সৌর মণ্ডলের নিয়ম অনুযায়ী শেষ হল আরও একটি বছর। ২০১৫ পেরিয়ে সবে আমরা ২০১৬-তে পা দিয়েছি। ফেলে আসা বছরটিতে বিশ্ব জুড়ে দেখা গিয়েছে নানা অর্থনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত, যার অনেকগুলিই ভারতের লগ্নিকারীদের অনুকূলে যায়নি।
ভারতে যখন সব মিলিয়ে সুদ কমেছে ১০০ বেসিস পয়েন্ট, তখন বছরের শেষ ভাগে মার্কিন মুলুকে সুদ প্রায় এক দশক বাদে বেড়েছে ২৫ বেসিস পয়েন্ট। সুদের এই পরিবর্তনে লোকসানই হয়েছে এ দেশের ছোট লগ্নিকারীদের। এক দিকে যখন সুদ কমেছে জমা প্রকল্পগুলিতে, অন্য দিকে তখন লোকসান হয়েছে শেয়ার সূচকেও। বছরের বেশির ভাগ সময়েই মাথা নত ছিল সকলের প্রিয় হলুদ ধাতুর। আশানুরূপ আয় হয়নি বন্ডের বাজারেও। শেয়ার বাজার ঝুঁকে থাকায় তেমন লাভের সন্ধান দিতে পারেনি ইকুইটি-নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ড প্রকল্পগুলিও।
গোটা বছরে সেনসেক্স খুইয়েছে ১৩৮৮ পয়েন্ট বা ৫.০৪ শতাংশ। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, গত বছরেই সেনসেক্স গড়েছিল সর্বকালীন রেকর্ড। ৪ মার্চ পেরিয়েছিল ৩০ হাজারের মাত্রা। তবে ওই উচ্চতায় অনেকেই হয়তো শেয়ার বিক্রি করে লাভ ঘরে তুলতে পারেননি। বছরের শেষে সেনসেক্স নেমে এসে দাঁড়ায় ২৬,১১৮ পয়েন্টে।
বিশ্ব অর্থনীতি দুর্বল থাকায় একনাগাড়ে কমেছে এ দেশ থেকে রফতানি। সংস্কার থমকে দাঁড়ানোয় বিশেষ করে জমি বিল এবং জিএসটি বিল পাশ না-হওয়ায় শিল্পও এগোয়নি আশানুরূপ গতিতে। মার্কিন শীর্ষ ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজার্ভ সুদ বাড়াতে পারে এই ইঙ্গিতে আগেভাগেই এ দেশ থেকে প্রস্থান করেছিল বিদেশি আর্থিক সংস্থার মোটা আকারের লগ্নি। এর ফলে টাকার সাপেক্ষে বেড়েছে ডলারের দাম। আঘাত এসেছে আমদানি-নির্ভর শিল্পের উপরেও। অশোধিত তেলের দাম কমলেও সব মিলিয়ে গত বছরটা আদৌ ভাল কাটেনি শিল্প, বাণিজ্য এবং শেয়ার বাজারের কাছে।
সঙ্গের সারণিতে দেওয়া হল ১৯৯০ সাল থেকে সদ্য শেষ হওয়া ২০১৫ সাল পর্যন্ত সেনসেক্সের পথ চলার খতিয়ান। উল্লিখিত তারিখে সেনসেক্স বাজার বন্ধের সময়ে যে-অঙ্ক টপকে গিয়েছে, সেই পরিসংখ্যানই তুলে ধরা হল এখানে।
এ বার অবশ্য সামনে তাকানোর পালা। গত বছর অনেক সময়েই বাজার বেশ ঝুঁকে ছিল। এই বাজার সুযোগ করে দিয়েছে কম দামে ভাল শেয়ার কেনার। শেয়ার বাজারের প্রকৃত লগ্নিকারীরা টাকা ঢালেন দীর্ঘ মেয়াদের জন্য। ছোট মেয়াদে উত্থান-পতন যেমনই হোক না-কেন, বড় মেয়াদে কিন্তু বাজার সব সময়েই ভাল মুনাফার সন্ধান দিয়েছে। সঙ্গের সারণিতেই দেখা যাচ্ছে ১৯৯০ সালে যে সূচক প্রথম বার ১০০০ অঙ্ক পেরিয়ে গিয়েছিল, তা কী ভাবে ২০১৫ সালে অর্থাৎ ২৫ বছরে পৌঁছে গিয়েছে ৩০ হাজারে। অর্থাৎ ২৫ বছরে সেনসেক্স বেড়েছে ৩০ গুণ।
তার মানে, যাঁরা বড় মেয়াদে ভাল শেয়ারে লগ্নি করেছেন, তাঁরা কিন্তু সব সময়েই মোটা মুনাফা ঘরে তুলেছেন। গত বছরের দুর্বল বাজারেও কোনও কোনও শেয়ার ভাল মুনাফার সুযোগ করে দিয়েছে। উদাহরণ দেওয়া যায় মারুতি-সুজুকি’র। গত বছর লার্জ ক্যাপ খারাপ করলেও বড় রকমের উত্থান হয়েছে মিড ক্যাপ এবং স্মল ক্যাপ শেয়ার সূচকের।
প্রশ্ন হল, ২০১৬ সালটা কেমন যাবে। নতুন বছরের ব্যাপারে সবাই না-হলেও অনেক বিশ্লেষকই বেশ আশাবাদী। এঁদের ধারণা, তৃতীয় ত্রৈমাসিকের পর থেকে কোম্পানি ফলাফলে উন্নতি দেখা যাবে। বিশ্লেষকরা নামও করেছেন বেশ কিছু শেয়ারের। ওই সব শেয়ার কেন বাড়তে পারে আগামী ১২ মাসে, তার কারণও দেখিয়েছেন।
যে যা-ই পরামর্শ দিক, শেয়ার কিনতে হবে সব কিছু বিবেচনা করে তবেই। ঝুঁকির দিক দেখে নিয়ে এগোতে হবে। গত বছরের শেষ দিনে এবং নতুন বছরের প্রথম দিনে বাজার সবুজে বন্ধ হয়েছে। অর্থাৎ আশা জাগিয়েই শুরু হয়েছে নতুন বছর। সুযোগ মতো লগ্নি করতে হবে মাঝারি থেকে বড় পতনে এবং তার পর অপেক্ষা করতে হবে উত্থানের জন্য। সংযত ভাবে লগ্নি করলে কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ফল মিলবে।
অর্থনীতির সব দিক বিশ্লেষণ করলে অবশ্য ২০১৬ সালে শেয়ার বাজারে বড় কোনও উত্থান হবে, এমন আশা এখনই করা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে সুপরিচালিত কিছু কোম্পানি ভাল করবে। অন্য অনেকেই হয়তো তেমন ভাল ফল উপহার দিতে পারবে না। এই কথা মাথায় রেখে শেয়ার বাছাইয়ের ব্যাপারে বেশ সতর্ক থাকতে হবে নতুন বছরে।
পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকলে আগামী ১২ মাসে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ২৫ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট সুদ কমাতে পারে। এতে বন্ডে লগ্নিকারীদের লাভ হলেও ব্যাঙ্ক-জমায় সুদ আরও কমতে পারে। এই কারণে কিছু টাকা ব্যাঙ্ক থেকে সরিয়ে বন্ডে লগ্নি করার কথা অবশ্যই ভাবা যেতে পারে। উঁচু হারে করদাতাদের জন্য এটি একটি ভাল লগ্নির জায়গা।
বাজারের এখন যা পরিস্থিতি, তাতে চোখ বুজে কোথাও লগ্নি করা ঠিক হবে না। বরং গোটা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে লগ্নি করলে তবেই এই বাজারে সাফল্য আসবে।