—ফাইল চিত্র।
কার্যত এক ঢিলে দুই পাখি! বৃহস্পতিবার লোকসভায় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন পেশ করলেন ২০১২ সালে চালু পুরনো আর্থিক লেনদেনে কর (রেট্রসপেক্টিভ ট্যাক্স) প্রত্যাহারের প্রস্তাব সম্বলিত কর আইন (ট্যাক্সেশন ল’জ়) সংশোধনী বিল ২০২১। আর তার পরেই দেশভর চর্চা শুরু হল কেন্দ্রের অবস্থান বদল নিয়ে। সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, ওই কর ইউপিএ জমানার ঠিকই। কিন্তু তা নিয়ে বিজেপি সরকারের অর্থমন্ত্রীরা কোনও দিনই আপত্তি করেননি। উল্টে মোদী আমলেও কর আদায়ের নোটিস গিয়েছে ব্রিটেনের ভোডাফোন এবং কেয়ার্ন এনার্জির মতো সংস্থার কাছে। এই অবস্থায় আচমকাই সেই নিয়ম বাতিলের উদ্যোগকে মূলত ওই দুই সংস্থার সঙ্গে আপসে মীমাংসার চেষ্টা বলে মনে করছে তারা। কর আদায়ের প্রশ্নে এদের কাছেই সম্প্রতি আইনি লড়াইয়ে হেরেছে সরকার। একই সঙ্গে তাদের মত, এই পদক্ষেপে ভর করেই ভোডাফোন আইডিয়ার মতো বকেয়ার ভারে ধুঁকতে থাকা টেলিকম সংস্থায় লগ্নি আসার পথ খুলতে পারে।
বিলে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সংস্থার থেকে পুরনো লেনদেনের কর হিসেবে যে অর্থ আদায় করা হয়েছে, তা ফেরত দেবে সরকার। তবে ওই অর্থে কোনও সুদ দেবে না।
ভারতে ব্যবসা করছে এমন বিদেশি সংস্থা এ দেশের সম্পত্তি হস্তান্তর করার জন্য যদি শেয়ার হস্তান্তর করে মুনাফা গোনে, তবে তার উপরে কর বসাতে চেয়েছিলেন ইউপিএ জমানায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। এমনকি বিদেশের মাটিতে লেনদেন হলেও। সে জন্য ২০১২ সালের ২৮ মে আসে সংশোধিত আয়কর আইন। সেখানে এটাও বলা হয়, ওই আইন বলবৎ হওয়ার আগে যদি কোনও সংস্থা ভারতে ওই ভাবে লাভ করে থাকে, তাতেও মেটাতে হবে কর। যে দিন ওই লেনদেন হয়েছে, সেই দিন থেকে। যা পুরনো লেনদেনে বকেয়া কর গণ্য হবে। বৃহস্পতিবার ওই বকেয়া কর আদায়ের নিয়ম বাতিল করতেই বিল আনল মোদী সরকার। নির্মলার দাবি, ভারত লগ্নির আকর্ষণীয় গন্তব্য। কিন্তু পথের কাঁটা এই নিয়ম। তাই তা তোলার উদ্যোগ। লক্ষ্য, করোনার প্রভাব কাটিয়ে দ্রুত অর্থনীতিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করানো।
এ দিন সকাল থেকে হট্টগোলের জেরে বারবার মুলতুবি হয়ে যাওয়ার পরে লোকসভার অধিবেশন ফের বিকেল পাঁচটায় শুরু হয়। ওই বিল পেশের জন্য আচমকা অতিরিক্ত কার্যসূচির তালিকা আনে সরকার। কারণ, বিলটির কথা কার্যসূচিতে ছিল না। তার পরেই তা পেশ করেন নির্মলা।
সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, কেয়ার্ন এবং ভোডাফোন কর-কাণ্ড থেকে দ্রুত রেহাই পেতে মরিয়া কেন্দ্র। গত বছর আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে কর আদায় নিয়ে দুই সংস্থার সঙ্গেই আইনি লড়াইয়ে হেরেছে তারা। উল্টে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ এসেছে। শুধু তা-ই নয়, কেয়ার্ন সেই ক্ষতিপূরণ না-পেয়ে বিদেশে ভারতের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এবং বেচে প্রাপ্য উসুলের পথে এগোচ্ছে। অনেকেরই ধারণা, এটা দেখে আগামী দিনে এই পথে হাঁটতে পারে আরও কিছু সংস্থা। প্রায় ১৭টির বিরুদ্ধে ‘রেট্রসপেক্টিভ’ কর আদায়ের বিজ্ঞপ্তি ছিল।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে নির্মলাও কয়েক দিন আগে কেয়ার্ন কর মামলা প্রসঙ্গে ভারত সরকারের কর বসানোর অধিকারের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। শিল্পমহল অবশ্য এ দিনের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে একাংশের মতে, দেশের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে তাদের আরও মুখ পড়তে পারে, এটা আঁচ করেই তড়িঘড়ি এই পথে হাঁটল সরকার। বিশেষত বিষয়টি যেখানে ঘরে-বাইরে যথেষ্ট সমালোচিত।
তার উপরে কর বিবাদ ঘিরেই মনোমালিন্য তৈরি হয় ভোডাফোন গোষ্ঠীর সঙ্গে। এ দেশের টেলিকম শিল্পে লগ্নির অনিচ্ছা প্রকাশ করে পরবর্তীকালে আইডিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল তারা। কিন্তু সেই ভোডাফোন আইডিয়া এখন ধুঁকছে। কেন্দ্রীয় সাহায্য না-পেলে সংস্থা উঠে যাবে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে সম্প্রতি হাতে ২৭% শেয়ার নিয়েও পর্ষদ ছেড়েছেন কর্ণধার কুমার মঙ্গলম বিড়লা। সব মিলিয়ে বিস্তর চাপ মোদী সরকারের মাথার উপরে। একাংশের ধারণা, ‘রেট্রসপেক্টিভ’ ট্যাক্স উঠলে ভোডাফোন আইডিয়ার জন্য লগ্নি টানাও আগের থেকে সহজ হতে পারে।
আয়কর বিশেষজ্ঞ নারায়ন জৈনের বক্তব্য, ‘‘কেন্দ্রের নতুন পদক্ষেপকে স্বাগত। এটা আরও আগে করা উচিত ছিল।’’ কোম্পানি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং ইনস্টিটিউট অব চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন চেয়ারম্যান অনির্বাণ দত্তও সংশোধনী আনার উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, ‘‘এর ফলে বিদেশি সংস্থাগুলির কাছে ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে। যা দেশে লগ্নি টানতে সহায়ক হবে।’’
বিশেষজ্ঞদের মতে, ৫ অগস্ট মোদী সরকারের জমানায় মনে রাখার মতো একটি তারিখ। গত বছর এই তারিখেই রাম মন্দিরের শিলান্যাস করেছিল তারা। তার আগের বছর ৩৭০ রদ। আর এ বার পুরনো আর্থিক লেনদেনে কর বাতিলের সংশোধনী বিল পেশ।