জুড়ি: উদয়শঙ্কর ও অমলাশঙ্কর। ছবি বই থেকে।
স্মৃতি সতত সুখের নাও হতে পারে। স্বনামধন্য নৃত্যব্যক্তিত্ব অমলাশঙ্করের স্মৃতিচারণার ভিত্তিতে বিশাখা ঘোষের লেখা শঙ্করনামা পড়ে এরকমই মনে হল। কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্কর, তাঁর পরিবার এবং তাঁর শিল্প তথা নৃত্যচর্চা ঘিরে অমলাশঙ্কর যে স্মৃতির মালা গেঁথেছেন তাতে ফুলের সঙ্গে অনেক কাঁটাও আছে। ‘সানন্দা’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত এই অকপট স্মৃতিকথনে মিশে আছে একই সঙ্গে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ, মধুরতা-তিক্ততা। স্মৃতিরোমন্থনে অধিকাংশ মানুষই জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা এড়িয়ে যেতে চান। অমলাশঙ্কর তার মূর্ত ব্যতিক্রম। জীবনে আলোর মতো অন্ধকারও থাকে— এই সহজ সত্যকে শিরোধার্য করে তিনি স্মৃতির ঝাঁপি উন্মুক্ত করেছেন। আর এখানেই এই স্মৃতিকথা পেয়ে যায় এক স্বতন্ত্র মাত্রা।
যশোরের বাটাযোড় গ্রামের কিশোরী অমলার সঙ্গে যখন বিখ্যাত শঙ্কর-পরিবারের পরিচয় ঘটল সুদূর প্যারিসে ১৯৩১-এ, তখনই বুঝি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল ওই মেয়ের ভবিষ্যৎ। উদয়শঙ্কর তখন মা হেমাঙ্গিনী আর ভাইদের নিয়ে প্যারিস-প্রবাসী, নৃত্যে ইতিমধ্যেই খ্যাতিমান। লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব আর্ট-এ চিত্রকলার পাঠ শেষে বিখ্যাত রাশিয়ান ব্যালেরিনা আনা পাভলোভা-র প্রভাবে উদয়শঙ্কর নাচকে পেশা করেন। নাচে প্রথাগত তালিম না থাকলেও তাঁর ছিল সহজাত প্রতিভা, শিল্পবোধ আর সৃজনক্ষমতা। শঙ্করের শো দেখে মুগ্ধ অমলার নৃত্যে হাতেখড়ি শঙ্করেরই কাছে প্যারিসে। সে সময় শঙ্করের ‘কালীয়দমন’ প্রযোজনায় কালীয় করলেন অমলা, শ্রীকৃষ্ণ শঙ্কর। ১৯৩২-এ দেশে ফিরলেও ১৯৩৯-এ নেতাজি সুভাষচন্দ্রের কথায় অমলা যোগ দেন আলমোড়ায় ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচার সেন্টার’-এ। ১৯৩৮-এ তৈরি শঙ্করের স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হন দেশের সেরা শিল্পী-প্রশিক্ষকবৃন্দ: কথাকলি-শিল্পী শঙ্করণ নাম্বুদ্রি, বালাসরস্বতীর গুরু ভরতনাট্যম শিল্পী কন্ডপ্পা পিল্লাই, মণিপুরি নৃত্যশিল্পী গুরু অমোবী সিংহ এবং উস্তাদ আলাউদ্দিন খান। ছাত্রছাত্রীরা ছিলেন: নরেন্দ্র শর্মা, গুরু দত্ত, শচীনশঙ্কর, শীলা ভরতরাম প্রমুখ। এখানেই উদয়শঙ্কর সৃষ্টি করেন অসামান্য ছায়ানাটিকা ‘রামলীলা’।
কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় যে পাঁচ বছর চলার পর সেন্টার বন্ধ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে শঙ্কর বিয়ে করেছেন অমলাকে ১৯৪২-এ, যদিও তাঁর জীবনে বিভিন্ন নারীর পদপাত ঘটেছে: বিয়্যাট্রিস, সিমকি (শঙ্করের দেওয়া নাম, আসল নাম সিমোন বারবিয়ের), জোহরা। তিনজনেই শঙ্করের রমণীয় ব্যক্তিত্বে, নৃত্যপটুত্বে মুগ্ধ। অমলাও আলমোড়া যাওয়ার আগে একটি ছেলের প্রেমে পড়েন, বলাই বাহুল্য তা পরিণতি পায়নি। নিজের ব্যর্থ প্রেম, শঙ্করের প্রেম-ভালবাসা সব কিছু নিয়েই অমলা নিঃসঙ্কোচ। বিয়্যাট্রিস ও এল্মহার্স্ট পরিবারের (বিয়্যাট্রিসের মা ডরোথি দ্বিতীয় বার বিবাহ করেন লিওনার্ড এল্মহার্স্টকে, যিনি শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথকে সাহায্য করেছিলেন) আর্থিক সহায়তা ছিল সেন্টার প্রতিষ্ঠায়। সিমকি ছিলেন শঙ্করের নৃত্যসঙ্গিনী। দলে জোহরারও একটা বিশিষ্ট স্থান ছিল। শঙ্করের বিয়ের বছরেই সিমকি, জোহরাও বিয়ে করেন, শঙ্করের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশ আলগা হয়ে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও তখন শুরু হয়ে গিয়েছে। আর শঙ্কর সে সময় তাঁর নতুন ভাবনা— ‘কল্পনা’ চলচ্চিত্র নিয়ে মশগুল। এই অবস্থায় সেন্টারের পথ-চলা বন্ধ হয়ে গেল। এ প্রসঙ্গে ১৯৪৪-এর মার্চে বিয়্যাট্রিসকে লেখা এক গুরুত্বপূর্ণ চিঠিতে (পৃ ৯০) সিমকি ও জোহরাকে দোষারোপের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভুলও কবুল করেন শঙ্কর। এ ব্যাপারে অমলা বলেন শঙ্করের জেদ, অহংবোধের কথা। সেন্টার বন্ধ হওয়ার ব্যাপারে আরও বিশদে জানতে অমলা অনেক পরে, সেন্টারের তৎকালীন ছাত্র, খুড়তুতো দেওর শচীনশঙ্করকে এক চিঠি লেখেন। উত্তরে তিনি উদয়শঙ্করের ‘কল্পনা’ তৈরির বাসনা ও উদ্যোগকে সমর্থন করে ছাত্রদের অবিমৃষ্যকারিতার কথা বলেন, বৌদি অমলাকেও দোষারোপ করেন। এখানে উল্লেখ্য, সেন্টার মাদ্রাজে সরিয়ে নেওয়ার কথা হয়েছিল তখন। এ ক্ষেত্রে অমলার বক্তব্য: তিনি কখনওই সেন্টারের প্রশাসনিক স্তরে গভীর ভাবে যুক্ত ছিলেন না, তিনি শুধুই নৃত্যশিল্পী। তা ছাড়া সে সময় তিনি সংসার, স্বামী, প্রথম সন্তান আনন্দকে নিয়ে ব্যস্ত।
দূরদর্শী উদয়শঙ্কর ঠিকই বুঝেছিলেন যে তাঁর নৃত্য-উপস্থাপনা, সৃজনশীল পরিকল্পনা চিরকালের মতো ধরে রাখতে হবে, সে জন্যই চলচ্চিত্র মাধ্যমে ‘কল্পনা’-র ভাবনা। শঙ্করের অন্যান্য সৃষ্টির তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ‘কল্পনা’ মুক্তি পায় ১৯৪৮ সালে। এ যেন ‘‘একজন নৃত্যশিল্পীর স্মৃতি-বিস্মৃতি, কল্পনা-কাহিনি, একগুচ্ছ নৃত্যসৃষ্টি, বাস্তব-অবাস্তবের ছিন্ন টুকরো দিয়ে জোড়া... পরাবাস্তব ঘেঁষা কোলাজ।’’ এর মধ্যে শঙ্করের জীবনের কিছু ছায়াপাত ঘটলেও একে শিল্পীর আত্মজীবনী হিসেবে মানতে নারাজ অমলা। আলমোড়া সেন্টারের ছাত্র গুরু দত্ত চিত্রনাট্যের প্রাথমিক খসড়া করেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগ দেন বিষ্ণুদাস শিরালি, গুরু অমোবী সিংহ, রবিশঙ্কর, আলি আকবর প্রমুখ। অভিনয়ে ছিলেন শঙ্কর, অমলা, তা ছাড়া মালাবার-মাদ্রাজ-মহারাষ্ট্রের বেশ কিছু নতুন মুখ। পরে ‘কল্পনা’ দেশে-বিদেশে নানা জায়গায় প্রদর্শিত ও সমাদৃত হয়।
কল্পনা-র সূত্রেই কয়েকটি কথা। স্মৃতিচারণায় স্বাভাবিক ভাবেই শঙ্করের বিভিন্ন স্মরণীয় প্রযোজনার (রামলীলা, বুদ্ধ, সামান্য ক্ষতি, প্রকৃতি আনন্দ) প্রসঙ্গ এসেছে। অমলা বলেছেন— শাস্ত্রীয় নৃত্যে তালিম না থাকলেও শঙ্করের নাচে শাস্ত্রীয় ধারাটাই বজায় ছিল— সেটাই শঙ্করের নৃত্যশৈলীর বিশেষত্ব। যথার্থ অভিমত। এখানেই মনে হয় যে, অমলা যদি বিভিন্ন প্রযোজনার সূত্রে শঙ্করের নৃত্যভাবনা তথা পরিকল্পনা নিয়ে আরও অনুপুঙ্খ আলোচনা করতেন, তা হলে আগ্রহী মানুষজন আরও সমৃদ্ধ হতেন।
শঙ্করনামা/ স্মৃতিচিত্রে অমলাশঙ্কর
বিশাখা ঘোষ
৫০০.০০
আনন্দ পাবলিশার্স
রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে রবীন্দ্রকবিতা অবলম্বনে শঙ্কর করেন ‘সামান্য ক্ষতি’। ইতিমধ্যে ওঁদের পরিবারে এক নতুন অতিথি এসেছেন— অমলা তার নাম রাখলেন ‘মমতা’। আনন্দ-র নাম রেখেছিলেন শঙ্কর। সে সময় ছেলে-মেয়ে কাজকর্ম নিয়ে ভালই কাটছিল দিন। তখন কে ভেবেছিল বছর কয়েকের মধ্যেই ঘটনাপ্রবাহ এমন মোড় নেবে যা আদৌ সুখকর নয়।
বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে গঠিত ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব ডান্স ড্রামা অ্যান্ড মিউজিক’-এ এক বছর থেকে পদত্যাগ করেন শঙ্কর। ১৯৬৫-র মার্চে ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচার সেন্টার’ আবার যাত্রা শুরু করে রবীন্দ্রসরোবর স্টেডিয়ামের একটি হলে। অধ্যক্ষ উদয়শঙ্কর। আলমোড়ার তুলনায় খুবই ছোট আয়োজন। তাই হয়তো প্রথম থেকেই তেমন ভাল লাগেনি শঙ্করের। সেন্টারের পরিচালন নিয়ে ক্রমশ দু’জনের মতভেদ ক্রমশ প্রকট হয় পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণেই। অমলার মত— এটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কমার্শিয়াল ট্রুপ নয়। সেন্টারের ভিত্তি যত দৃঢ় হল, শঙ্কর-পরিবারের বাঁধন যেন তত আলগা হল। শঙ্কর নিজে একটি দল (উদয়শঙ্কর ব্যালে ট্রুপ) করে দু’বার অনুষ্ঠান-সফরে গেলেন অমলাকে ছাড়াই। সফরে দু’-জায়গাতেই শঙ্করের হার্ট-অ্যাটাক হয়। তবে অসুস্থতা কাটিয়ে শঙ্কর আবার নতুন কিছুর সন্ধানে সক্রিয়: ১৯৭১-এ করলেন ‘শঙ্করস্কোপ’— তাঁর শেষ কীর্তি। তাঁর কথায়: ‘‘...মঞ্চে সিনেমার সাহায্যে এটি একটি নতুন ধরনের বিচিত্রানুষ্ঠান।’’ (পৃ ২৪৯)। ‘শঙ্করস্কোপ’ সাড়া জাগাল আইডিয়া ও কলাকৌশলের চমৎকারিত্বে, তবে এর শিল্পগুণ নিয়ে প্রশ্ন উঠল। অমলাকে এই দলে নেওয়া হয়নি, আনন্দ ছিলেন সঙ্গীতশিল্পীদের দলে। এই ভঙ্গুর সময়ে শঙ্করের জীবনে আর-এক নারীর (শঙ্করস্কোপ-এর শিল্পী) উপস্থিতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। ১৯৭৩-এ উদয়শঙ্কর গল্ফ ক্লাবের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। অমলা তবু ছেলেমেয়ে ও কাজ নিয়ে ছিলেন। কিন্তু সত্তরোর্ধ্ব শঙ্করকে কাতর করে তোলে বার্ধক্য, আনুষঙ্গিক সমস্যা। ১৯৭৭-এর ২৬ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সংস্কৃতির এই ট্র্যাজিক নায়ক অন্য লোকে পাড়ি দিলেন। তবে সুখের কথা, হাসপাতালে শেষ ক’টা দিনে সব ভুল বোঝাবুঝির অবসানে অমলার সঙ্গে শঙ্করের আবার মিলন ঘটে।
বিশাখার এ-লেখা শুরুর অনেক আগেই উদয়শঙ্কর প্রয়াত। এ-প্রসঙ্গে ভূমিকায় লেখিকার খেদোক্তি যথার্থ: ‘‘... তাঁর [উদয়শঙ্কর] সঙ্গে সরাসরি কথা না-বলতে পারার দুঃখটা থেকেই যাবে।’’ সেটা সম্ভব হলে এই স্মৃতিকথা সার্থকতর হত সন্দেহ নেই। তবে যেটুকু পাওয়া গেল তার মূল্য অসীম। আর তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব অমলাশঙ্করের। জীবন যে রকম, তাকে সে ভাবেই মেলে ধরেছেন অমলা।
সুছাঁদ, সুমুদ্রিত এ-গ্রন্থের আর-এক সম্পদ অসামান্য সব ছবি। একটি ছবির (পৃ ২৩৮) পরিচিতিতে লেখা ‘বিমল ঘোষ’— সম্ভবত ‘বিমান ঘোষ’ হবেন যিনি রেডিয়ো ও গ্রামোফোন কোম্পানিতে উচ্চ পদে আসীন ছিলেন।
হৃদয়স্পর্শী এই স্মৃতিলেখ পড়তে-পড়তে মন আপনা থেকেই ভারী হয়ে ওঠে। এও মনে হয় যে, উদয়শঙ্করের মতো যুগান্তকারী নৃত্যপরিকল্পক-শিল্পীর সামগ্রিক অবদান নিয়ে বাংলায় কোনও পূর্ণাঙ্গ বই নেই! এ শুধু দুঃখের নয়, লজ্জারও।