প্রবর্তক: ব্রাহ্ম সভার প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহন রায়
উনিশ শতকের বাংলার ইতিহাসচর্চার বিশেষজ্ঞ হিসেবে ব্রায়ান হ্যাচার বহু দিনের পরিচিত নাম। বিদ্যাসাগরকে নিয়ে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বই ছাড়াও, বেশ কয়েক বছর ধরে সেই সময়ের হিন্দুত্ববাদের ধারার চর্চার ক্ষেত্রে চিন্তাশীল মতামত পেশ করেছেন হ্যাচার। তাঁর একলেক্টিসিজ়ম অ্যান্ড মডার্ন হিন্দু ডিসকোর্স বইয়ে আধুনিকতা আর হিন্দুত্ববাদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন একটি জটিল তাত্ত্বিক বিন্যাসের সাহায্যে। সেখানে এক দিকে রয়েছে ‘সিনক্রেটিজ়ম’ আর অপর দিকে ‘একলেক্টিসিজ়ম’; এই দুইয়ের টানাপড়েন থেকে বেরিয়ে আসছে এমন এক হিন্দুত্ববাদ-চিন্তা, যা ক্রমাগত ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং এক ধরনের নব্য গুরুবাদের ধারাকে প্রতিষ্ঠা দেয়। বলা যেতে পারে, এই স্বকীয় চিন্তার সূত্র ধরেই রামমোহন, দয়ানন্দ সরস্বতী বা বিবেকানন্দের মতো হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যাকারদের আবির্ভাব। বছর কয়েক পরে লেখা হ্যাচারের আর একটি বই বুর্জোয়া হিন্দুইজ়ম, অর দ্য ফেথ অব দ্য মডার্ন বেদান্তিস্টস— এখানে হ্যাচার হিন্দু ধর্মের সঙ্গে আধুনিকতার সম্পর্ক আলোচনা করেছেন খুঁটিয়ে। ‘সভ্যদিগের বক্তৃতা’ নামে উনিশ শতকের গোড়ার দিকের একটি সন্দর্ভ নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে বিচার করে দেখাচ্ছেন, কী ভাবে নব্য বেদান্তচর্চার কেন্দ্রে রয়েছে এক ধরনের বুর্জোয়া ‘ভদ্রলোকি’র ধারণা, যা কিনা পরবর্তী ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মের আধুনিক রূপ কেমন হবে তাকে নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে অনায়াসেই।
আজকের আলোচনার বিষয় যে বই, তা যেন এই বিতর্কের পরের ধাপ। এখানে হ্যাচার দেখাতে চাইছেন, কী ভাবে আধুনিকতা আর হিন্দুত্বের এই সেতুবন্ধনে চাপা পড়ে গিয়েছে আরও কিছু জরুরি আখ্যান, হিন্দুত্ব চিন্তার কিছু বয়ান, যা নিয়ে প্রচলিত ইতিহাসের পাতায় খুব বেশি আলোচনা হয়নি কখনওই। অথচ, অন্তরালে রয়ে গিয়েছে বলেই সেগুলো হারিয়ে যায়নি, পরবর্তী সময়ে ফিরে এসেছে এমন রূপ ধরে, যাকে মিলিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না ‘আধুনিক’ হিন্দুত্বের পরিচিত ব্যাখ্যার সঙ্গে।
বইয়ের শুরুতেই তাঁর সন্দর্ভের ঐতিহাসিক এবং তাত্ত্বিক পরিসর নির্দিষ্ট করে দিচ্ছেন হ্যাচার। ঠিক কোন প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করছেন তিনি হিন্দুইজ়ম বিফোর রিফর্ম বইয়ে? লেখকের চর্চা মূলত দু’টি ধর্ম সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে: ব্রাহ্ম ধর্ম আর স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায়। যদিও এই দুই সম্প্রদায় তাদের জন্মলগ্নের নিরিখে প্রায় সমসাময়িক, ঔপনিবেশিক সময়ের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিচারে এই দুইয়েরই চলাচল বিশ্বব্যাপী এবং রাজনীতির বিচারে গুরুত্বপূর্ণ, তবুও কেন ইতিহাসচর্চার কাঠামোয় এদের পাশাপাশি রেখে আলোচনার প্রেক্ষিত তৈরি হয়নি, এই বইয়ে সেটাই ভেবে দেখার চেষ্টা করছেন হ্যাচার। ‘এখন’ আর ‘তখন’-এর ‘ক্রোনোটোপ’-এর ভিতর থেকে এই প্রশ্নকে সমস্যায়িত করার চেষ্টা করছেন লেখক। ব্রাহ্ম ধর্মের জন্ম যে বাংলায়, তা উপনিবেশের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে অবস্থিত, উনিশ শতকের ভারতে ধর্ম-আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তিগুলোর অন্যতম বলা যেতে পারে। সেই তুলনায় স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায় উপনিবেশের সে সময়ের গতিপ্রকৃতির নিরিখে প্রায় প্রান্তিক গুজরাতের এক অংশে নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করছে। অর্থাৎ, জন্মলগ্নের বিচারে এবং উনিশ শতকের প্রেক্ষিতে সমকালীন ধর্ম, আধুনিকতা বা বহুত্ববাদের আলোচনায় ব্রাহ্ম ধর্ম যেন বেশ কিছুটা এগিয়ে ছিল। আবার, আজকের ধর্ম আর রাজনীতির যে আলোচনার পরিসর, সেখানে স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায়ের উচ্চগ্রামের হিন্দুত্ববাদ এবং বিশ্বব্যাপী চলাচলের ব্যাপ্তির তুলনায় ব্রাহ্ম ধর্ম নেহাতই অপস্রিয়মাণ, বলা যেতে পারে ইতিহাসের স্মৃতিতে নিক্ষিপ্ত প্রান্তিক উপস্থিতি। গুরুত্ব আর বিচারের এই তারতম্য উপনিবেশের ইতিহাসচর্চার অন্দরে যে জট তৈরি করে, সেটাকেই তাঁর এই বইয়ের মূল সমস্যা হিসেবে তুলে ধরেছেন হ্যাচার। তাঁর মতে, ধর্মকেন্দ্রিক এই চলাচলের ইতিহাসকে একসঙ্গে পড়তে গেলে একটা নতুন তত্ত্ব-কাঠামোর প্রয়োজন, যা কিনা আমাদের প্রচলিত ধর্ম-ইতিহাসচর্চার ধারা থেকে খানিকটা পৃথক। ঠিক কেমন হবে সেই ধারা, তা নির্দিষ্ট করে বলে দেননি লেখক, তবে চিন্তার কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ সূচক আমাদের ধরিয়ে দিয়েছেন এই সন্দর্ভে।
হিন্দুইজ়ম বিফোর রিফর্ম
ব্রায়ান হ্যাচার
৬৯৯.০০
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
উপনিবেশের ইতিহাসচর্চার ধারা, এবং তার সঙ্গে ধর্মের ইতিহাসের একটা কাঠামো তৈরি করে নেওয়ার চেষ্টা বিদ্যাচর্চার পরিসরে চেনা ছক। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে রয়েছে ‘রিফর্ম’ বা সংস্কারের ধারণা। এই সংস্কারের ধারণা আবার প্রোথিত রয়েছে ‘মডার্নিটি’ বা ‘প্রোগ্রেস’ জাতীয় কিছু নির্দিষ্ট আলোকপ্রাপ্তির ছকের ভিতরে। আর এই সমগ্র প্রকল্পে আপাতদৃষ্টিতে অদৃশ্য অথচ অমোঘ ভাবে উপস্থিত সাম্রাজ্যের স্থায়ী প্রতর্ক। এই কারণেই ধর্মচর্চার এই সংস্কারধর্মী প্রকল্পকে হ্যাচার নাম দিচ্ছেন ‘এম্পায়ার অব রিফর্ম’। অর্থাৎ কিনা কেমন ধর্ম-আলোচনা প্রাসঙ্গিক, কোন ধর্মচর্চার ধারা আলোকপ্রাপ্তির ছক অনুসরণ করল, আদতে কোন ধর্মের ধারণা আধুনিকতার অনুসারী এবং এই সমগ্র প্রকল্পের নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ— এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু রয়েছে সেই রিফর্মের ধারণার ভিতরে। অর্থাৎ হিন্দু ধর্মের নিরিখে যে সংস্কারের প্রকল্প যত বেশি সংশোধনবাদী, ইতিহাসের ধারা যেন তাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছে বলে প্রতিভাত হয়। এই বইয়ে সংস্কারের এই ধারণাকেই পরতে পরতে বিনির্মাণ করতে চেয়েছেন লেখক। তাই বইয়ের শিরোনামে ‘বিফোর’ কথাটা গুরুত্বপূর্ণ— সংস্কারের ধারণার পূর্বে। সেই জন্যেই হয়তো প্রচলিত ইতিহাস রচনায় ধর্মচর্চার যে ধারা সাধারণ ভাবে আধুনিক ভারতে অনুসৃত হয়ে এসেছে, সেই ধাঁচার বাইরে বেরোতে চেয়েছেন লেখক। ব্রাহ্ম ধর্ম আর স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায়কে দুটো ‘পলিটি’ বা সমাজবিধি হিসেবে পড়তে চাইছেন হ্যাচার, যা কিনা প্রচলিত ডিসকোর্সের বাইরে, যাতে এই দুই সম্প্রদায়কে রিফর্ম বা সংস্কারের আঙ্গিকের বাইরে গিয়ে বিচার করা যায়। হ্যাচারের মতে এই চর্চা গুরুত্বপূর্ণ, কেননা যদিও বা উনিশ শতকের গোড়া থেকে বহু দিন ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে ব্রাহ্ম সমাজ ছিল ‘দ্য পাবলিক ফেস অব হিন্দুইজ়ম’, আজকের উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রচিন্তার নিরিখে কিন্তু স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায় ক্রমাগত হয়ে উঠেছে ‘দ্য নিউ ফেস অব হিন্দুইজ়ম’। হিন্দুত্বের এই ক্রমশ বদলে যাওয়া আঙ্গিককে যদি আমরা আধুনিক ভারতে ধর্মের ইতিহাসচর্চার কাঠামোর বাইরে রেখে দিই, যদি একবগ্গা সংস্কারকেন্দ্রিক প্রচলিত আলোকপ্রাপ্তির সহজ আখ্যানকেই শুধুমাত্র স্বীকৃতি দিয়ে চলি, তবে তা হবে অবিমৃশ্যকারিতার নামান্তর, পাঠের রাজনীতির ঠগবাজি। ইতিহাস লেখা হবে এক রকম, তবে হকিকতের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যাবে না কিছুতেই। অতএব, এই বইয়ে কী করতে চলেছেন হ্যাচার, তা তিনি আলোচনার শুরুতেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন— “স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায় এবং ব্রাহ্ম সমাজের মতো গোষ্ঠীকে সীমাবদ্ধ ডিসকোর্স এবং রিফর্মের নিয়ম থেকে বার করে আনা। সেই সঙ্গে ধর্মীয় সমাজবিধি হিসেবে তাদের উত্থানের পুনর্বিবেচনাই রিফর্ম পূর্ববর্তী হিন্দুত্ববাদের কেন্দ্রীয় লক্ষ্য।” এই প্রসঙ্গে বইয়ের ভূমিকায় মার্থা নুসবম-এর দ্য ক্ল্যাশ উইদিন গ্রন্থের কঠোর অথচ প্রাসঙ্গিক এবং নির্লিপ্ত সমালোচনা পাঠককে বুঝতে সাহায্য করে হ্যাচারের প্রকল্পের নির্দিষ্ট প্রকৃতি। ভারতে ধর্মের ইতিহাসচর্চার বিষয়ে প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ হ্যাচারের এই সাম্প্রতিক বই।