ছোট্ট ছোট্ট পায়ে

নিজের ছোট দোকান চালু করতে চান? হাঁস-মুরগি পালনে আগ্রহী? ছোট ব্যবসার জন্য হাতের সামনে রয়েছে ক্ষুদ্রঋণ। সুলুকসন্ধান দিলেন চন্দ্রশেখর ঘোষ কী ভাবে এই চিন্তা থেকে তাঁদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়া যায়, তা নিয়েই আজকের আলোচনা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২০ ০৬:০৩
Share:

বাবা-মা ভাল দিন, শুভ লগ্ন দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন কৃষ্ণনগরের সুলেখা হালদারের। নতুন সংসার পাতার পরে বেশ কিছু বছর ভালই কেটেছিল। কিন্তু স্বামী-সন্তান নিয়ে খুব বেশি দিন সেই সুখ স্থায়ী হয়নি সুলেখার জীবনে। এক দিন হঠাৎ তাঁকে ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান স্বামী আর সুলেখার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। দিনরাত শুধু দুশ্চিন্তা, কী করে চলবে সংসার আর কোথা থেকে আসবে দু’বেলার ভাত। ঠিক এরকমই একটা সময়ে পাশের বাড়ির এক বৌদি তাঁকে নিয়ে গেলেন তাঁদের গোষ্ঠীর মিটিংয়ে। একটি ক্ষুদ্রঋণ (মাইক্রো-ফিনান্স) সংস্থা এসে এই মিটিং করে ওঁদের গ্রামে। সেখান থেকে ঋণ নিয়েই শুরু হল সুলেখার নতুন করে বাঁচার লড়াই।

Advertisement

এই রকম সুলেখা হালদার ও তাঁদের দুশ্চিন্তার সংসার আমাদের দেশের গ্রামগুলিতে পরিচিত একটা ছবি। কী ভাবে এই চিন্তা থেকে তাঁদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়া যায়, তা নিয়েই আজকের আলোচনা। দেখে নেওয়া যাক কী ভাবে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলি থেকে ধার নেওয়া যায়। কখন তা মেলে, যোগ্যতাই বা কী লাগে। প্রথমেই জেনে নেব মাইক্রো-ফিনান্স সংস্থা কাদের বলে।

Advertisement

কারা ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা

• মাইক্রো-ফিনান্স বা ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা হল এক ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যারা ক্ষুদ্র ও ছোট ব্যবসার প্রয়োজনে ঋণ দেয়।

• এখনও আমাদের দেশের অনেক গ্রামে ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পাওয়া শক্ত। অনেক সময়ে আবার অনিয়মিত রোজগার-সহ নানা কারণে তা মেলেও না। সাধারণত সেই সমস্ত মানুষকেই অর্থ সাহায্য করে এই ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলি।

• লক্ষ্য, যাতে ওই সব ব্যক্তি ছোট ব্যবসা শুরু করে নিজেদের রোজগারের পথ তৈরি করতে পারেন। অথবা নিজের চালু ব্যবসাকে আরও সম্প্রসারিত ও প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন।

অন্য কারা ক্ষুদ্রঋণ দেয়

• বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক, সমবায় ব্যাঙ্ক ও সরকারি ব্যাঙ্কের কিছু কিছু শাখা, স্মল ফিনান্স ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফসি), এনবিএফসি মাইক্রো-ফিনান্স কোম্পানি এই ঋণ দিতে পারে।

• সীমিতসংখ্যক অসরকারি সংস্থা (এনজিও), ক্রেডিট ইউনিয়ন ইত্যাদিও ক্ষুদ্রঋণ দেয়।

এখানে বলে রাখা ভাল যে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ম অনুসারে, ব্যাঙ্ক ও সমবায় ব্যাঙ্ক ছাড়া আর কোনও সংস্থা আইনি ভাবে কোনও সঞ্চয় ও আমানত রাখতে পারে না।

কী ভাবে দেওয়া হয়

দেশে মাইক্রো-ফিনান্সের বিভিন্ন মডেল পরিচিত। যেমন, সেল্‌ফ হেল্প গ্রুপ (স্বনির্ভর গোষ্ঠী), জয়েন্ট লায়াবিলিটি গ্রুপ (যৌথ দায়বদ্ধ গোষ্ঠী) ও ইন্ডিভিজুয়াল গ্রুপ (ব্যক্তি গোষ্ঠী)। এদের মধ্যে বর্তমানে জয়েন্ট লায়াবিলিটি গ্রুপ উল্লেখযোগ্য। এখানে আমরা মূলত এই গ্রুপ নিয়েই আজ আলোচনা করব। এই গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য হল—

• সদস্য হতে পারেন ৫-২০ জন। সাধারণত গোষ্ঠীর ১০০ শতাংশই মহিলা হন।

• ওই গোষ্ঠীতে ঋণদানকারী সংস্থার তরফে এক জন গ্রুপ সভাপতি, এক জন সেক্রেটারি ও এক জন ক্যাশিয়ার থাকেন। কোনও কোনও সংস্থায় এক বা দু’বছর অন্তর এই পদাধিকারীরা বদলাতে থাকেন।

• বিভিন্ন সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, গ্রামে ও গ্রাহকদের পাড়ায় প্রতি সপ্তাহে, দু’সপ্তাহে ও মাসে মিটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে সদস্যদের নিয়মিত হাজিরা দেওয়া বাধ্যতামূলক।

• প্রথম দু’টি মিটিংয়ে ঋণের নিয়মকানুন ও কার্যকারিতা সম্পর্কে সদস্যের জানানো হয়। ঋণ নেওয়া, সুদের হার, ঋণের ব্যবহার, ঋণ শোধের নিয়ম ও মেয়াদ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

• যে সমস্ত মহিলারা লিখতে-পড়তে পারেন না, তাঁদের নিজের নাম সই করাও শিখিয়ে নেওয়া হয়।

• এই সব মিটিংয়ে ক্ষুদ্রঋণের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

• তার পরে গোষ্ঠী সেই প্রস্তাবের সমর্থন করে ঋণের অনুমোদন ও বিতরণের সুপারিশ করে।

• এই মিটিংয়ে গ্রাহকদের থেকে ঋণের কিস্তিও গ্রহণ করা হয়।

• জয়েন্ট লায়াবিলিটি গ্রুপে প্রতি সদস্য একে অপরের ঋণ শোধের ব্যাপারে আংশিকভাবে হলেও দায়বদ্ধ। তাই দেখা যায় নিজেদের আর্থিক প্রয়োজনেই সদস্যেরা সুসংগঠিত ভাবে গোষ্ঠী পরিচালনা করেন।

কোন ব্যবসায় নেওয়া যায়

• ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে সাধারণত ছোট ব্যবসা, কুটির শিল্প ও কৃষিকাজ সংক্রান্ত ব্যবসা শুরু করা যায়।

• অথবা চাইলে নিজের ছোট ব্যবসাকে আরও বাড়ানো যায়।

• দেশে মোটামুটি যে ধরনের ব্যবসায় ক্ষুদ্রঋণ কাজে লাগানো হয় সেগুলি হল— আনাজ চাষ ও বিক্রয়, মাছ চাষ ও বিক্রয়, হাঁস-মুরগি পালন, গরু পালন, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রি, মুদিখানা, জামাকাপড় সেলাই ও বিউটি পার্লার খোলা প্রভৃতি।

যোগ্যতা কী

• সাধারণত ১৮ বছর বয়স হলেই এই ঋণের আবেদন করা যায়।

• কর্মক্ষমতা থাকলে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত ঋণ নেওয়া যায়।

• একটি পরিবারে শুধু এক জনই এই ঋণ পেতে পারেন।

• যেহেতু এই ঋণ মূলত ব্যবসা শুরু করা ও চালু ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করার জন্যই দেওয়া হয়, তাই কোনও কোনও ক্ষেত্রে ব্যবসা বা ব্যবসার পরিকল্পনা সংক্রান্ত প্রমাণ দাখিল করতে হয়। কিছু সংস্থার ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহীতার পূর্বে শোধ করা ঋণের রেকর্ডও দেখা হয়।

• যে কোনও গ্রাহকের ক্ষুদ্রঋণ সংক্রান্ত তথ্য প্রতি সপ্তাহে ক্রেডিট ব্যুরোতে আপলোড করা হয়। ফলে যে কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সহজেই আবেদনকারীর ক্রেডিট রেকর্ড যাচাই করে ঋণ দেওয়া বা না-দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

সর্বাধিক কত

• নিয়ম অনুসারে, সব পরীক্ষার পরে মোট ঋণের পরিমাণ কত হওয়া উচিত, তা ঠিক করে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা।

• রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ম অনুযায়ী, কোনও একজন আবেদনকারী সর্বোচ্চ দু’টি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা থেকে ঋণ নিতে পারবেন এবং মোট ১.২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ পেতে পারবেন।

• সাধারণত এই ঋণ ৫০০০ টাকা থেকে শুরু হয়। তবে প্রতি বছর ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঋণের পরিমাণ বাড়ানোরও সুযোগ থাকে।

• সর্বোচ্চ দু’টি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা থেকে একই সময়ে ঋণ নেওয়া যায়।

• তবে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিলে উপরের এই নিয়মগুলি প্রযোজ্য নয়।

কত দিনে শোধ

• এই সব ক্ষুদ্রঋণের মেয়াদ সাধারণত ১ থেকে ২ বছর পর্যন্ত হতে পারে। তার মধ্যে ঋণ শোধ করে দিতে হয়।

• এই ঋণের কিস্তি দিতে হয় সপ্তাহে, প্রতি পনেরো দিনে বা মাসে। যে কারণে সাধারণত সমগ্র সুদের পরিমাণও অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণের তুলনায় বেশ কম হয়।

• ক্ষুদ্র ঋণে সরল সুদ (সিম্পল ইন্টারেস্ট) বসে। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ (কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট) নেওয়া হয় না।

• ধার শোধের পরে গ্রাহকের বাড়ি ও ব্যবসার অবস্থা খতিয়ে দেখে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি ঋণ বাড়াতে, কমাতে অথবা সম্পূর্ণ নাকচ করতে পারে।

সুদের হার

কোনও ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা গ্রাহকদের থেকে কত হারে সুদ নিতে পারে, তা নির্ধারণের নিয়ম ঠিক করে দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সেই নিয়ম অনুসারে—

• ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার মোট ব্যবসা যদি ১০০ কোটি টাকার বেশি হয়, তা হলে সংস্থাটি যে সুদে ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়েছে তার উপরে বাড়তি ১০% অবধি গ্রাহকদের থেকে নিতে পারে।

অর্থাৎ, সংস্থা যদি ব্যাঙ্ক থেকে ১২% সুদে ঋণ নিয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে গ্রাহকের ঋণে সুদের হার হতে পারে সর্বোচ্চ ২২%।

• সংস্থার মোট ব্যবসা যদি ১০০ কোটি বা তার নীচে হয়, সে ক্ষেত্রে সংস্থাটি যে সুদে ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়েছে তার উপরে অতিরিক্ত ১২% অবধি সুদ নিতে পারে।

এ ক্ষেত্রে সংস্থা যদি ১২% সুদে ঋণ নিয়ে থাকে, তা হলে গ্রাহকদের থেকে তারা সর্বোচ্চ ২৪% অবধি সুদ নিতে পারবে।

• এ ছাড়া দু’ক্ষেত্রেই ১% অবধি প্রসেসিং ফি নিতে পারে সংস্থাগুলি।

• বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে অবশ্য অন্যান্য ঋণের সুদের হার যে ভাবে ঠিক হয়, ক্ষুদ্রঋণের সুদও সে ভাবেই নির্ধারিত হয়ে থাকে।

বৈশিষ্ট্য

• রিজার্ভ ব্যাঙ্কের জারি করা নিয়ম মেনে চলে মাইক্রো-ফিনান্স সংস্থাগুলি। অর্থাৎ, তাদের কাজকর্মে শীর্ষ ব্যাঙ্কের নজরদারি থাকে।

• সাম্প্রতিক নিয়ম অনুসারে, এখন প্রতি ক্ষুদ্রঋণ গ্রাহক, এমনকি কোনও কোনও সংস্থায় ঋণগ্রহীতার স্বামীরাও জীবন বিমার অন্তর্ভুক্ত।

• এমন অনেক ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প

বাজারে রয়েছে, যেগুলি শুধু মহিলাদের কথা মাথায় রেখেই তৈরি। তাঁরাই সেখানে ঋণের আবেদন

করতে পারেন ও ব্যবসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

লেখক বন্ধন ব্যাঙ্কের এমডি-সিইও

(মতামত ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement