প্রতীকী চিত্র
আগের সপ্তাহে চোখ রেখেছিলাম শেয়ার ও শেয়ার নির্ভর (ইকুইটি) ফান্ডে এবং ঋণপত্র নির্ভর (ডেট) ফান্ডে লগ্নি করে হওয়া আয়ের উপরে যে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি মূলধনী লাভ কর বসে, তার উপরে। আওড়ে নিয়েছিলাম এই করের কতটুকু কী ভাবে বইতে হবে লগ্নিকারীকে। এক, যাতে লগ্নির পরিকল্পনা করার সময় সেটা মাথায় রেখে লাভ-ক্ষতির হিসেব কষা যায়। দুই, যাতে করোনাকালে হাজারো ঝড়-ঝাপটার মধ্যে দাঁড়িয়েও কর মেটানোর বিষয়টি মাথা থেকে বেরিয়ে না-যায়। তিন, করে মেটানোর গাফিলতিতে যাতে শেষে লোকসানের খপ্পরে পড়তে না-হয়। এই দফায় সেই একই লক্ষ্যে, গত দু’বছরে লগ্নির ক্ষেত্রে আয়করের আরও যে সব খুঁটিনাটি বদল হয়েছে, তা নেড়েচেড়ে দেখব।
মনে রাখা ভাল
অতিমারির চোখরাঙানিতে শুধু আপনার-আমার নয়, রোজগার হারিয়েছে সরকারেরও। কারণ, দেশের আর্থিক কর্মকাণ্ড চোট খেয়েছে। তার উপরে বেড়েছে খরচ। রাজকোষের স্বাস্থ্য ফেরানোর লক্ষ্যে তাই বাধ্যতামূলক ভাবে কর দেওয়ার জন্য নাগরিকদের কাছে বিভিন্ন ভাবে আবেদন জানাচ্ছে সরকার। বাড়ানো হচ্ছে সময়সীমা। এ বার স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালেও কর জমার কথা ফের মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বলেছেন, না- হলে সরকার উন্নয়নের কাজ করবে কী ভাবে? কী ভাবেই বা লড়বে করোনার বিরুদ্ধে? এ কথা মাথায় রেখেই দেশবাসীকে স্বেচ্ছায় কর দিতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, প্রধানমন্ত্রীর আবেদন থেকে আমাদের বুঝে নিতে হবে কর সংগ্রহের ব্যাপারটিকে সরকার ঠিক কতটা অগ্রাধিকার দিচ্ছে। যার মানে আয়কর দফতর এখন অনেক বেশি সক্রিয়। আতসকাচের তলায় প্রতিটি ব্যক্তির আয়, খরচ। ফলে আমাদেরও সমান গুরুত্ব দিতে হবে বিষয়টিকে। যাতে কোনও ত্রুটি থেকে না-যায়। বলা হয়, সময়ের কাজ সময়ে না-করলে ক্ষতি আটকানো মুশকিল। ছোটবেলার এই শিক্ষা বিনিয়োগের বৃত্তেও খুব দামি। তাতে সময় বাঁচে। ঝক্কি এড়ানো যায়। কমে হয়রানি। কর প্রসঙ্গে এটা মনে রেখে চলা জরুরি। আজ চোখ রাখব ডিভিডেন্ড এবং বাড়ি বিক্রির ক্ষেত্রে করের বদল এবং সেই করের চাপ থেকে কিছুটা সুরাহা কী ভাবে পাওয়া যায়, সে দিকে।
করের আওতায় ডিভিডেন্ড
এ বছর ১ এপ্রিলের আগে কোম্পানি এবং মিউচুয়াল ফান্ড থেকে প্রাপ্ত ডিভিডেন্ডের জন্য প্রাপককে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর গুনতে হত না। শুধুমাত্র ডিভিডেন্ড বাবদ যাঁদের আয় ১০ লক্ষ টাকার বেশি ছিল, তাঁদের কর দিতে হত ১০% হারে। ডিভিডেন্ডের উপরে এত দিন কর দিচ্ছিল বণ্টনকারী সংস্থা বা ফান্ডগুলি। এই কর ডিভিডেন্ড ডিস্ট্রিবিউশন ট্যাক্স (ডিডিটি) নামে পরিচিত ছিল। সংস্থার দেওয়া ডিডিটির হার ছিল ২০.৫৬%। ইকুইটি এবং ডেট ফান্ডগুলির এই কর বাবদ দায় ছিল যথাক্রমে ১১.৬৪৮% এবং ২৯.১২%। এই নিয়মের আমূল পরিবর্তন করা হয়েছে এ বারের বাজেটে। তুলে দেওয়া হয়েছে ডিডিটি। অর্থাৎ, কোম্পানি এবং ফান্ডগুলির উপরে এই বাবদ আর কোনও করের দায় রইল না। তার পরিবর্তে ডিভিডেন্ডের জন্য কর দেওয়ার দায় সরাসরি বর্তেছে ডিভিডেন্ড প্রাপকের উপরে।
• এই বাবদ প্রাপককে কর দিতে হবে প্রযোজ্য আয়করের হার অনুযায়ী। অর্থাৎ, আয়ের স্তর অনুযায়ী কেউ যদি ৩১.২% করের আওতায় পড়েন তবে তাঁকে সেই হারেই কর দিতে হবে প্রাপ্ত ডিভিডেন্ডের উপরে। ফলে যাঁরা উঁচু করের আওতায় পড়েন তাঁদের লোকসান হবে এই নতুন নিয়ম অনুযায়ী।
• কোনও কোম্পানি অথবা ফান্ড থেকে পাওয়া ডিভিডেন্ড যদি ৫০০০ টাকা বা তার বেশি হয়, তবে তার উপরে উৎসে কর হিসেবে কেটে দেওয়া হবে ১০%। করোনার কারণে অবশ্য ২০২০-২১ অর্থবর্ষের জন্য টিডিএসের হার কমিয়ে ৭.৫% করা হয়েছে।
• ডিভিডেন্ড সংক্রান্ত এই নতুন নিয়ম চালু হয়েছে গত ১ এপ্রিল থেকে। কারও মোট আয় যদি করমুক্ত আয়ের মধ্যে পড়ে, তবে বয়স অনুযায়ী তিনি ফর্ম ১৫জি অথব ১৫এইচ সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা ফান্ডে দাখিল করতে পারেন যতে উৎসে কর কাটা না-হয়।
• অতএব ডিভিডেন্ডের উপর নতুন কর ব্যবস্থা অনুযায়ী, যাঁরা সর্বোচ্চ হারে আয়করের আওতায় পড়েন তাঁদের লোকসান। যাঁরা করের আওতায় পড়েন না কিংবা ন্যূনতম অর্থাৎ, ৫% হারে কর দিতে হয় তাঁদের লাভ। যে সব মিউচুয়াল ফান্ডের লগ্নিকারী ৩০% বা তার বেশি করের আওতায় পড়েন তাঁরা করের দায় কম রাখার জন্য ‘ডিভিডেন্ড’ বিকল্প থেকে সরে আসতে পারেন ‘গ্রোথ’ বিকল্পে।
বাড়ি ও ফ্ল্যাট বিক্রিতে
মূলধনী লাভকর
কোনও স্থাবর সম্পত্তি ২৪ মাসের বেশি (আগে ছিল ৩৬ মাসের বেশি) ধরে রেখে বিক্রি করে মুনাফা হলে তা দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভ হিসেবে বিবেচিত হবে। তার উপর কর ধার্য হবে ২০% হারে। এই লাভের অঙ্ক কষার সময়ে অবশ্য ক্রয়মূল্য বৃ্দ্ধি সূচক (কস্ট ইনফ্লেশন ইনডেক্স) প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। সেই কারণে প্রকৃত করের হার কিছুটা কমতে পারে। উপরের সারণিতে দেওয়া হল গত ২০ বছরের ক্রয়মূল্য বৃদ্ধি সূচক।
সাশ্রয়ের উপায়
সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভের উপরে দেয় করের পুরোটাই বাঁচাতে বিক্রিলব্ধ টাকার সবটা দিয়ে এই ভাবে লগ্নি করা যায়—
• সম্পত্তি বিক্রির এক বছর আগে অথবা দু’বছর পরে একটি বাড়ি কেনেন। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষ থেকে এই টাকা (অনধিক ২ কোটি টাকা) দিয়ে একটির জায়গায় দু’টি বসতবাড়ি কিনলেও একই ছাড় পাওয়া যায়।
• সম্পত্তি বিক্রির তিন বছরের মধ্যে যদি কোনও বাড়ি নির্মাণ করেন।
• বাড়ি কেনা অথবা তৈরি করার তিন বছরের মধ্যে যদি তা বিক্রি না-করেন।
• মূলধনী লাভের উপর কর বাঁচানো যায় যদি লাভের অঙ্ক সম্পত্তি বিক্রি করার ছ’মাসের মধ্যে মূলধনী কর সাশ্রয়কারী বন্ডে লগ্নি করা যায়। এই বন্ড ইসু করে ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি এবং রুরাল ইলেক্ট্রিফিকেশন কর্পোরেশন। এই বন্ডের মেয়াদ পাঁচ বছর। এখন সুদের হার ৫.৭৫%। (ধারা ৫৪ইসি)। দু’টিই রাষ্ট্রায়ত্ত এবং ‘ট্রিপল এ’ রেটিংযুক্ত সংস্থা।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)