পটচিত্রে রামকথা

গল্প বলা আর পট লেখায় মানুষের অভ্যাস সেই কবেকার। মহাকাব্যের কাহিনি নিয়ে পটের চিত্র দেখা ও গীত শোনার একান্ত জগৎ গড়ে ওঠে। বাল্মীকি রামায়ণের সংস্কৃত মূল শুধু ভারত-সংস্কৃতির নানা ভাষাতে রূপান্তরিতই হয়নি— দেশ-দেশান্তরেও ঘটেছে তার বিস্তার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share:

দ্য রামায়ণ ইন বেঙ্গলি ফোক পেন্টিংস লেখক: মন্দাক্রান্তা বসু মূল্য: ৭৯৫.০০ প্রকাশক: নিয়োগী বুকস

গল্প বলা আর পট লেখায় মানুষের অভ্যাস সেই কবেকার। মহাকাব্যের কাহিনি নিয়ে পটের চিত্র দেখা ও গীত শোনার একান্ত জগৎ গড়ে ওঠে। বাল্মীকি রামায়ণের সংস্কৃত মূল শুধু ভারত-সংস্কৃতির নানা ভাষাতে রূপান্তরিতই হয়নি— দেশ-দেশান্তরেও ঘটেছে তার বিস্তার। গল্প উপন্যাস কমিক্‌স সিনেমা টিভি নাটক এমন কত রূপে কত মাধ্যমে সেই রামায়ণের ব্যাপ্তি। বহুবিস্তারী এই রামায়ণী কথা স্বাভাবিক ভাবেই লোকচিত্রেও বর্ণময় ভাষ্য তৈরি করে— যা বাংলার গ্রামীণ চিত্রকলার এক অনন্য দৃশ্যায়ন। বাংলার জড়ানো পট আর পটুয়াদের এই জগৎ নিয়েই মন্দাক্রান্তা বসু রামায়ণের আঙ্গিক পরখ করেছেন।

Advertisement

বাংলার পটচিত্র ও পটুয়াদের কৃৎকৌশলের পরম্পরাগত চর্চা বহু কালের। সমাজ সাহিত্য ও পরিপার্শ্বের নানা দিগন্ত গড়ে ওঠে পটের ছবি ও গানের সুরে। ছবি দেখাতে দেখাতে পট গুটিয়ে গল্প বলাও শেষ হয় এক সময়। লেখকও পট দেখতে দেখতে যেমন শুনেছেন, ‘মেদিনীপুর জেলায় আমার হবিচকে ঘর।/ সীতাহরণের পট শুনাই নিরঞ্জন চিত্রকর।।’ এই বইয়ে মূলত পূর্ব মেদিনীপুরের হবিচক গ্রামের পটুয়াদের তথ্য আলোচনাকেই ভিত্তি করেছেন লেখক। অখণ্ড মেদিনীপুর, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া এমন ভিন্ন ভিন্ন জেলার পটুয়াদের ধারাবাহিকতায় রামায়ণচিত্র ও গানের পর্যালোচনা করলে আঞ্চলিক বৈচিত্রের সুলুকসন্ধান পাওয়া যেত। পটচিত্রের ফ্রেমের পর ফ্রেমে চলমান কাহিনি নিয়ে তৈরি হয় কাব্যের নানা বিভাগ। এই বাংলার বৈষ্ণব ও শাক্ত ধর্মমতের যে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট তার প্রতিফলন ঘটেছে কথকতা, গান, নাচ, চিত্রে। পটুয়া জনগোষ্ঠীর শিল্পধারা ও সংগীতের মেলবন্ধনে কৃত্তিবাসী রামায়ণেরও আত্তীকরণ ঘটেছে। মন্দির ফলকের টেরাকোটা ভাস্কর্যের মতো রামায়ণের কোনও কোনও বিশেষ ঘটনাক্রম এক্ষেত্রে গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলার পটুয়াদের চিত্রকল্পে রামায়ণের আদিকাণ্ড থেকে অযোধ্যাকাণ্ড, অরণ্যকাণ্ড, কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড, সুন্দরকাণ্ড, লঙ্কাকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ডের কত চরিত্র ও ঘটনাবিন্যাসের তত্ত্বকথা সুমুদ্রিত এই বইয়ে। পাশাপাশি রামায়ণের গল্প নিয়ে পটুয়াদের আঁকা বর্ণরঙিন পটচিত্রে উজ্জ্বল এই প্রকাশনা।

লোকচিত্রে তুলিটানের বহমান আঙ্গিক ছাড়া রঙ-রেখায় রামায়ণ বর্ণনা শিশুমনকেও আকৃষ্ট করে। শিশুপাঠ্য নানা রামায়ণকাহিনি আমাদের দেশে বিভিন্ন ভাষাতেই প্রচলিত। বাংলায় যেমন শিশু সাহিত্য সংসদের রামায়ণ মহাভারত অনেক প্রজন্মকে এ দেশের প্রাচীন পরম্পরায় দীক্ষিত করেছে। অমর চিত্র কথা পেয়েছে বিপুল সর্বভারতীয় জনপ্রিয়তা। সম্প্রতি সোনালি জোহরার আঁকা রঙিন ছবি সহ রামায়ণের গল্প সরল ভাষায় বলেছেন আর্শিয়া সাত্তার (রামায়ণ ফর চিলড্রেন, জগরনট, ৪৯৯.০০)। এখানে বাল্মীকি রামায়ণেরই রূপব্যঞ্জনা প্রকাশ পেয়েছে। কোনও অন্যতর ব্যাখ্যার দিকে যাননি আর্শিয়া।

Advertisement

উনিশ শতকে বাঙালির রামায়ণ চর্চা

লেখক: শিবানী মুখোপাধ্যায়

মূল্য: ২০০.০০

প্রকাশক: অক্ষর প্রকাশনী

রামায়ণের পরম্পরা বহুচর্চিত। উনিশ শতকীয় রামায়ণ চর্চা নানা ধারার অন্বেষণের উত্তরাধিকারী। রামকাহিনির সূচনাকথা— ঋগ্‌বেদ, বৌদ্ধ জাতক, জৈন কাব্যের সূত্রে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এমনকী মহাভারতের কোনও কোনও পর্বেও রামকথা উল্লিখিত; আছে পুরাণকথাতেও। মধ্যযুগে বাংলা রামায়ণের রচয়িতাদের যে ধারা তাতে মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর রামায়ণও স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে।

উনিশ শতকে শতাধিক রামায়ণ ও রামায়ণকেন্দ্রিক সাহিত্যসম্ভার মুদ্রিত হয়, যা বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল সংযোজন। প্রথমার্ধের যে রচনা তাতে মূলত কৃত্তিবাসেরই প্রভাব। একই সঙ্গে পুথির গায়ক ও কথকদের নিজ নিজ মৌলিকত্বের বিষয়ও প্রাধান্য পেয়েছে। এরই সূত্র ধরে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রামায়ণ চর্চার গতিপ্রকৃতি ও নিরীক্ষা বিস্তৃততর হয়। তখন জনচিত্তজয়ী কৃত্তিবাসী রামায়ণ ছাড়াও সংস্কৃত বাল্মীকি রামায়ণের ঐশ্বর্য উদ্ঘাটনে নানা রচনা অনূদিত ও মুদ্রিত হয়েছে। কিন্তু উনিশ শতকের প্রথম পর্বে রামায়ণের অনুবাদে যে স্বকীয় ভাবপ্রসারী প্রবণতা লক্ষ করা যায় তা দ্বিতীয় ভাগে এসে বহুলাংশে যথাযথ মূলানুসারী। এই শতকে নবচেতনার উন্মেষের মতো রামায়ণকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার ধারা দেখা যায়। বৈশিষ্টপূর্ণ এই প্রচেষ্টায় কাব্য, নাটক ও প্রবন্ধের নানা বিস্তার লক্ষ করা যায়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের রামায়ণাশ্রিত মেঘনাদবধ কাব্য, হরিশচন্দ্র মিত্রের জানকী নাটক ছাড়া বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যেও রামায়ণের নানা ব্যবহার ও প্রভাব রয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, স্বামী বিবেকানন্দ, দীনেশচন্দ্র সেনের প্রয়াস ছাড়াও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রমুখের লেখায় রামায়ণের প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে।

রামায়ণ পর্যালোচনায় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে যে মূল্যায়ন করেছিলেন সেখানেও উনিশ শতকেরই উত্তরাধিকার নজরে পড়ে। গৌতম অধিকারী সংকলিত ও সম্পাদিত রামায়ণ বিচার (গোরাগাঙনি সাহিত্য পরিষদ, ২০/এ রাধানাথ মল্লিক লেন, কল-১২, ১৬০.০০) বইয়ে অক্ষয়কুমারের সে সব রচনা বিধৃত রইল। পথিকৃৎ ইতিহাসবিদের ছড়িয়ে থাকা লেখাগুলি গ্রন্থবদ্ধ হয়ে সংরক্ষণের মর্যাদা পেল।

বাল্মীকি-রামায়ণের স্থান-কালক্রম ও সমাজ

লেখক: পার্শ্বনাথ রায়চৌধুরী

মূল্য: ৭৫.০০

প্রকাশক: লোক সেবা শিবির/ মনফকিরা

বন প্রান্তর আশ্রম জনপদ গুহা নদী সমুদ্র নিয়ে রামায়ণের বর্ণনা এক মহাকালের যাত্রাপথ। এ সব যাত্রাপথের বর্ণনায় যখন পাওয়া যায় সমসাময়িক বাস্তবতা, কাব্যের কল্পজগৎ ফিকে হয়ে আসে। বাল্মীকির বর্ণনায় আছে শাশ্বত জীবন আর সমাজ। হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য অনূদিত বাল্মীকি রামায়ণ ও পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত রামায়ণম্‌ বই থেকে তথ্য ও উদ্ধৃতি নিয়ে মহাকাব্যের স্থান-কাল ও সেই সমাজের সন্ধানী হয়েছেন লেখক। ভারত ভূখণ্ডের এক আদিকালের পর্যটন এই রামায়ণী কাব্যগাথায়, যেখানে আছে বিশ্বাস, অনুমান আর সময়ের কাছে সমর্পণ। আর এই খোঁজই হয়ে ওঠে মহাকাব্যের প্রাণশক্তি। অযোধ্যা, লঙ্কা, মিথিলা; গঙ্গা, গোমতী, সরযূ, গোদাবরী নদী; চিত্রকূট পর্বত— এমন কত বাস্তবভিত্তিতে গড়ে উঠেছে বাল্মীকির বর্ণনা। কাব্যসূত্রের সংযোগসাধনেই এই বইয়ের ভিত্তি গড়ে উঠেছে। রামায়ণের বর্ণনায় সংঘাত ও আদানপ্রদানের যে সূত্র তাতে প্রাচীন ভারতের সমাজধর্মের আভাস পাওয়া যায়। আলোচনায় আর্যসমাজ, বানরসমাজ ও রাক্ষসসমাজের যে উল্লেখ তা-ও সে যুগের মানুষের সমাজ-সাংস্কৃতিক পর্যালোচনা। জীবিকাকেন্দ্রিক যে বিভাজন সে সময়ের কাব্যে আছে, সে সব ঐতিহ্য নিঃসন্দেহে ভারতীয় পরম্পরারই সাক্ষ্য বহন করে।

ভূষণ্ডী রামায়ণ/ পাকুড়-রাজ পৃথ্বীচন্দ্র বিরচিত

সম্পাদক: সৌরভ বেরা

মূল্য: ১৫০.০০

প্রকাশক: রাঢ় প্রকাশন

পৃথ্বীচন্দ্র ত্রিবেদী আঠারো শতকের শেষ দিকে বর্তমান ঝাড়খণ্ডের পাকুড়ের জমিদার ছিলেন। গৌতম ভদ্র ভূমিকায় এই রামায়ণ রচয়িতাকে ‘পাকুড়ের মোগলাই জমিদার বংশের সন্তান’ বলেছেন। ভূষণ্ডী রামায়ণ-এর রচনাকাল ১৮৩২। ‘বীরভূমি’ পত্রিকায় ১৩০৯ বঙ্গাব্দে তা প্রথম মুদ্রিত হয়। এই পাকুড়রাজের রাম-গুণগান স্বাভাবিক, কিন্তু নাম হল ‘ভূষণ্ডী রামায়ণ’। কবির ভাষায়, ‘রঘুনাথ পাদপদ্ম করিয়া বন্দন।/ ভাষায় রচায়ে সে ভূষণ্ডী রামায়ণ।।’ নামের মতো এই আখ্যানও প্রচলিত রামায়ণের থেকে স্বতন্ত্র। তরুণ সম্পাদক কাব্যটি গ্রন্থবদ্ধ করেছেন ভূমিকা ও পরিশিষ্ট সহ। ভূষণ্ডী কাক এই কাব্যের কল্পচরিত্র হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিয়েও আদতে প্রেক্ষিত ঘুরে যায় অন্য দিকে। এই রামায়ণের কাঠামোর বিন্যাস শক্তিতত্ত্ব প্রচারের আখ্যানের সঙ্গে মিলে যায়। মূল কাব্যের সূত্রপাতে কাকের রেখাচিত্র থাকলেও— রানি চিত্রকর ও শ্যামসুন্দর চিত্রকরের আঁকা পাতায় পাতায় রেখাঙ্কন কাব্যপাঠকে আকর্ষণীয় করেছে, যেমন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ‘গৌরীমঙ্গল’ রচনা সংযোজন পৃথ্বীচন্দ্রের পুথির সংযোগসূত্রের সহায়ক হয়েছে। রামায়ণের কথা ও নমনীয়তার জোর কাব্য-ইতিহাসের বহু ধূসর এলাকাকে আলোকিত করেছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement