ভাঙা-গড়া: অসমের ব্রহ্মপুত্র নদী উপত্যকার চরে নতুন করে বসতি স্থাপনের কাজ চলছে।
চর-কথা/ ব্রহ্মপুত্র নদী উপত্যকা
সম্পাদক: প্রসূন বর্মন ও গোর্কি চক্রবর্তী
৪০০.০০
গাঙচিল
অসমের প্রসিদ্ধ চরভূমি মাজুলিকে অনেকে বলেন, তেপান্তরেরও ওপারের দেশ। ‘চর-কথা’ পড়লে বোঝা যায়, কথাটা ব্রহ্মপুত্র নদের বারোশোর বেশি চরভূমির ক্ষেত্রেই সত্যি, এবং তা যত না ভৌগোলিক দূরত্বের ইঙ্গিতবাহী, তার চেয়ে বেশি মানসিক ব্যবধানের।
প্রতিটি নদীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা চরের ওঠাপড়া ভাঙাগড়া নিয়ে তৈরি হয় অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের জটিল কার্যক্রম। ভূবিজ্ঞান বলে, পৃথিবীর অধিকাংশ চরই সতত বিপন্ন। অথচ নানা অনিবার্য তাগিদে মানুষ বিপদ উপেক্ষা করেই চরে বাসা বাঁধে। নিছক ভৌগোলিক পরিসরের তক্মা ঝেড়ে ফেলে চরও হয়ে ওঠে মানবিক পরিসর। কিন্তু বাস্তবে চর মানেই এক অপ-ভূমি।
আর সেই চর যদি হয় শক্তিশালী ব্রহ্মপুত্র নদের জটিল এবং সতত পরিবর্তনশীল ব-দ্বীপ শৃঙ্খলার অংশ, তা হলে তো কথাই নেই। ভূতাত্ত্বিকরা বলেন, ষোড়শ, সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে হয় বন্যা আর না হয় ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় এই ব-দ্বীপ শৃঙ্খলার স্থিতিকে দুর্বল করে দিয়েছিল। আড়াইশো বছর পরে ১৯৫০ সালে এল ভূমিকম্পের আঘাত। এইসব বিপর্যয়ের প্রকোপে বারবার নদীখাতে পরিবর্তন এসেছে। ফলে কয়েকশো বছর ধরেই প্রতি মুহূর্তে এখানে চলছে চর ভাঙা-গড়ার খেলা। তবু পাহাড়ি অঞ্চল ছেড়ে, দেশের মধ্যের উঁচু জমি ছেড়ে, জন্মভূমি, কর্মভূমি ছেড়ে ব্রহ্মপুত্রের নানান চরে বাসা বেঁধেছেন বহু মানুষ। কেউ এসেছেন পুরনো বাসভূমির জীবিকা হারিয়ে, কেউ রাজরোষ থেকে বাঁচতে, কেউ দারিদ্র থেকে মুক্তির আশায়। অচিরেই তাঁরা বুঝেছেন, চরভূমি আসলে এক না-দেশ, নেই-এর রাজ্য।
২৮০ পৃষ্ঠার বইতে ২৬৩ পৃষ্ঠা জুড়েই সেই নেতির স্বাক্ষর। শুরুর প্রসঙ্গ-কথা ছাড়া, চৌদ্দোটি প্রবন্ধ জুড়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বুকে ছড়িয়ে থাকা চরভূমির নানা সমস্যা উঠে এসেছে লেখাগুলোর মধ্যে। লেখাগুলোর মূল ঝোঁক আর্থ-সামাজিক, সাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর বিশ্লেষণ। তার মধ্যেও অনেকখানি জায়গা জুড়ে ধরা হয়েছে চরবাসীদের জাতিগত ধর্মীয় এবং ভাষাগত পরিচিতি নিয়ে সমস্যা, নাগরিক অধিকার বা অধিকারহীনতা, স্থানীয় বাসিন্দা বনাম অভিবাসী মানুষদের দ্বন্দ্ব, রাজনীতির কূটকচালিতে বাসস্থান আর জীবিকার সমস্যা।
স্থানীয় বাসিন্দা বনাম অভিবাসী মানুষদের দ্বন্দ্ব ভারতের প্রায় সর্বত্রই আছে। কিন্তু অসমে এই সমস্যার যে প্রকৃতি এবং জটিলতা তা বোধহয় তুলনাহীন। পুব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ সব দিক থেকেই নানা জাতি নানা ভাষা নানা ধর্মের মানুষ এসে অসমে বসতি স্থাপন করেছে। সপ্তম শতাব্দীতে শুরু হওয়া এই অভিবাসন প্রক্রিয়া দ্বাদশ শতাব্দী থেকে গতি পেয়েছে অহোম রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর। ষোড়শ শতাব্দী থেকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কারণে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা হয়ে উঠেছে অভিবাসীদের এক অভীষ্ট গন্তব্য।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত অভিবাসীদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের ছিল পারস্পরিক নির্ভরতার ভিত্তিতে অবৈরিতার সম্পর্ক। এক ধরনের সমন্বয় প্রক্রিয়াও চলছিল এই সময় জুড়ে। কিন্তু ১৮২৬ সালে ব্রিটিশরা অহোম রাজকে পরাস্ত করে অসমে নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে এই ভূমিতে বসবাসকারী নানা সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে জটিলতা তৈরি হতে শুরু করল। তার একটা বড় কারণ অর্থনৈতিক। ব্রহ্মপুত্রের সুফলা উপত্যকায় আস্তে আস্তে নানা ধরনের ব্যবসায়িক পণ্যের চাষ আর জঙ্গল পরিষ্কার করে কাঠের ব্যবসা শুরু হল। শুরু হল বিভিন্ন ধরনের কারিগরি কর্ম। এই সব কাজে স্থানীয় মানুষদের আগ্রহ আর দক্ষতার অভাবে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিক আনার ঠিকাদারি ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠল। আর কৃষির ভরকেন্দ্র ব্রহ্মপুত্রের মূল উপত্যকা থেকে সরে গেল অসংখ্য চরভূমিতে। আর তারই প্রতিফলন ঘটল প্রশাসনিক আর সামাজিক সন্দর্ভগুলিতে নতুন নতুন শব্দের আমদানিতে— চরুয়া, পমুয়া, ময়মনসিঙিয়া।
বিশ শতকে এই উপত্যকায় বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার সম্পর্ক তৈরি হল। পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর ছায়া ফেলতে লাগল অবিশ্বাসের কালো মেঘ। আরও একগুচ্ছ নতুন শব্দবন্ধ তৈরি হল— বহিরাগত, ন-অসমিয়া, মিঞা। এর পাশাপাশি চলতে লাগল তৎকালীন অসম সরকারের নানা ধরনের প্রশাসনিক পদক্ষেপ। দুটি উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা ছিল জনজাতি গোষ্ঠীর জন্যে সংরক্ষিত এলাকা, আর লাইন প্রথা। এই সব ব্যবস্থায় সমস্যার নিরসনের চেয়ে তার জটিলতাই বরং অনেকটা বেড়েছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যেই অসমে শুরু হয়ে গেছে গোষ্ঠীগত আন্দোলন সংঘাত সংঘর্ষ এবং রাজনৈতিক চাপানউতোর আর প্যাঁচপয়জার। এই অস্থির সময়ের অবদান গভীর রাজনৈতিক ব্যঞ্জনায় পুষ্ট তিনটি শব্দ—অনুপ্রবেশকারী, বিদেশি আর সন্দেহজনক ভোটার। এই শব্দ তিনটিকে ঘিরে কত না রাজনৈতিক ধুন্ধুমারের সাক্ষী আমরা। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, এই তিনটি অভিধায় চিহ্নিত মানুষের অধিকাংশই এখন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চরবাসী, এবং সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সর্ব অর্থেই প্রান্তিক, নিপীড়িত।
প্রতিবেশী রাজ্যের চরবাসীদের সমস্যাগুলোকে বাঙালি পাঠকের সামনে তুলে ধরে সম্পাদকেরা আমাদের জন্যে একটা উদাহরণ তৈরি করলেন।।