সাংবাদিক সম্মেলনে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। ছবি: পিটিআই।
অর্থনীতিতে মন্দার লক্ষণে মোদী সরকার যে কতখানি আতঙ্কিত, তার নমুনা মিলল।
অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার মরিয়া দাওয়াই হিসেবে আজ এক ধাক্কায় কর্পোরেট করের বোঝা অনেকখানি কমিয়ে দিল তারা। দীপাবলির আগেই রোশনাই ছড়াল শেয়ার বাজারে।
আজ অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন কর্পোরেট কর এক ধাক্কায় ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২২ শতাংশে নিয়ে আসার কথা ঘোষণা করেছেন। বড় মাপের সংস্থাগুলিকে এত দিন সেস-সারচার্জ মিলিয়ে ৩৪.৯৪ শতাংশ হারে কর্পোরেট কর মেটাতে হত। এখন দিতে হবে ২৫.১৭ শতাংশ। যার অর্থ, কর কমছে ১০ শতাংশ অঙ্ক। নতুন কারখানা খুলতে তৈরি সংস্থার জন্যও কর্পোরেট করের হার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে আনা হল। সেস ও সারচার্জ নিয়ে এই হার ২৯.১২ শতাংশ থেকে কমে হল ১৭.০১ শতাংশ। বাজেটে বিদেশি সংস্থাগুলির শেয়ার বাজারে মুনাফার উপরে বাড়তি সারচার্জের বোঝা চাপানো হয়েছিল। আগেই তার কিছুটা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন নির্মলা। আজ আরও এক দফা প্রত্যাহার করা হল।
নির্মলার ঘোষণা শিল্পমহলের প্রত্যাশা ছাপিয়ে গিয়েছে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে তারা ১ লক্ষ কোটি টাকার স্টিমুলাস চেয়েছিল। আজ অর্থমন্ত্রী ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকার ‘স্টিমুলাস’ দিয়েছেন। কর্পোরেট কর কমানোয় বছরে ওই পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হবে।
এ দিনের ছাড়ের ফলে ভারতে কর্পোরেট করের হার পূর্ব এশীয় দেশগুলির সমতুল হল। শিল্পমহল এই সিদ্ধান্তকে ‘সাহসী পদক্ষেপ’ আখ্যা দিলেও এর ফলে রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্য নাগালের বাইরে চলে যাবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। নির্মলা বলেছেন, সব দিক দেখেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রক সূত্র বলছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে পাওয়া ১.৭৬ লক্ষ কোটি টাকা সহায়ক হয়ে উঠবে। সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির অভিযোগ, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে টাকা ছিনিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁর শিল্পপতি বন্ধুদের হাতে তুলে দিলেন।
কর কিস্সা
কর্পোরেট কর ৩৪.৯৪% থেকে কমে ২৫.১৭%।
১ অক্টোবরের পরে নতুন কারখানা খুললে কর্পোরেট কর ২৯.১২% থেকে কমে ১৭.০১%।
ম্যাট ১৮.৫%, থেকে কমে হচ্ছে ১৫%।
নথিভুক্ত শেয়ার বিক্রি থেকে মূলধনী লাভে বাজেটে চাপানো সারচার্জ প্রত্যাহার।
মোট রাজস্ব ক্ষতি ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকা।
চলতি অর্থ বছরের প্রথম দিন, ১ এপ্রিল থেকে নতুন করের হার প্রযোজ্য হবে। সে জন্য আয়কর আইন ও বাজেটের অর্থ আইনে সংশোধন করতে অধ্যাদেশ জারি হবে। শিল্পমহল তাই একে ‘মিনি বাজেট’ হিসেবে দেখছে। আর কংগ্রেসের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী নিজেদের বাজেটই খারিজ করে দিচ্ছেন। রাহুল গাঁধীর কটাক্ষ, হিউস্টনে ‘হাউডি মোদী’ অনুষ্ঠানের আগে শেয়ার বাজারকে চাঙ্গা করতেই মোদীকে এই মরিয়া পদক্ষেপ করতে হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর অবশ্য দাবি, এই সিদ্ধান্ত ‘ঐতিহাসিক’। তাঁর আশা, নতুন লগ্নি আসবে। নতুন কারখানা
খোলায় করের হার কমানোয় বিদেশি সংস্থাগুলিও এ দেশে কারখানা তৈরি করবে। চিন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে চিন থেকে অনেক সংস্থাই কারখানা গোটাতে চাইছে। তারা এ বার এ দেশে আসার কথা ভাববে।
কিন্তু অর্থনীতিবিদদের প্রশ্ন, নতুন লগ্নি যে আসবেই তার কী গ্যারান্টি? কারণ, জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সহজ হয়নি। লাল ফিতের ফাঁস সবটা কাটেনি। সর্বোপরি সঙ্ঘ পরিবারের আপত্তিতে শ্রম আইন সংস্কার হয়নি। এই অবস্থায় আজকের দাওয়াইয়ে লগ্নিতে কতটা জোয়ার আসবে, তা নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি নির্মলা।
চলতি অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে বৃদ্ধির হার মাত্র ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। আজকের ঘোষণায় বৃদ্ধির হার চাঙ্গা হবে কি? বেদান্ত রিসোর্সেস সংস্থার চেয়ারম্যান অনিল আগরওয়ালের মন্তব্য, ‘‘আমি বলছি না যে, ৩ মাসের মধ্যে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে যাবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।’’ তবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাসের দাবি, সরকারি খরচে গতি আসায় জুলাই মাস থেকেই বৃদ্ধির হারে গতি আসবে।
এ দিনের ঘোষণায় শেয়ার বাজারে অকাল দীপাবলি এলেও অর্থনীতির ঝিমুনি কাটবে কি না, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা সন্দিহান। কারণ দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বাজারের চাহিদা। তাতেই ভাটার টান। অর্থনীতিবিদদের মতে, আমজনতার হাতে নগদের জোগান বাড়ানো উচিত ছিল। তার জন্য মধ্যবিত্তের আয়করের বোঝা কমানো দরকার। একইসঙ্গে শিল্পমহলের ঋণের খরচ কমাতে ডিভিডেন্ড বণ্টন করও কমানো দরকার। অদূর ভবিষ্যতে এ বিষয়ে সুখবর মিলবে এমন কোনও প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি হননি অর্থমন্ত্রী।