কবিতার লাইনটা আমাদের প্রায় সকলের চেনা। ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব।’ পুজোর মুখে লেখাটা লিখতে গিয়ে সেই শব্দবন্ধই একটু অন্য ভাবে মনে এল। কারণ, পুজো-দীপাবলি-ক্রিসমাস ঘিরে কেনাকাটার যে হুজুগ চার পাশে দেখতে পাই, তাতে মনে হয়, সত্যিই কি এর পুরোটা প্রাণ চাইছে বলে কেনা? না কি একটা অংশ নিছক দেখনদারি? অনেক সময়েই দেখেছি, পকেট ফাঁকা। চোখ রাঙাচ্ছে ক্রেডিট কার্ডও। তবু অফুরান শপিং চলছেই। কাজ করছে ভয়— যদি পাশের বাড়ি হারিয়ে দেয়! কিংবা বেশি দামের ব্র্যান্ডের লেবেল আঁটা থাকে অফিসের সহকর্মীর শার্টে! আমার বক্তব্য, পুজোয় আনন্দ, কেনাকাটা, হুল্লোড়, ফূর্তি সব থাকুক। সারা বছর তো এই ক’টা দিনের জন্যই হাপিত্যেশ করে বসে থাকি আমরা। কিন্তু পুজো সমেত যে কোনও উৎসবেই সেই কেনাকাটা হোক মনের চাহিদা আর পকেটের মাপ বুঝে। পরের মাসে ক্রেডিট কার্ডের বিল দেওয়ার সময়ে চোখের জল ফেলে লাভ কী?
খরচ ক’ধরনের?
খরচ সাধারণত দু’রকম—
প্রয়োজনের
সংসার চালানোর জন্য এই খরচ করতেই হয়। যেমন— মাসকাবারি জিনিস কেনা, বিদ্যুৎ, ফোন, গ্যাসের খরচ, পরিচারক ও ড্রাইভারের মাইনে, ওষুধপত্রের খরচ ইত্যাদি। এগুলি পুজোর মাসেও বাদ দেওয়া যায় না।
কিছু বাড়তি ব্যয়ও আছে। তাকেও ঠিক অপ্রয়োজনীয় বলা চলে না। যেমন, পরিবারের লোকজন, আত্মীয়-স্বজনের জন্য পুজোর জামাকাপড় কেনা, পরিচারিকার বখশিস ইত্যাদি।
বেহিসেবি
এই খরচের তালিকায় সেগুলি থাকবে, যেগুলির প্রয়োজনই নেই। যেমন ধরুন, বিজ্ঞাপনে দেখলেন ৩০,০০০ টাকা দামের মোবাইলে ১০,০০০ টাকা ছাড়। দরকার না থাকলেও কিনে ফেললেন। বললেন, অনেক কম দামে পেয়েছেন। অথচ ভেবে দেখলেন না যে, এ জন্য আদতে আপনার পকেট থেকে গিয়েছে ২০,০০০ টাকা। যে খরচটা এই মাসে না করলেও চলত।
কেন কিনি?
সব মানুষই আবেগে চলেন। কারও মধ্যে সেই প্রবণতা বেশি। কারও কম। যাঁদের বেশি, তাঁরাই সাধারণত বেহিসেবি কেনাকাটার দিকে বেশি ঝোঁকেন। এঁদের মধ্যেও আবার কিছু ভাগ দেখা যায়। যেমন—
• কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা খুব বেশি ‘স্টেটাস কনশাস’। অর্থাৎ, কোথায় যাচ্ছি, কী খাচ্ছি, লোকে আমাকে নিয়ে কী বলছে, এই সব চিন্তা বেশি করেন। আর সেই অনুসারে জীবন যাপনের মানও ঠিক করেন। এঁদের কাছে অন্যদের প্রশংসার দাম অনেক বেশি।
• দ্বিতীয় ধরনের মানুষ কিছুটা হলেও উদ্বেগ এবং আবেগের বশে চলেন। ফলে কোনও কিছু কেনার ইচ্ছে হলে, তা আটকানোর মনের জোর তাঁদের মধ্যে কম দেখা যায়।
• আর তৃতীয় ভাগের ব্যক্তিদের মধ্যে হীনম্মন্যতা এবং নিরাপত্তাহীনতা বেশি দেখা যায়। তাই বেশিরভাগ সময়ে জিনিস কিনে মন ভাল করার প্রবণতাও এঁদের বেশি।
• সব শেষে রয়েছেন খরুচে মানুষ। অর্থাৎ, যাঁরা কি না এমনিতেই কথায় কথায় টাকা বার করেন। কিছু ক্ষেত্রে সেটা ভাল লক্ষণ হলেও, খরচের পরে গ্যাঁটের অবস্থা কী দাঁড়াবে তা নিয়ে ভাবেন না তাঁরা।
সহজ টোটকা
কখনও বলছি না যে, পকেটের চিন্তায় পুজো বা উৎসবের আনন্দই মাটি হোক। কিন্তু বাড়ির বড়রা যেমন পেট বুঝে খেতে বলেন, আমার পরামর্শ পকেট মেপে খরচ। এর কিছু সহজ টোটকা রয়েছে। সে কথাগুলি সংক্ষেপে বলে নেওয়া যাক।
তৈরি করুন তালিকা
পুজোয় কোনটা না কিনলেই নয়, তার তালিকা তৈরি করতে হবে আগে থেকেই। আর তা মেনেই চলতে হবে।
প্রত্যেকেরই সেই তালিকা মোটামুটি জানা থাকে। যেমন, কার জন্য নতুন জামা কিনতে হবে। কাকে কোন খরচের টাকা মেটাতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু তা-ও হাতের সামনে একটা তালিকা থাকলে ভাল হয়। প্রতি বছর সেই তালিকা থেকে কিছু বাদ যেতে বা যোগ হতে পারে। কিন্তু মোটের উপর তা একই থাকে। ফলে তা মেনে চলতে অসুবিধা নেই। বরং তাড়াহুড়োর সময়ে সুবিধাই হবে।
বাজেট জানেন তো?
পুজোয় পকেটে হাত দেওয়ার আগে বাজেট তৈরি করুন। কোথায় কত খরচ হবে তার সম্ভাব্য তালিকা যখন তৈরি করেছেন, তার পাশে লিখে রাখুন কত টাকা লাগবে, তা-ও। চেষ্টা করুন তার থেকে কম খরচ করতে। দেখবেন, তাতে লক্ষ্য ছোঁয়ার আনন্দ পাবেন।
কেনাকাটার সঙ্গী বাছুন
কোনও জিনিস দেখে পছন্দ হলে আপনি না কিনে থাকতে পারেন না। নিজের এই স্বভাব যদি জেনেই থাকেন, তা হলে কেনাকাটা করার সময়ে কোনও বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে সঙ্গী করে নিয়ে যান। তা সে দোকানে গিয়েই হোক, অথবা অনলাইনে কেনাকাটা। সঙ্গী যেন অবশ্যই থাকেন। তিনি পরিবারের কেউ হতে পারেন অথবা বন্ধু বা অফিসের সহকর্মী। তাঁর কাজই হবে, আপনার কোন জিনিস সত্যি দরকার আর কোনটা চোখে দেখে ভাল লাগা, তা বলে দেওয়া।
৭২ ঘণ্টা কাটতে দিন
একটা জিনিস আপনার খুব পছন্দ হয়েছে। মনে হচ্ছে এখনই না কিনলে অন্য কেউ যদি কিনে নেন! এমন আমাদের অনেকেরই মনে হয়। বিশেষত পুজোর শপিং করতে গিয়ে। আমি বলব, যদি সেই জিনিস আপনার দরকার থাকে, তা হলেই তার দিকে হাত বাড়ান। আর না হলে ৭২ ঘণ্টা অপেক্ষা করুন। যদি দেখেন তার পরেও আপনার তা কিনতে ইচ্ছে হচ্ছে, তবেই কিনুন। এর মধ্যে আপনার সেই বিশ্বস্ত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে ভুলবেন না। মনে রাখবেন, ঝোঁকের বসে কোনও কেনা থেকে নিজেকে বিরত রাখার সবচেয়ে ভাল উপায়ই হল কেনার ইচ্ছেটাকেই দমিয়ে রাখা।
প্রশ্ন করুন
উৎসবের সময়ে ভাল জিনিস কিনতে আমরা প্রায় সকলেই পছন্দ করি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই যে জিনিস কেনার কথা ভাবছেন, তা পরে আর ব্যবহার করা হয় না। অথচ সেই খাতে টাকা নষ্ট হয়। তাই উৎসাহের বশে অনেক দামি কোনও জিনিস কেনার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন যে, সেই জিনিস কি কোনও ভাবে আপনাকে সাহায্য করবে? নাকি শুধুমাত্র চোখের ভাললাগার জন্যই কিনছেন? কোনও জিনিস কেনার আগে এই প্রশ্নের উত্তর জরুরি।
স্মৃতিই আসল
মনে রাখবেন, খরচ একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত খুশি দিতে পারে। কিন্তু এই যে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে বেড়াতে, খেতে যাচ্ছেন। সেটাই আসল। তাই নিজেকে পুজোতে যদি সত্যি কিছু উপহার দিতে চান, তা হলে স্মৃতিই উপহার দিন।
আপনাদের পুজো ভাল কাটুক, সেই শুভেচ্ছাই রইল।
লেখক: মনোরোগ চিকিৎসক
(মতামত ব্যক্তিগত)