এ আত্মকথন তাঁরও, তাঁর দেশেরও

পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংকট তখন তুঙ্গে: ১৯৭০ সাল। গোটা সমাজ যেন মড়মড় করে ভাঙছে। কিন্তু— সমাজ ভাঙছে মানে কি কেবলই পরাধীনতার যন্ত্রণা আর অত্যাচার, আর কিছু নয়?

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৭ ০০:০০
Share:

অন্তরঙ্গ: পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

Advertisement

বিপুলা পৃথিবী

লেখক: আনিসুজ্জামান

Advertisement

মূল্য: ৮০০.০০

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংকট তখন তুঙ্গে: ১৯৭০ সাল। গোটা সমাজ যেন মড়মড় করে ভাঙছে। কিন্তু— সমাজ ভাঙছে মানে কি কেবলই পরাধীনতার যন্ত্রণা আর অত্যাচার, আর কিছু নয়? যতই দুঃসময় হোক, তারও তো কিছু আলোআঁধারি থাকে? নৈরাজ্যেও তো এক রকম স্বাধীনতা হয়? বেনিয়মেও তো রসিকতা হয়? ছিল সে সব। এই যেমন, দেশ যখন সংকটে থরোথরো, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীদের ‘স্বাধীনতা’ কিন্তু তখন আক্ষরিক অর্থে শিখরচুম্বী! পড়াশোনা শূন্য। পরীক্ষা নামকাওয়াস্তে। নিয়মকানুন চুলোয়, প্রতি বছর গণপরীক্ষা। গণপরীক্ষার ফলও দারুণ সন্তোষজনক: ‘অত উচ্চহারে পাশ এর আগে আর দেখা যায়নি, সাধারণ পরীক্ষার্থীরা বেশ স্বাধীনভাবে পরীক্ষা দিয়েছে।’ ‘স্বাধীনতা’য় বাধা পড়লে পরীক্ষার্থীদের ক্ষোভও ‘আন্তরিক’ আকার নিয়েছে। একটি ঘটনা মনে করা যাক। পরীক্ষা চলাকালীন পরীক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে শৌচাগারে যাচ্ছে একটি ছাত্র, সেখানে আগে থেকেই গুছিয়ে রাখা আছে বইপত্র, টের পেয়ে তত্ত্বাবধায়ক তাকে ধরে আনার জন্য পিয়ন পাঠিয়েছেন, পিয়ন গিয়ে বাথরুমের দরজায় ধাক্কার পর ধাক্কা মেরে তাকে বার হতে বাধ্য করছে, আর ছেলেটি গজগজ করতে করতে বেরিয়ে আসছে: ‘গোলমালে গোলমালে সারা বছরটা কেটে গেল, এখন যে একটু পড়াশোনা করে পরীক্ষা দেব, তারও উপায় নেই!’ —সব ছাত্রদেরই রাগ-অভিমান করতে হয়নি অবশ্য। শিক্ষকরা তাদের ‘স্বাধীনতা’য় মন খুলে ‘সহযোগিতা’ই করতেন! কঠিন সময়ে কিছু কাজ সহজ না করে দিলে চলে!

বেশ একটা অন্য ইতিহাসের ইশারা এখানে। সংকটকালের মধ্যেও রস-রঙ্গের প্রবহমানতা যে জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে, সেই ইতিহাস। আনিসুজ্জামানের আত্মজীবনীমূলক আখ্যান বিপুলা পৃথিবী পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিল, বইটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এখানেই। ইতিহাসের এতগুলো পরতকে অবলীলায় একসঙ্গে ছড়িয়ে দেখাতে পারলেন তিনি। পড়তে গিয়ে কোথাও বাধা পেতে হয় না, ঘটনাভারে অবনত হতে হয় না, বয়ে চলে আখ্যান কখনও কষ্টে, কখনও হাসিতে, কখনও হতাশায়, কখনও আশায়। মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পরের সময়টায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস তো কতই পড়েছি আমরা। কিন্তু ভিতর থেকে গভীর দুঃসময়ের কথা বলতে বলতেই আবার কয়েক পা সরে গিয়ে বাইরে থেকে দেখার স্পষ্টতা, এবং উপর থেকে দেখার নির্মোহতার এমন মিশেল বেশি দেখিনি।

আগে লিখেছেন আত্মজীবনীর দুই পর্ব কাল নিরবধি এবং আমার একাত্তর। তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে এ বারের বইটিকে ট্রিলজির শেষ খণ্ড বলা যায়। মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পর থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এর যাত্রাকাল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে ছিলেন তিনি। ফিরে গেলেন যখন, তার পর পরই রাওয়ালপিন্ডির কারাগার থেকে শেখ মুজিব মুক্তি পেলেন। এ দিকে কলকাতা-প্রত্যাগত শিক্ষক আনিসুজ্জামান সদ্যোজাত বাংলাদেশে এসে জানতে পারছেন, যুদ্ধের বীভৎসতায় ইতিমধ্যে কত স্বজন কত বন্ধু হারিয়ে গিয়েছেন, বন্ধুর কবরের পাশে বসে কেঁদে ফেলছেন, শুনছেন কেবল শার্ট দেখে সহকর্মীর বিকৃত লাশ শনাক্ত হচ্ছে, মুনীর চৌধুরীর মতো বিদ্বজ্জনের দেহ খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। চলছে অবাধ লুঠপাট, কেবল পাকিস্তানি সেনাদের লুঠ নয়, ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয় দিয়েই মর্মান্তিক লুণ্ঠনকার্য ঘটাচ্ছে কত গুন্ডার দল। পড়তে গিয়ে যেই-না আমাদের বোধ অসাড় হওয়ার জোগাড়, অমনই আবার লেখক মোচড় খাইয়ে আমাদের ফিরে তাকাতে বাধ্য করেন সামনের দিকে। সামনে তখন কত কিছু হচ্ছে। নতুন দেশের পতাকা তৈরি, নতুন সংবিধান রচনা। শোক-যন্ত্রণা কি আর ইতিহাসকে স্তব্ধ করে দিতে পারে? কী হবে নতুন দেশের জাতীয় সংগীত? ঢাকার বাংলা একাডেমির পরিচালক কবীর চৌধুরী জানালেন, রবি ঠাকুরের ‘সোনার বাংলা’ গানটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। পুরো গান নয়, গানটির প্রথম দশ চরণ। আনিসুজ্জামান জানলেন, পরামর্শদাতা কমিটিতে তাঁরও থাকার কথা ছিল, ঘটনাচক্রে থাকা হয়নি। এত বড় একটা সিদ্ধান্তের অংশভাগী হতে পারলেন না? ইতিহাস-বঞ্চিত হলেন? দুঃখ হয়তো কিছু কমল যখন ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডাক পেলেন নবজাত দেশের সংবিধান তৈরির কাজে। সংবিধানের ইংরেজি খসড়া করবেন কামাল হোসেন, বাংলায় অনুবাদ করতে হবে তাঁকে। ‘একটা অনাস্বাদিত শিহরন জাগল দেহে মনে, এই আমার স্বাধীন দেশ, তার সংবিধান রচনার কাজে হাত দিয়েছি।’ পড়তে গিয়ে আমাদেরও গায়ে শিহরন। জানতে পারি, সংবিধানের বিষয়ে পরামর্শ দিতে বঙ্গবন্ধু দুই বার ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁদের, প্রথম বক্তব্যই ছিল, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির সংযোগ ছিন্ন করার একটা বিধান রাখতে হবে সংবিধানে! রাখা হল তা। সঙ্গে সঙ্গে বিরুদ্ধতাও হল। বিতর্কিত ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ নিয়ে কেউ কেউ প্রবল তর্ক তুললেন, বললেন, মুসলমান হিসেবে এক অখণ্ড জীবনবিধানের অধীন তাঁরা, বাংলাদেশ ধর্মরাষ্ট্র যদি বা না-ও হয়, ধর্মকে রাজনৈতিক বা আইনগত পরিসর থেকে পুরোপুরি সরিয়ে রাখা যাবে না। শেষ পর্যন্ত কিন্তু বিরুদ্ধবাদীরাই হার মানলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের মত মেনে মুজিব-নির্দেশিত ১২ নম্বর ধারা থেকে গেল, রাজনীতি থেকে ধর্ম সংবিধান-মতে বাদ পড়ল!

নতুন দেশ তৈরি মানে নতুন মানুষ তৈরির কাজও বটে। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে যখন শিক্ষা কমিশন তৈরি হল, লেখকও তার সদস্য হলেন। তাঁর প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু সাফ বলে দিলেন, উপযুক্ত নাগরিক তৈরির উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার কথা ভাবুন বিশেষজ্ঞরা। ‘আমি ধার করে হোক, ভিক্ষা করে হোক, টাকা জোগাড় করব।’ লেখক ধরিয়ে দিয়েছেন, কমিশনের প্রকাশিত রিপোর্টে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এই কথাগুলি নেই, বরং ঠিক উল্টো কথাই আছে, ‘সীমিত সম্পদের’ কথা বলা আছে!

বইটি পড়তে গিয়ে মনে হয়, একটা দেশের বর্তমান দৃশ্যমান রূপ তো তার সবটা বলে না! সে যা হতে চেয়েছিল কিন্তু পারল না, সে কথাগুলো অনেক সময় আমাদের চেনাপরিচিত পরিপার্শ্ব থেকে হারিয়ে যায়। এই ধরনের আখ্যান-ইতিহাস খুঁজে আনে ওই হারিয়ে যাওয়া সম্ভাবনাগুলো। বলে দেয়, কী হতে পারত, কী হল না। সমস্যা হল, যতই বর্তমানের কাছাকাছি, তত যেন একটু করে কমে যায় হারিয়ে-যাওয়া বিকল্পের খোঁজগুলি। বইটির প্রথম আর শেষ দিকের মধ্যে তাই কিছু অসমঞ্জসতার আভাস।

আত্মজীবনী, তাই অন্তরঙ্গ ঘটনাবলিও জানা যায় অনেক। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও তাঁর একাধিক আলাপের ঘটনা। আর লেখকের নিজের সারস্বত জীবন। সে জীবন কিন্তু তাঁর দেশের জীবনের সঙ্গেই বাঁধা। নতুন দেশের প্রতিনিধিত্ব শুরু করলেন তিনি দেশেবিদেশে, আন্তর্জাতিক প্রজ্ঞাভুবনে। প্রাথমিক অনিশ্চিতি আস্তে আস্তে এসে পৌঁছল আত্মপ্রত্যয়ে। ব্যক্তিগত আখ্যান মিশে গেল দেশের স্বাধীন সত্তা তৈিরর ক্রমবিকাশমান ইতিহাসের সঙ্গে। তাই এই বই বাংলাদেশের আত্মজীবনীও বটে। দুর্ভাগ্য, সৌভাগ্য, বিষাদ, কৌতুক, জীবনের সব কয়টি সুর বাজছে এর পাতায় পাতায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement