মেধাসম্পদের অভাব কোনও দিনই ছিল না। কমতি নেই নতুন ব্যবসা শুরুর উদ্ভাবনী চিন্তাতেও। তা সত্ত্বেও পরিকাঠামো, পুঁজি এবং একসঙ্গে এক গুচ্ছ সংস্থার বেড়ে ওঠার পরিবেশের (ইকো সিস্টেম) অভাবে লাগাতার ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে বিভিন্ন সদ্য গড়া সংস্থা (স্টার্ট আপ)। সেই ছবি বদলাতেই এ বার ন্যাসকমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তৈরি করা ইনকিউবেশন সেন্টারের (নতুন ব্যবসার আঁতুড়ঘর) উপরে আস্থা রাখছে রাজ্য। এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ওই উদ্ভাবনা কেন্দ্রের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠছে ১৮টি স্টার্ট আপ। নেটে পরামর্শ নিয়েছেন আরও প্রায় দু’হাজার সম্ভাব্য উদ্যোগপতি।
গত বছর ন্যাসকমের সঙ্গে জোট বেঁধে এই সেন্টার গড়েছে রাজ্য। সেক্টর ফাইভে ওয়েবেল ভবনে ১০ হাজার বর্গ ফুটে তা তৈরি হয়েছে। জায়গা দিয়েছে রাজ্যই। এই কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা ন্যাসকম প্রতিনিধি রবি গুরু জানান, ‘‘রাজ্যে মেধা ও ব্যবসায়িক পরিকল্পনা আছে। রয়েছে পুঁজির আশ্বাস। আমাদের চেষ্টা এই তিনের মধ্যে সেতু তৈরি।’’
তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির সংগঠন ন্যাসকমের দাবি, কেন্দ্রে ১৮টি সংস্থার মধ্যে ইতিমধ্যেই লগ্নি টেনেছে ৫টি। যার মধ্যে রয়েছে আইনের ছাত্র ওম অগ্রবালের ইজি কোচ, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়ুয়া অনুরাগ প্রজাপতের অ্যাকজন টেক, চেঞ্জারমিন্টস, অ্যাপলপ ইত্যাদি।
এই কেন্দ্রে ডালপালা মেলতে শুরু করা সংস্থাগুলি কাজ করছে নানা ক্ষেত্রে। যেমন, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ পাড়ি দিতে ইচ্ছুক পড়ুয়ারা সেখানকার কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নিজেদের যোগ্যতা কী ভাবে তুলে ধরবেন, সে বিষয়ে পরামর্শ দেয় ইজি কোচ। এ জন্য মার্কিন মুলুকের সেরা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পড়ুয়াদের সঙ্গে এ দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের যোগাযোগ তৈরি করে দিচ্ছে তারা। অ্যাকজন টেক তৈরি করেছে ব্যান্ড। যা হাতে পরে রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন-সহ স্বাস্থ্যের নানা খুঁটিনাটি জরিপ করা যায়। নেট মারফত সেই তথ্য পৌঁছনো যায় চিকিৎসক বা ভিন্ শহরে থাকা সন্তানের কাছে। চলতি মাসে এই ব্যান্ড বাজারে আসার কথা।
খুচরো ব্যবসায় আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠী, আইটিসির মতো সংস্থাকে পরিষেবা দেয় সিবিয়া অ্যানালিটিক্স। মেডইমার্জেন্সি তৈরি করছে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য ভাণ্ডার। কোন হাসপাতালে এখন কত শয্যা রয়েছে, কোথায় কোন রক্ত পাওয়া যাবে, এ ধরনের তথ্য পাওয়া যাবে এখান থেকে।
সেন্টারে ‘জন্মানো’ অনেক স্টার্ট-আপেরই বিজ্ঞাপন বানাচ্ছে যে সংস্থা, সেটিও তৈরি হয়েছে সদ্য। বিজ্ঞাপন গুরু রাম রায়ের সঙ্গে ‘জিরো বাজেট এজেন্সি’ চালু করেছেন রাশি রায়। শুধু নগদের বদলে বরং স্টার্ট আপ সংস্থার শেয়ারের বিনিময়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করে দিচ্ছেন তাঁরা। রাশির দাবি, ন্যূনতম খরচে নতুন সংস্থার ব্র্যান্ড পরিচিতি তৈরিই তাঁদের লক্ষ্য।
সফটওয়্যারে বেঙ্গালুরু, মুম্বই, দিল্লি, হায়দরাবাদের তুলনায় দেরিতে দৌড় শুরু করেছিল কলকাতা। হার্ডওয়্যার ও চিপ ডিজাইনিংয়ে আবার দৌড় শুরুই করা যায়নি। ইন্ডিয়া ডিজাইন সেন্টার তৈরির ভাবনা এখনও আটকে লাল ফিতের ফাঁসে। দেরিতে দৌড় শুরুর এই ধারা বজায় থেকেছে স্টার্ট আপ সংস্থার পছন্দের গন্তব্য হয়ে ওঠার চেষ্টাতেও। ২০১২ সালে স্টার্ট-আপের আন্তর্জাতিক মানচিত্রে নাম তুলে ফেলেছিল বেঙ্গালুরু। জায়গা পেয়েছিল বিশ্বের প্রথম ২০টি শহরের মধ্যে। ২০১৫ সালে প্রথম পনেরোয়। এমন প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে টক্কর দিতে ইনকিউবেশন সেন্টার একান্ত জরুরি বলে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা।
তাঁদের মতে, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, মুম্বইয়ের তুলনায় কলকাতা এই দৌড়ও শুরু করেছে পরে। অনেক অসুবিধাকে সঙ্গী করে। যেমন, বড় লগ্নি তো দূর অস্ত্, শিল্পায়নের প্রক্রিয়াই কার্যত থমকে গিয়েছে এই রাজ্যে। কাঙ্খিত উচ্চতায় পৌঁছয়নি তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প। ফলে ব্যবসা শুরুর ‘ইকো-সিস্টেম’ পোক্ত নয়। তা ছাড়া, গুটিকয় নতুন সংস্থা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলে, টাকা ঢালতে মুখ বাড়ায় না উদ্যোগ পুঁজি (ভেঞ্চার ক্যাপিটাল)। বড় সংস্থার বরাত বা হাতের সামনে সাফল্যের নমুনা— পাওয়া শক্ত হয় সবকিছুই। আর এই সমস্ত অসুবিধার কারণেই এখানে সেন্টার এত জরুরি। সংশ্লিষ্ট মহল মনে করে, বাকি শহরের সঙ্গে যুঝতে এমন কেন্দ্র আরও দরকার।
ন্যাসকমের দাবি, উদ্যোগ পুঁজি তো বটেই, স্টার্ট-আপে টাকা ঢালতে পিছপা নন স্থানীয় শিল্পপতিরা। দু’বছর আগে তৈরি হয়েছে লগ্নিকারীদের সংগঠন ক্যালকাটা এঞ্জেল নেটওয়ার্ক। সেন্টারের নানা উদ্ভাবনী চিন্তা সেই পুঁজি টানতে পারবে বলে তাদের ধারণা।