অর্থনীতিতে কি অনিশ্চয়তা কমার বদলে সংশয়ের ভূমি শক্ত হচ্ছে? সাম্প্রতিক যে সব সমীক্ষার ফল সামনে এসেছে তা দেখে কিন্তু এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আপাতত একটাই স্বস্তি। আগামী তিন মাস সুদের হার অপরিবর্তিত থাকছে বলে জানিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তাই সুদ নির্ভর অবসরপ্রাপ্তরা অন্তত কিছুটা হলেও উৎসবের মুখে আয় কমার আশঙ্কা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকবেন না।
একটু পিছিয়ে ভাবা যাক। অতিমারির শুরুতে ২০২০-র প্রথম ত্রৈমাসিকে বাজারের চাকা বন্ধ হওয়াটা মেনেই নিয়েছিলাম আমরা। মেনেছিলাম কারণ, চাকরি খোয়ানোর ভয়ের থেকেও প্রাণ বাঁচানোর তাগিদ ছিল অনেক বেশি। আর টিকা চালু হওয়ার পরে অর্থনীতিও ২০২১-২২ অর্থবর্ষে তার নিজের ছন্দে ফিরবে বলে সবাই আশার কথা শুনিয়েছিলেন। কিন্তু অক্টোবর-ডিসেম্বরের ত্রৈমাসিকের শুরুতেই যে সব সমীক্ষা সামনে আসছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে বাজারের ছন্দ ফিরে পেতে আরও বছর খানেক কেটে যেতে পারে।
আমরা যদি শুধু চলতি বছরের শেষে জাতীয় উৎপাদনের বৃদ্ধির হারের পূর্বাভাসের দিকে চোখ রাখি তা হলে দেখব যে কেউ তাদের পূর্বাভাসে আশার আলো দেখিয়ে আর্থিক বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছে। যেমন বণিক সভা ফিকি। উল্টোদিকে কেউ কেউ আবার তাদের প্রাথমিক অবস্থান থেকে সরে এসে বৃদ্ধির হার কমবে বলে মনে করছে। যেমন ফিচ।
কিন্তু ফিচ থেকে ফিকি বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সবার প্রক্ষেপকে সাজালে চলতি আর্থিক বছরের শেষে মোটের উপর ৮.৫ শতাংশ থেকে ৯.৫ শতাংশের মধ্যে জাতীয় উৎপাদনের বৃদ্ধির হার করা যায়। এটাও মাথায় রাখতে হবে যে ইতিহাস বলে অক্টোবর ত্রৈমাসিকে যে বৃদ্ধির হার বছরের শেষে হবে বলে আশা করা হয়, বছরের শেষে গিয়ে সেই হার তার থেকে কমই হয়।
বছরের শেষে গিয়ে কী হবে তা অন্য প্রশ্ন। কিন্তু আপাতত পাওয়া সমীক্ষার ফল যদি মেনে নেওয়া যায়, তা হলে দেশের অর্থনীতি এ বছরের শেষে টেনেটুনে ২০১৯-২০-এর আর্থিক পরিস্থিতি ফিরে পাওয়ার আশা করতে পারে। কারণটা বহু আলোচিত হলেও তাতে এক বার চোখ বুলিয়ে নেওয়া জরুরি। গত আর্থিক বছরে অতিমারির কারণে ৭.৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল অর্থনীতি। সেই সংকোচন অতিক্রম করে ২০১৯-২০ সালকে ছুঁতে অর্থনীতিতে ৮ শতাংশের একটু বেশি বৃদ্ধির প্রয়োজন। কিন্তু বিভিন্ন সমীক্ষার ফল মেনে নিলে এটা পরিষ্কার যে চলতি আর্থিক বছরে আমরা শুধু অতিমারির ঠিক শুরুর মুখের অর্থনীতিকে ছুঁতেই পারব। তার বেশি কিছু নয়।
মাথায় রাখতে হবে যে ২০১৯-২০ সালেও কিন্তু বৃদ্ধির হার খুব বেশি ছিল না। সরকারের হিসাবেই তা ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। কোভিডের সময়টাকে যদি মুছে ফেলি, তা হলে দেখব ২০১৯-২০ সালের আগের পাঁচ বছর ধরেই দেশের জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার ক্রমাগত পড়েছে। আর বেড়েছে বৈষম্য। কোষাগারও আরও নড়বড়ে হয়েছে। আর এই রকম পরিস্থিতিতে ভারতের আগামী অর্থনীতির ছবিটা রাজনীতির বাইরে পা রেখে কারুর দুশ্চিন্তার কারণ হলে তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না।
আমরা তো বিশ্বের অন্যতম আর্থিক শক্তি হতে চাই। হব নাই বা কেন? খাতায় কলমে আমাদের দক্ষতা বিশ্বের অন্যতম আর্থিক শক্তি হয়ে ওঠার পথে কোনও বাধাই নয়। প্রশ্নটা হল হতে পারিনি কেন! তার নানান ব্যাখ্যা আছে। যা এই আলোচনার অংশ নয়।
তবে ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছিলেন ২০২৪-২৫ সালে ভারত পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি হয়ে উঠবে। উল্লেখ্য ২০১৯ সালে ভারত ছিল তিন লক্ষ ডলারের অর্থনীতি। আর হিসাব বলছে চার বছরে অর্থনীতিকে বাড়িয়ে ওই জায়গায় নিয়ে যেতে গেলে জাতীয় উৎপাদনকে বাড়তে হবে অন্তত ১৩ শতাংশ হারে। আর ওই অর্থ বছর আমরা শেষ করেছিলা চার শতাংশ বৃদ্ধির হার নিয়ে!
রাজনীতি দাবি করে অসম্ভবকে সম্ভাবনার স্বপ্ন হিসাবে তুলে ধরতে বাস্তব যতই অন্য কথা বলুক না কেন। আর বাস্তবটা অর্থমন্ত্রককে সামলাতে হয়। আমরা সাধারণ ভাবে বাজারের খুঁটিনাটির দিকে নজর রাখি না। মাথায় থাকে না ডলারের তুলনায় টাকার দাম সম মানের অন্য অর্থনীতির মুদ্রার তুলনায় অনেক বেশি নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। গত সপ্তাহে টাকার দাম গত ছ’মাসের তুলনায় অনেক বেশি পড়েছে। সামনে রয়েছে বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দামের অনিশ্চয়তা আর আমেরিকার সরকারি ঋণপত্রের উপর সুদ বাড়ার সম্ভাবনা। এতে ডলারের চাহিদা বাড়ছে। টাকা আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় দেশে বিনিয়োগ টানা। কিন্তু ভোডাফোন এবং কেয়ার্নের উপর চাপানো কর ও তা নিয়ে ল্যাজে গোবরে হয়ে আমরা কিন্তু বিনিয়োগের গন্তব্য হিসাবে খুব একটা স্বস্তির জায়গায় নেই। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তা জানেন। আর জানেন বলেই ভুল শোধরাতে জি-২০ গোষ্ঠীর বৈঠকে যাচ্ছেন একগুচ্ছ প্রস্তাব নিয়ে। বিদেশি সংস্থার এ দেশে ব্যবসায় করা লাভের উপর সহজ কর ব্যবস্থা যার অন্যতম।
এতে কতটা চিঁড়ে ভিজবে তা ভবিষ্যতই বলবে। কিন্তু যে অঙ্কটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয় তা হল, চার থেকে পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বের অন্যতম আর্থিক শক্তি হওয়ার স্বপ্ন আকাশকুসুম।