কার্যত খাদের মুখে অর্থনীতি।
আর্থিক মন্দা! কোথায়? মন্দার সংজ্ঞা কী, জানেন?
আর্থিক বৃদ্ধির হার ৪.৫ শতাংশে নেমে আসার পরে কংগ্রেসের দাবি, মন্দা এসে গিয়েছে। কিন্তু ‘মন্দা’-র তকমা ঠেকাতে পুঁথিগত সংজ্ঞাকে ঢাল করছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার।
কেন্দ্রের বক্তব্য, সংজ্ঞা অনুযায়ী, পরপর দু’টি ত্রৈমাসিকে অর্থনীতির বহর কমলে বা আর্থিক বৃদ্ধির হার নেতিবাচক হলে তবেই মন্দা এসেছে বলা যায়। সেখানে দেশের অর্থনীতি এখন ৪.৫% হারে হলেও বাড়ছে। কেন্দ্রের আর্থিক বিষয়ক সচিব অতনু চক্রবর্তীর দাবি, অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকেই বৃদ্ধির হার বাড়বে। কিন্তু অন্য একটি সংজ্ঞা হল, বেশ ক’মাস ধরে অর্থনীতি জুড়ে আর্থিক কর্মকাণ্ড অনেকটা কমলে, জিডিপি, প্রকৃত আয়, কাজের সুযোগ, শিল্পে উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরো মূল্যবৃদ্ধির দরে তার প্রভাব দেখা গেলে তাকে মন্দা বলে। অর্থনীতি এবং শিল্প মহলে এই সংজ্ঞার মান্যতাই বেশি। আর দেশের অর্থনীতিতে এই সব লক্ষণই স্পষ্ট বলে কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলের অভিমত।
আরও পড়ুন: খাদের মুখে অর্থনীতি! প্রমাদ গুনছে শিল্প
আরও পড়ুন: প্রকৃতির মার রুখুক বিমস্টেক, উঠেছে প্রস্তাব
কিন্তু তিন দিন আগেই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সংসদে দাবি করেছেন, আর্থিক বৃদ্ধি কমে আসতে পারে। কিন্তু এখনও মন্দা আসেনি। কখনওই আসবে না। আজ মুম্বইয়ে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মন্তব্য, ‘‘আর্থিক বৃদ্ধির নিরিখে এখনও আমরা দ্রুতগামী অর্থনীতি।’’
মন্দা কাকে বলে
• ব্রিটিশ সরকার ও আমেরিকার বুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিক্স অনুযায়ী, পরপর দু’টি ত্রৈমাসিকে আর্থিক বৃদ্ধির হার শূন্যের কম হলে বা অর্থনীতির সংকোচন হলে তাকে মন্দা বলে
• আমেরিকার ন্যাশনাল বুরো অব ইকনমিক রিসার্চ অনুযায়ী, বেশ ক’মাস ধরে আর্থিক কর্মকাণ্ড অনেকটা কমলে, জিডিপি, প্রকৃত আয়, কাজের সুযোগ, শিল্পোৎপাদন, পাইকারি ও খুচরো মূল্যবৃদ্ধির দরে তার প্রভাব দেখা গেলে তাকে মন্দা বলে
n অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ, নীতি নির্ধারক, শিল্পমহল ন্যাশনাল বুরো অব ইকনমিক রিসার্চ-এর সংজ্ঞাই ব্যবহার করেন
অথচ অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দা এসে গিয়েছে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক অরুণ কুমার বলেন, ‘‘গত তিন বছর ধরেই মন্দা চলছে। তা দেখা যাচ্ছে না, কারণ সংগঠিত ক্ষেত্র ৭ শতাংশ হারে বাড়ছে। কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্র আসলে অনেক বেশি হারে সংকোচন হচ্ছে। বৃদ্ধির হার এখন ৪.৫ বা ৫ শতাংশ নয়। বৃদ্ধির হার এখন শূন্যের থেকে ১ শতাংশ কম। অর্থাৎ অর্থনীতি ১ শতাংশ হারে সংকুচিত হচ্ছে।’’
অতীতে দেশে যখনই মন্দা এসেছে, তখন তার পিছনে কারণ ছিল হয় খাদ্যসঙ্কট, না হয় তেলের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া, কিংবা পরপর দু’তিনটি মরসুমে খরা। ২০০৮-এ আন্তর্জাতিক মন্দার প্রভাব পড়েছিল এ দেশে। কিন্তু এ বার তেমন কিছুই হয়নি। বিশ্ব অর্থনীতিতে ঝিমুনি দেখা দিলেও, এত বড় ঢেউ লাগেনি।
তা হলে কোথায় সমস্যা?
অর্থনীতিবিদরা নোটবন্দিকেই দায়ী করছেন। বিরোধীদের দাবি, নোট বাতিলের ধাক্কা কাটার আগেই জিএসটি চালু করায় সমস্যা আরও বেড়েছে। অরুণ কুমারের মতে, ‘‘নোট বাতিলের ফলেই অসংগঠিত ক্ষেত্রে গত তিন বছর ধরে ধস নেমেছে। এখনও ক্ষয় চলছে।’’ দিল্লির ন্যাশনাল ইনস্টিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসির অধ্যাপক এন আর ভানুমূর্তির যুক্তি, তাত্ত্বিক ভাবে বলা যায় না যে মন্দা এসেছে। কারণ, পরপর দু’টি ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার শূন্যের নীচে যায়নি। কিন্তু অর্থনীতির ছবিটা মোটেই ভাল নয়। তাঁর কথায়, ‘‘প্রধান চিন্তার কারণ হল, কেনাকাটা কমে যাওয়া। এ দেশের মানুষ সঞ্চয় করে তবেই কেনাকাটা করেন। সঞ্চয় কমায় কেনাকাটাও কমেছে।’’
অর্থনীতির সঙ্কটকে হাতিয়ার করে রবিবার দিল্লির রামলীলা ময়দানে সমাবেশের ডাক দিয়েছে কংগ্রেস। দলের নেতা মণীশ তিওয়ারির কটাক্ষ, ‘‘অর্থমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। অর্থনীতিতে মন্দা নয়, মন্দার থেকেও খারাপ দশা। ৪.৫ শতাংশ বৃদ্ধির হার মানে জিডিপি মাপার পুরনো হিসেবে ২.৫ শতাংশ।’’ সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, ‘‘এই নিয়ে টানা ন’মাস বৃদ্ধির হার কমল। এটা যদি মন্দা না হয়, তা হলে কী? সরকার অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক।’’
তবে শাহ আজও দাবি করেছেন, ‘‘২০১৪-য় অর্থনীতির বহরে আমরা ১১ নম্বরে ছিলাম। এখন ৭ নম্বরে। আমার পূর্ণ বিশ্বাস, ২০২৪-এ ৫ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছে যাব।’’