কিভাবে’ বইটির রচনাদি ঠাঁই পেয়েছে তাঁর রচনাসংগ্রহ ৩-এ। নামগদ্যটিতে কোনও ক্রম না মেনে তিনি কবির রাশিয়ার চিঠি, রাজা, মুক্তধারা, রক্তকরবী, বা গানের টুকরো পংক্তির নিক্তিতে যে আদলটা পেতে চাইছেন, লিখছেন তা: ‘বিশ্বধনবাদের মধ্যে বিযুক্তির আভাস দেখতে পাওয়া, এ তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়ালব্ধ দৃষ্টি নয়। ইউরোপ-আমেরিকার অভিজ্ঞতা নিয়ে রাশিয়ার অন্য কর্মযজ্ঞ দেখার দিনে তাঁর সঞ্চয়ে কিন্তু ওই যোগের ভিত ততদিনে বদ্ধমূল।’ আরও যে দু’টি বইয়ের গদ্যাদি আছে এ সংগ্রহটিতে তার একটি ‘শুক-শারী সংবাদ ও আরো কিছু গদ্য পঙ্ক্তি’, তাতে শুরুতেই জানিয়েছেন ‘ইদানীং শুধুই ছোটো লেখা, খুব ছোটো লেখা লিখতে ইচ্ছে করে।’ তেমনই একটি ক্ষুদ্র গদ্য ‘সন্ত্রাসবাদ’ বিষয়ক: ‘জেনে রেখো, ঠ্যাঁটামি কিন্তু কোনোমতে বেশিদিন সহ্য হবে না আমার। ধোপা-নাপিত সব বন্ধ হবে জেনো। তারপর নিশ্চিন্তে ফাশিবাদের ধারণাগত বিশ্লেষণ নিয়ে সেমিনার করা যাবে।’ সংগ্রহটিতে সংকলিত শেষ বই ‘গাথা উপগাথা’-র ‘ওই উজ্জ্বল দিন’ নিবন্ধে স্বাধীনতার অব্যবহিতে প্রধানমন্ত্রী নেহরুর উদ্যমে নতুন ভারত গড়ে তোলার পরিকল্পিত অর্থনীতি নিয়ে আজও যে আমাদের নস্টালজিয়া, তাতে ঝাঁকুনি দিয়েছেন যথেষ্ট: ‘পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল সবটাই ছিল রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে। রাষ্ট্রলগ্ন এই উন্নয়ন ধাঁচের অসারতায় পৌঁছতে আমাকে কম পথ পাড়ি দিতে হয়নি।’ সবশেষে বিস্তৃত গ্রন্থপরিচয়, সেখানে আগের দু’টি খণ্ডেরও বিবরণ পাবেন পাঠক। সৌরীনবাবুর মতো বিরল ভাবুকের চিন্তার বিপুল বিচিত্র উদ্ভাস এই খণ্ডগুলিতে, সময় সমাজ সংস্কৃতিকে মোকাবিলার এক আশ্চর্য বাতাবরণ তাঁর লেখনীতে। ‘সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞান সংগীত অবলীলায় মিলেছে সেই রচনায়, অনেক সময়েই নিজেকে একেবারে অবলীন রেখে।’ যথার্থই লিখেছেন অম্লান দত্ত তাঁর সম্পাদকের নিবেদন-এ।
আবাদভূমির আগুনবীজ / সিঙ্গুর আন্দোলনের দলিল
সম্পাদক: মধুময় পাল
মূল্য: ৩৫০.০০
প্রকাশক: দীপ
কর্পোরেট শাসিত মডেল টিকে থাকবে না কি জয়ী হবে জল-জঙ্গল-জমিনের লড়াই? এ রাজ্যের সিঙ্গুর আন্দোলন সেই গুরুতর প্রশ্নের মুখে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। দাঁড় করিয়েছিল এই প্রশ্নের মুখেও যে, তা হলে শিল্প অভিমুখী উড়ান কোন মডেল ধরে হবে? ‘২৩৫’-এর গর্বে গর্বিত তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার যে নীতি-নিয়মের তোয়াক্কা না করেই সিঙ্গুরের বহুফসলি জমি অধিগ্রহণ করেছিল, সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়েই তার প্রমাণ মিলেছে। কী ভাবে সিঙ্গুর হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আর একটি নাম? কী ভাবে কৃষিজীবীদের আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন শ্রমজীবী মানুষ আর গণতান্ত্রিক শক্তি?
২০০৬-এর ১৮ মে সিঙ্গুরে টাটার প্রকল্পের কথা ঘোষণা হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সেখানকার জনগণ ও কৃষকেরা। তার পর থেকে যা যা ঘটেছে তা সমাজবিজ্ঞানের পড়ুয়া, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে তুমুল আগ্রহের সঞ্চার করে। আলোচ্য সংকলন গ্রন্থটিতে সম্পাদক মধুময় পাল একেবারে গোড়া থেকে সেই অধ্যায় বিবৃত করেছেন।
এই গ্রন্থে ঐতিহাসিক সিঙ্গুর আন্দোলনের বিবৃতি-ঘটনা-সংঘাত-দলিলের সঙ্গেই কবিতা ও গানের ইতিহাস ধরার চেষ্টা করেছেন মধুময়। শাসক ও বিরোধী— যুযুধান দু’টি শিবিরের অগ্রণী নেতাদের সাক্ষাৎকার, লেখা, বক্তৃতাকে ঠাঁই দিয়ে সম্পাদক সামগ্রিক আন্দোলনকেই ধরার চেষ্টা করেছেন নৈপুণ্যের সঙ্গে। রয়েছে মানবাধিকার কর্মী ও আন্দোলনকারীদের লেখাও। এসেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহু আলোচিত ধর্নার প্রসঙ্গও। ভিন্ন আলোকে সিঙ্গুর আন্দোলন ও তার গুরুত্বকে আরও একবার সামনে আনলেন সম্পাদক।
এক ডাক্তারের কুমেরু স্মৃতি
লেখক: প্রদীপ মলহোত্র
মূল্য: ৩০০.০০
প্রকাশক: আনন্দ
অপারেশন টেবিল। ঝুঁকে পড়ে চার জন চিকিৎসক। দু’জন ভারতীয়। দু’জন রাশিয়ান। অ্যাপেনডিসাইটিস অপারেশন চলছে। মাঝেমধ্যে আলো কমে আসছে। বেশ কিছু জিনিস ঠিকমতো কাজ করছে না। এমনিতে যে অপারেশন জলভাত, সুদূর কুমেরুতে সেই অপারেশনের ব্যবস্থাটুকু করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়েছিল চিকিৎসক প্রদীপ মলহোত্রকে। সেই রোমহর্ষক বিবরণ পড়তে গেলে হাতে নিতে হয় এক ডাক্তারের কুমেরু স্মৃতি বইটি। কুমেরু নিয়ে আগ্রহ আজও কমার নয়। যদিও টেলিভিশন, ইন্টারনেটের দৌলতে আজ এ নিয়ে পড়ার জিনিস রয়েছে থরে-বিথরে। কিন্তু বাংলায়? সে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন এই বইটি। পেশায় স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ প্রদীপ মলহোত্র ২০০৩-’০৪-এ বাইশতম ভারতীয় কুমেরু অভিযানের সঙ্গী হয়ে গিয়েছিলেন। সেই দীর্ঘ কুমেরু বাসের স্মৃতিকথা এই বই। ডায়েরি লেখার ধরনে ধরা আছে কুমেরুর গল্প। কল্পনাবিলাস নয়, ঘোর বাস্তব। প্রস্তুতি পর্ব থেকে শুরু হয়ে কত খুঁটিনাটি কথাই না আছে সেখানে। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ— ডাক্তার বলে কিছুই বাদ যায়নি। সেই কাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ প্রদীপবাবুর নজর এড়ায়নি। আর সঙ্গে আছে সেই বিচিত্র ভূমির কথা, প্রাণীর কথা। আছে অরোরা অস্ট্রেলিয়াস, পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের মতো মহাজাগতিক দৃশ্যের কথাও বলেছেন প্রদীপবাবু। তবে খামতি থেকে গিয়েছে তাঁর গদ্যে। আড়ষ্টতা গদ্যকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। বিবরণের মাঝে ‘উচ্চমার্গের অ্যান্টিবায়োটিক’, ‘নৈতিক মদত’-এর মতো শব্দবন্ধ কোথাও যেন পড়ার মজাকে টলিয়ে দেয়।